সন্মিত্রা: চতুর্দশ পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
হঠাৎ চোখ গেল সামনের ডান পাশে। আজমল সাহেব বিষণ্ন মনে কিছুটা অনবধানতার সঙ্গে রাস্তা পার হচ্ছেন। তিনি আমার সিনিয়র। সচিব হয়ে অবসরে যাওয়ার কথা, কিন্তু ঠোঁটকাটা আর প্রতিবাদী ছিলেন। তাই যুগ্মসচিবেই শেষ। এখন অবসরে। তাঁর অধীনে আমি কয়েক বছর চাকরি করেছি। নেহাত ভদ্রলোক। অমায়িক আর সহজসরল। অনেকটা গোবেচারা। কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন অটল কাঞ্চনজঙ্ঘা। নীতির বাইরে গেলে সচিব কী, মন্ত্রীকেও পাত্তা দিতেন না। এজন্য কতবার যে শোকজ খেতে হয়েছে, ওএসডি হয়েছে এবং কতবার যে শাস্তিমূলক বদলি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
সেলিমকে গাড়ি থামাতে বললাম।
গাড়ি থামানোর আগেই আজমল সাহেব আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন, শামীম না?
কোথায় যাবেন স্যার? সালাম দিয়ে জানতে চাইলাম।
সচিবালয়।
প্লিজ, উঠে আসুন।
“জীবন দুর্বিষহ হয়ে গেছে”, গাড়িতে উঠতে উঠতে আজমল সাহেব বললেন, “সারা জীবন দিয়ে গেলাম, কিছুই পেলাম না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে জীবনটা গাড়ির চাকায় দিয়ে দিতে, বিষ খেয়ে সবাইকে ঘণ্টাখানেকের জন্য হলেও কাঁদাতে। কত দেব আর!”
জীবন দুর্বিষহ নয়।
কী? রসগোল্লা? এজন্যই তো পিঁপড়ে মাছি ভ্যানভ্যান করে।
জীবন একটা উপহার। জীবনের তুলনায় কষ্ট সমুদ্রের তুলনায় একবিন্দু জলের চেয়েও নগণ্য। কেন আমাদের আকুতি থাকবে, কেন থাকবে অপ্রাপ্তির কান্না? এসব জীবনকে আরও কষ্টময় করে তোলে। অপ্রাপ্তি ভুলে প্রাপ্তির বন্দনায় মগ্ন হোন। দেখবেন— বঞ্চনার সব কষ্ট প্রাপ্তির আনন্দে ভরে গেছে। একাকিত্বকে বরণ করার কৌশল রপ্ত করতে পারলে হলো।
আমি পারি না। গাড়ি আমার, নিয়ে গেল ছেলে। তোমার ভাবি বলে— “বুড়ো বয়সে গাড়ি কেন, রিকশায় যাও। জীবনে বহুত ফুটানি দেখাইছ। এবার থামো। ” যার কাছে সবচেয়ে বেশি পাওয়ার কথা সেই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত করে। যাকে বেশি দেই, সেই বেশি কেড়ে নেয়।
এটাই তো হওয়ার কথা। যাকে দেবেন তার কাছ থেকে পাওয়ার আশা করার মধ্যে কষ্টের সূচনা নিহিত। তার থেকে পাওয়ার আশা করলে নিহত তো হতেই হবে। কিন্তু সে কে?
তোমার ভাবি। মানে আমার বউ।
তাঁর ওপর এত ক্ষোভ?
সারাক্ষণ শুধু বকবক করে, অকথ্য গালি দেয়। পান থেকে চুন খসলে লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে ছাড়ে।
স্যার, বউ মানে তো ‘বকার উৎস’ কথার সংক্ষিপ্ত রূপ। কিন্তু বকাটা কেন দেন?
আমার সব ব্যাচম্যাট না কি সচিব হয়ে রিটায়ার্ড করেছে। আমি হতে পারিনি। যতই বলি সব ব্যাচম্যাট সচিব হয়নি। যারা মরা মাছের মতো স্রোতের জলে ভেসে ভেসে শেষ পর্যন্ত পচে গেছে কেবল তারাই সচিব হয়েছে। বিশ্বাস করে না। সরকার প্রধান হোক বা ফুটপাতের রমিজ আলী হোক— স্ত্রীর কাছে স্বামীর চেয়ে নিকৃষ্ট কোনো পুরুষ নেই। প্রত্যেক স্ত্রী মনে করে, পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট আর মিথ্যুক পুরুষটির সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। তাই, স্বামীকে নিজের তুলনায় অতি নিকৃষ্ট এবং অযোগ্য ভেবে কষ্ট পায়নি এমন স্ত্রী সম্ভবত পৃথিবীর কোথাও নেই।
প্রত্যেক পুরুষও ভাবে যে, তার বউয়ের মতো মুখরা আর নেই। দুজন ভিন্ন লিঙ্গের বৈপরীত্য খুবই স্বাভাবিক। জীবনসঙ্গীর পতনহীন ভালোবাসা পেতে হলে সমলিঙ্গকে সঙ্গী করা ছাড়া বিকল্প নেই।
তোমার ভাবির ধারণা, আজমলই একমাত্র পুরুষ, যে বারে গিয়ে মদ খায়। আন বাড়ি গিয়ে আন রমণীর সঙ্গ নেয়। আর কোনো পুরুষ এমন করে না। একদিন বলেছিলাম, তাহলে পৃথিবীর সব বার আর বেশ্যাবাড়ি কি আমি আজমলের জন্য? তার সোজা উত্তর, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ। তোমার জন্যই।” কেমন লাগে বলো তো?
আমি চুপ করে তার কথা শুনছিলাম। কিছুক্ষণ তিনিও চুপ করে থেকে বললেন, আমি এত কথা বললাম, তুমি তোমার কথা কিছু বললে না যে?
দুজনে একসঙ্গে আলাপ হয় না, ঝগড়া হয়। আলাপ হচ্ছে একজন শেষ করলে আর একজনের বলা।
এরবার তাহলে বলো।
বিয়ের পর সবকিছু মেনে নিতে হয়। মানিয়ে নেওয়ার মতো করে গড়ে তোলার সুযোগ থাকে না। রাতারাতি পরিবর্তন করে ফেলতে হয় নিজেকে। যারা পারে তারা বলদ হয়। আর যারা পারে না তাদের জ্বলতে হয়। ছেলে হোক আর মেয়ে হোক— এর বিকল্প নেই।
তাহলে তুমি কি সব মেনে নিতে বলছ?
মেনে নিয়েই তো জীবনটা প্রায় শেষ করে দিলেন।
আমি বউয়ের থেকে আমার প্রাপ্য সম্মান আদায় করেই ছাড়ব।
পারবেন না।
কেন?
এমন হলে ভাবিজান তখন আপনার স্ত্রী থাকবেন না। দ্বিতীয়ত, আপনাকে অভদ্র হয়ে যেতে হবে। ভদ্রলোক, কারও সম্মান পান না। কেউ যদি পেয়ে থাকেন, ধরে নেবেন তিনি ভদ্রলোক নন।
ঠিক বলেছ, জয়নাল আমার ডিএস ছিল। মনে হয়, তোমার ব্যাচম্যাট। তাকে অফিসের সবাই বাঘের মতো ভয় করত। মুখ ছিল তোমার ভাবির গালের মতো গালির কারখানা। জুনিয়ররা আমাকে তেমন ভয় করত না, জয়নালকে প্রচণ্ড ভয় করত। অথচ আমি তাদের বস ছিলাম।
প্রেসক্লাব পার হওয়ার আগে আজমল সাহেব বললেন, কিছু খাব।
কেন?
সকালে খেয়ে আসিনি। আরে ভাই ঘুম থেকে উঠার পরপরই শুরু করে বকবক। মনে হয়, ঢাকা শহরের সব কাউয়া আমার ঘরে। কী অসহ্য! মাঝে মাঝে মনে হয়— কান দুটো নষ্ট করে দেই।
আমিও খেয়ে বের হইনি। সেটি বললাম না। নিজের দুর্বলতা যত কম প্রকাশ করা যায় তত ভালো। তাহলে আঘাতে আঘাত আর মননে উপহাস পাওয়ার আশঙ্কা কিছু কম থাকে। রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লাম দুজন।
খেতে খেতে আজমল সাহবে বললেন, বিল কিন্তু আমি দেব।
সিনিয়রই তো বিল দেন। প্রশাসন ক্যাডারের এটাই রেওয়াজ।
আচ্ছা, তোমার বউ কি তোমার সঙ্গে আমার বউয়ের মতো খারাপ ব্যবহার করে?
ভিক্ষার মূলধন দুর্বলতা। ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া আর কোথাও দুর্বলতা প্রকাশ করতে দেখা যায় না। যতটুকু সম্ভব গোপন রাখে। কিন্তু যখন প্রকাশ না করে উপায় থাকে না, তখন এমনভাবে প্রচার করা উচিত যেন, মানসম্মান কিছুটা হলেও বজায় থাকে। আমার সিনিয়র সহকর্মী করিম সাহেব আমাকে ডাকতেন— ছেলে। তার কোনো ছেলে সন্তান ছিল না। পারিবারিক অনেক কথা আমাকে বলতেন। তার একটামাত্র মেয়ে। আমার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার শখ ছিল খুব। মেয়েটির সব পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগ। বিয়ের প্রস্তাব এলে বরপক্ষ যদি জানতে চাইত, “আপনার মেয়ে কোন বিভাগ পেয়েছে?” ফাস্ট ডিভিশন পেয়েছে বলতে পারলে ভালো লাগত, কিন্তু ডাহা মিথ্যা তো আর বলা যায় না। তাই বলতেন, “আমার মেয়ে জীবনে কখনো ফেল করেনি।” আমাদের বিল্ডিঙের তৃতীয় তলার আকতার সাহেবের তিন মেয়ে। ছেলেমেয়ে কয় জন কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলেন, দুই মেয়ে এক কন্যা।
কী ব্যাপার, খাচ্ছ না কেন? আজমল স্যার অনেকটা ধমকমার্কা প্রশ্ন করলেন।
নিচ্ছি।
হুইস্কি চলে? আমার সঙ্গে আছে। কোকের বোতলে কোকের সঙ্গে মেশানো। খাঁটি রাশান। গন্ধ নেই। স্বয়ং মহাদেবও টের পাবে না। টানবে?
থ্যাঙ্ক ইউ।
কেন?
সচিবালয়ে ঢুকলেই সারাক্ষণ মন্ত্রীর সঙ্গে থাকতে হয়। গন্ধ পেলে সচিবালয়ের দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দেবেন।
সব মন্ত্রী তো টানেন।
ইনি সব নন, সৈয়দ আবুল হোসেন।
হ্যাঁ, তিনি অসাধারণ।
আচ্ছা স্যার, আমি কি সচিব হতে পারব?
না।
সচিব কে হয়?
যার মেরুদণ্ড থাকে, কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়ায় না; যার মস্তক থাকে, কিন্তু স্বাধীন চিন্তা করার সাহস থাকে না; যার হাত-পা থাকে, কিন্তু ক্রীড়নকের মতো অন্যের ইশারায় নাচে— সেসব জীবন্মৃতজড়গণ সচিব হতে পারে। আমি এসব পারিনি বলে সচিব হতে পারিনি। তুমিও পারবে না।
চলুন, সচিবালয়ে ঢুকে পড়ি। মন্ত্রী মহোদয় ডেকে না পেলে রুষ্ট হবেন।
সন্ধ্যায় অফিসার্স ক্লাবে এস। কথা আছে।
লন্ডন যাব। রাতে ফ্লাইট। তাছাড়া আমি অফির্সাস ক্লাবে যাই না।
কেন?
ভাগাড় ভাগার লাগে। মনে হয় কথাবর্জনার মাঝে বসে আছি। চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিছু মিথোম্যানিয়াক। আচ্ছা স্যার— অফিসারগণ এত মিথ্যা বলে কেন?
অফিসার্স ক্লাব আমারও ভালো লাগে না।
তাহলে যান কেন?
তোমার ভাবি দেওয়া মানসিক যন্ত্রণা হতে বাঁচতে। তুমি কী জানো সব অফিসার একই কারণে ক্লাবে যায়?
সবাই!
একশ জন অফিসারের মধ্যে একশ জনই বউয়ের মানসিক অত্যাচারের শিকার। শালারা সম্মানের ভয়ে বছরের পর বছর বউয়ের অপমান সয়ে যায়। কাউকে কিছু বলে না। এভাবে দিন দিন বউগণ বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে। ঠিক বলেছি না?
জি।
“পৃথিবীর সবচেয়ে হতভাগা কে?” এই প্রশ্ন করলে তুমি বলবে বিবাহিত মানুষ। আমি বলব, সেসব বিবাহিত মানুষ, যারা ঘরে পুত্রবধূ আসার আগে আত্মবধূর কাছে পুত্রবধুর ব্যবহার পাচ্ছে।
কী হয়েছে, আপনার?
দরজা খুলে বের হচ্ছিলাম। হঠাৎ বাতাস এসে ধাক্কা দিল। দরজায় টক করে আওয়াজ হলো। তোমার ভাবি মেঘের গর্জন নিয়ে দৈত্যের মতো দৌড়ে এল— “ছেলে পড়তে বসেছে, দোখো না। দরজা খুলতে যদি এত আওয়াজ হয় তো আমার ছেলে পড়বে কীভাবে? তুমি কি মানুষ?” দেখো, কী থেকে কী! অথচ, তার গর্জন ছিল দরজার টক শব্দের চেয়ে অনেক বেশি।
কিছু বলেননি?
ছেলে পড়ছিল না?
প্রতিবাদ করা উচিত ছিল।
ছেলেও যদি এসে বলত— বাবা, দরজা আস্তে খুলতে পার না? বুড়ো বয়সে এত তাড়া কীসের? কী হতো তখন?