Warning: Constant DISALLOW_FILE_MODS already defined in /home/draminb1/public_html/wp-config.php on line 102

Warning: Constant DISALLOW_FILE_EDIT already defined in /home/draminb1/public_html/wp-config.php on line 103
সন্মিত্রা : এক মলাটে সন্মিত্রা: সন্মিত্রা সম্পূর্ণ উপন্যাস : প্রথম থেকে শেষ পর্ব – Page 15 – Dr. Mohammed Amin

সন্মিত্রা : এক মলাটে সন্মিত্রা: সন্মিত্রা সম্পূর্ণ উপন্যাস : প্রথম থেকে শেষ পর্ব

সন্মিত্রা: পঞ্চদশ  পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন

নয়টা ত্রিশ মিনিটে সেমিনার শুরু হবে। পৌঁছা উচিত নয়টার মধ্যে। নিবন্ধন ছাড়াও আরো নানা আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে। হিথরোয় নেমে দেখি, মাত্র সাতাশ মিনিট বাকি। বাইরে প্রচণ্ড শীত। বাসা থেকে রচনা শীতরোধক কাপড় নিয়ে এসেছে। পরিয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরল। উষ্ণতার আমেজ শরীরে ভালোবাসার অরোরা ঢেলে দিল। বয়স যত বাড়ছে শরীর তত আদরলোভী হয়ে উঠছে, কিন্তু আদর দেওয়ার মানুষের সংখ্যা ক্রমশ কমছে আর কমছে।
খোলা আকাশের নিচে যাওয়ার পর রচনা আমাকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরল। ঠান্ডা যাতে কোনোভাবে আঁচড় কাটতে না-পারে। মায়ের পর এমন আদরে আর কে জড়িয়ে ধরেছে? কল্পনা ছাড়া আর কারও কথা মনে পড়ল না। ঋধিতার খেয়াল বাসা আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে। বউয়ের আদর পেতে হলে স্বামী না হয়ে বাসার একটি বেসিন হওয়া উচিত।
আমাদের এক প্রবীণ সহকর্মী বলতেন, আমার দুই হাজার বর্গফুটের বাসার মেঝের প্রতিটি কোনা আমার স্ত্রীর পরশ পেয়েছে, কিন্তু আমার এই ছোট্ট শরীরের ভাগ্যে তা জোটেনি।
গাড়ির কাছে এসে গেলাম। গাড়িতে উঠতে উঠতে রচনা বলল, ভাব্বা, ফ্রেশ হওয়ার জন্য রেস্ট হাউজে যাওয়া যাবে না।
কেন?
সময় দেখুন, সময় নেই। বরং আপনাকে সেমিনার ভবনে নামিয়ে দিয়ে কিছু কাজ আছে তা সেরে নেব।
আমি? ছোটো শিশুর মতো আতঙ্কিত গলায় বললাম।
সেমিনার শেষ হওয়ার আগে চলে আসব। না-আসা পর্যন্ত কোথাও যাবেন না।
নয়টা পঁচিশ মিনিটে পৌঁছে গেলাম সেমিনারস্থলে। নিবন্ধন প্রায় শেষের দিকে। রচনা আমাকে নামিয়ে দিয়ে তার কাজে চলে গেল।
বাংলাদেশ দলের অন্য সদস্যবৃন্দ একদিন আগে এসে গেছেন। বাইরে তাদের কাউকে দেখলাম না। নিবন্ধন তালিকায় স্বাক্ষর রয়েছে। তার মানে সবাই সেমিনার কক্ষে। আমি এসেছি স্টকহোম থেকে। ওখানকার কাজ শেষ করে লন্ডন আসতে হয়েছে। দুই হাজার চল্লিশ কিলোমিটার আকাশভ্রমণ—কম নয়। এর কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ থেকে স্টকহোম গিয়েছি। ভাগ্য ভালো কষ্ট হলেও দেরি হয়নি। ভ্রমণে ভ্রমণে শরীরের দফা একদম রফা। তবু বিছানায় পড়তে হয়নি— এ ঢের। আগামীকাল সরকারি ছুটি। রেস্ট হাউজে যাব না। কষ্ট হলেও এখান থেকে সোজা চলে যাব অক্সফোর্ড, রচনার কোয়াটারর্সে।
সেমিনার কক্ষ থেকে বের হয়ে দেখি— রচনা দাঁড়িয়ে। আলনা থেকে আমার স্যুয়েটার নিয়ে পরিয়ে দিল। মাথায় গলিয়ে দিল ক্যাপ। হাতে পরিয়ে দিল গ্লভস।
বাইরে কি খুব ঠান্ডা?
হ্যাঁ।
আমরা দোতালায়। লিফট নিষ্প্রয়োজন।
সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে রচনা বলল, ভাব্বা, একটা কথা বলি?
বলো।
আপনি স্থায়ীভাবে ইংল্যান্ড চলে আসুন।
কী হবে?
সবসময় আপনার সেবা করতে পারব, আপনাকে দেখতে পাব। ঢাকার মতো একসঙ্গে থাকব, মজা হবে। আপনাকে ছাড়া কিছু ভালো লাগে না।
তোমার ম্যাম?
ম্যামকেও নিয়ে আসুন।
আগেও এমন কথা বলেছিলে। একটা জবাব দিয়েছিলাম, মনে আছে?
নেই। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি। বয়স যত বাড়ে স্বার্থপরতার গতিও তত বাড়ে। মৃত্যু মানুষকে শুধু কবরের দিকে নিয়ে যায় না, লোভের দিকেও নিয়ে যায়। লোভ মানে পাপ। এজন্য বলা হয়— লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।
তুমি বাংলাদেশ গেলে আমার বাসায় উঠতে পার না। হোটেল উঠতে হয়। তোমার ম্যামকে লন্ডন আনার প্রস্তাব দিয়ে তুমি লন্ডনকে তোমার আর আমার জন্য বাংলাদেশের মতো অসহনীয় করে দিতে চাইছ।
কীভাবে?
আকর্ষণ প্রাপ্তির বিপরীত অনুষঙ্গ। প্রাপ্তি আকর্ষণের শিহরনকে ভোঁতা করে দেয়। প্রিয় মানুষ যত কাছে আসে, যত সহজলভ্য হয়ে ওঠে, তার প্রতি আসক্তি তত কমে যায়। এজন্য বউয়ের চেয়ে প্রেমিকা এবং প্রেমিকার চেয়ে অপরিচিতদের প্রতি মানুষের আকর্ষণ অধিক দেখা যায়। আমার প্রতি তোমার এত ভালোবাসা এবং তোমার প্রতি আমার এত টান এখনো কেন এত প্রবল তা জানো?
না।
স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের সম্পর্কটা কেবল কাগজ, ধর্মীয় বা সামাজিক বন্ধন। তার ক্রিয়াকর্ম কেবল জন্মদান আর দায়িত্বের সংকীর্ণ সীমায় আবদ্ধ। এছাড়া দাম্পত্য জীবনে আর কিছু আছে? কোনো কিছু দিয়ে সম্পর্ককে সীমিত করে দিলে ভালোবাসাও সীমিত হয়ে যায়। বিবাহে নানা নামের নানা বন্ধন দিয়ে ভালোবাসাকে সংসারের ছোটো গণ্ডিতে বেঁধে রাখা হয়। তাই জায়া-পতির জাম্পত্য জীবনকে অনেকে কারাগার বলে। আমি কারাগার বলি না, বলি—গরম জলে ফেলে দেওয়া জীবন্ত কচ্ছপের কষ্ট।
কথায় কথায় গাড়ির কাছে চলে এলাম। রচনাই গাড়ি চালাবে। ড্রাইভার মিটু অক্সফোর্ড। সে রাজ-রোজিকে নিয়ে শিক্ষাসফরে গেছে। মিটু ডাক নাম। আসল নাম হামিদ ফয়সল চৌধুরী। সে নিনির স্বামী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স। বেতন দুই লাখ টাকা।
গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার কিছুক্ষণ পর রচনার মোবাইলে রিং এল।
রচনার হাত স্টিয়ারিঙে।
আমি মোবাইল নিয়ে দেখলাম, ঋধিতা।
কে?
তোমার ম্যাম।
দেন, কথা বলি?
না।
কিছু মনে করবেন না তো আবার?
বাসায় গিয়ে রিং কোরো।
যদি আপনার কথা জানতে চাই?
আমি আসার খবর তুমি জানো না—এটা বলে দিও।
মিথ্যা বলব?
সত্য-মিথ্যা দিয়ে তুমি কী করবে? সবকিছু কল্যাণের জন্য। সত্য-মিথ্যার চেয়ে ন্যায়-অন্যায়; ন্যায়-অন্যায়ের চেয়ে শান্তি-অশান্তি এবং শান্তি-অশান্তির চেয়ে নিরাপত্তা অনেক বেশি অপরিহার্য, অনেক মানবিক। যে সত্য সবাইকে কষ্ট দেয়, অশান্তির সৃষ্টি করে সেটি পরিত্যাগ করাই মানবতা। যে মিথ্যা, শান্তি ও নিরাপত্তা দেয় সেটাই গ্রাহ্য। গিয়াস কামাল চৌধুরীর কথা মনে নেই?
খুব মনে আছে।
অতএব, চলুক মিথ্যা ইচ্ছেমতো, কল্যাণ হোক শত শত।
মাঝে মাঝে বুকটা ফেটে যায়। রাতে বারান্দায় এসে উদাস হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকি। বাগানে এসে সবুজ ঘাসে হাঁটি। রাজরোজি জড়িয়ে ধরে বলে, “ড্যাডের কথা মনে পড়েছে? আসার জন্য বলে দাও।” যদি আকাশ হয়ে যেতে পারতাম!
কী হতো? আকাশের কষ্টের কথা তুমি আমি কী জানি!
জীবনের মতো বিশাল একটা বিষয়কে শরীর নামের খুদে পাত্রে ভরে দেওয়া হয়েছে। ভাব্বা, এটা কি ঠিক হয়েছে? তাই জীবের এত কষ্ট।
উত্তরণের উপায়?
মৃত্যু। এছাড়া আর কোনো পথ নেই। সত্যি, মাঝে মাঝে আমার খুব কষ্ট হয়।
কেন?
আপনার কষ্ট দেখে।
জীবন, সংসারের মতো কষ্টের বিষয়। আমার কোনো কষ্ট নেই। কষ্ট পায় জীবন। তাতে আমার কী?
এজন্য আর্ষরা এটি এড়িয়ে চলে। সংসার কষ্টের রশি দিয়ে বানানো একটি রক্তাক্ত নকশীকাঁথা। উষ্ণতার চেয়ে উগ্রতা প্রবল।
কষ্ট হচ্ছে অনিন্দ্য উপভোগের অনিবার্য উপাদান। লৌহকে ব্যবহারোপযোগী করার জন্য আগুনে পোড়াতে হয়, পেটাতে হয় ভীষণ হাতুড়ি দিয়ে। স্বর্ণকে অলংকারে পরিণত হতে কত কষ্টের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়, বলো? কষ্টের মধ্য দিয়ে অগ্রসর না হলে অলংকার হওয়া যায় না। অগণিত সাংঘর্ষিকতার মাঝেও বেঁচে থাকতে হয়, বেঁচে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। এটাই জীবন। তাই প্রত্যাশার কাছে নৈতিকতা বারবার হেরে যায়। মাছ খাবে, মাছ ধোয়ার স্বচ্ছ জলও চাইবে, তা হতে পারে না। অমন স্বচ্ছ জল পেতে চাইলে না ধুয়ে মাছ খেতে হবে, নতুবা মাছহীন থাকতে হবে। আমি কষ্ট পাই, তুমি পাও না?
ভাব্বা, কষ্ট আমার একজন উপকারী বন্ধু। কষ্ট আমাকে কষ্টহীন করে দিয়েছে। আমি কষ্টের কাছে ঋণী, যেমন ঋণী আপনার কাছে। আমি তো আপনার প্রতিবিম্ব মাত্র। তাই আপনি কাছে না থাকলে অস্তিত্বহীনতায় ভুগি। অনেকে ‘পরিতৃপ্ত’ বানানের একটা শব্দ উল্লেখ করেন। কিন্তু ‘পরিতৃপ্ত’ কথাটা এতই দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যায় যে, তা না বলাই উত্তম। খাওয়ার পর মানুষ বলে, আর খাব না। কিছুক্ষণ পর আবার খায়, খেতে হয়। বলে— খিদে পেয়েছে।
মানুষ যতই সাফল্য অর্জন করুক না, থেমে থাকার মতো তৃপ্তি কখনো অর্জন করতে পারবে না। এটাই মানুষের কষ্ট। তৃপ্তি কথাটি কেবল প্রাপ্তির তাৎক্ষণিক ধারণাকে ব্যক্ত করার জন্য প্রকাশ করা হয়। তাই প্রকৃত অর্থে মানুষ কখনো তৃপ্তি পায় না, পশুরা পায়। আধুনিক সভ্যতা যন্ত্রের বিনিময়ে আমাদের পরিতৃপ্তি চিরতরে নিয়ে গেছে।
গোরু মেরে জুতো দান।