Warning: Constant DISALLOW_FILE_MODS already defined in /home/draminb1/public_html/wp-config.php on line 102

Warning: Constant DISALLOW_FILE_EDIT already defined in /home/draminb1/public_html/wp-config.php on line 103
সন্মিত্রা : এক মলাটে সন্মিত্রা: সন্মিত্রা সম্পূর্ণ উপন্যাস : প্রথম থেকে শেষ পর্ব – Page 16 – Dr. Mohammed Amin

সন্মিত্রা : এক মলাটে সন্মিত্রা: সন্মিত্রা সম্পূর্ণ উপন্যাস : প্রথম থেকে শেষ পর্ব

সন্মিত্রা:  ষোড়শ পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন

 
ঘণ্টা পুরোবার আগে রচনার কোর্য়াটার্সে পৌঁছে গেলাম। দারুণ ড্রাইভিং করেছে মেয়েটি। আমি ঈর্ষা-ভরা খুশিতে দেখছিলাম আর গর্বে ফুলে উঠছিলাম। যারা ভালো তার সবদিকে ভালো হয়।
সন্ধ্যা তখনো পুরো শেষ হয়নি। কোয়াটার্সের বারান্দায় দুই যুবক এবং তিন যুবতি সোফায় বসে নিবিষ্ট মনে বই পড়ছে। সবাই শ্বেতাঙ্গ। বাঙালিরা কেবল পরীক্ষাকেন্দ্রে ঢোকার আগে এভাবে পড়ে। কোনো অপেক্ষমাণ বাঙালিকে কোথাও এত নিবিষ্ট মনে বই পড়তে দেখিনি। অপেক্ষমাণ বাঙালির চিত্ত কেবল অপেক্ষার লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য বাতাসে দোদুল্যমান চিকন তেঁতুল পাতার মতো অস্থির থাকে। কোনো প্রস্তুতি থাকে না। অর্ধেক জীবন শেষ হয়ে যায় অস্থিরতায়। তাই তাদের সিংহভাগ অপেক্ষা বিফলে যায়।
আমরা পড়ি কেবল পরীক্ষায় অধিক নম্বর পাওয়ার জন্য। উদ্দেশ্য চাকুরি। পশু যেমন কেবল বাঁচার জন্য খায়, তেমনি বাঙালিরা পড়ে কেবল চাকুরির জন্য। জ্ঞান অর্জনের বিষয়টা শিক্ষক-শিক্ষার্থী কারো মাথায় থাকে না। ইংরেজরা পড়ে একসঙ্গে জ্ঞান ও নাম্বার দুটোর জন্য। এজন্য তারা তিনটিই পায়। আমরা একটাও পাই না।
রচনা আর আমাকে দেখে তারা ইংল্যান্ডীয় কায়দায় অভিবাদন জানিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। চেহারা আর আচরণে ভদ্রতা।
এরা? রচনাকে ফিসফিস করে বললাম।
কল্পনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।
সে কই?
সে এখন আপনাকে নিয়ে মগ্ন। টুটুল মনে হয় লাইব্রেরিতে। আল্পনা আর শ্যামস পথে।
কল্পনার সঙ্গে দেখা হয়নি? রচনা অপেক্ষমাণদের কাছে জানতে চাইল।
একজন বলল, তাঁর ভাব্বার ছবি আঁকছেন। ওটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেছেন।
কতক্ষণ অপেক্ষায় আছেন? আমি প্রশ্ন করলাম।
আধ ঘণ্টার বেশি হবে।
বিরক্ত লাগছে না?
না। বই পড়ছি। ম্যামের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পর যে কাজটি করতাম সে কাজটি করছি।
সে তোমাদের বিদায় করে দিয়ে নিজের কাজ করতে পারত না?
পারত। তা করলে আমাদের ভালো লাগত, কিন্তু উচিত হতো না। আমাদের কাজ সন্তোষজনকভাবে আদায় করতে পারতাম না। এখন তাঁরও ভালো লাগছে, আমাদেরও ভালো লাগছে। তাঁর খারাপ করে আমরা তো লাভবান হতে পারব না।
কেন?
আমরা আমাদের কাজে এসেছি। ম্যাম নিজের কাজ করছেন। তিনি আমাদের জন্য তার ক্ষতি করবেন কেন? আগে আপন, তারপর সব ভুবন-ভবন। যদি কাজ শেষ না করে আসেন, তাহলে আমাদের পর্যাপ্ত সময় দিতে পারবেন না। মনটাও থাকবে কাজের প্রতি। এ অবস্থায় আমাদের কোনোরকমে বিদায় করে দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকবেন। শেষপর্যন্ত ক্ষতি হবে আমাদেরই।
বাহ!
ভিতরে চলো, রচনা বলল।
তাদের ড্রংয়িংরুমে বসিয়ে রচনা আর আমি কল্পনার রুমে ঢুকলাম। সে ছবি আঁকছে। আমাদের আগমন টের পেল না। ছোটোবেলা থেকে সে এমন। পড়ায় সময়টা দেয় কম; মনটা দেয় বেশি। যখন পড়ে তখন দুনিয়াদারি ভুলে যায়। তাই কম সময় দিয়েও সময় থেকে অনেক বেশি আদায় করে নিতে পারে।
কল্পু?
আমার ডাক শোনামাত্র আবেগকম্পিত কল্পনার হাত থেকে তুলি পড়ে গেল মেঝেতে। চিতার গতিতে দৌড়ে এসে খামচে ধরল ঝাপটে।
ভাব্বা, কতদিন পর!
তাহসিন কদমবুসি করে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
ওদের বিদায় করে দিয়েও ছবি আঁকতে পারতে? রচনা বলল।
পারতাম, কিন্তু করিনি।
কেন?
ভাব্বার ছবি অবচ্ছিন্নভাবে আঁকতে হবে। ইচ্ছে করে অপেক্ষায় রেখেছি। এরা লর্ডক্লাইভের বংশধর। আমাদের পূর্বপুরুষদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখত।
আমি কিন্তু তাদের ড্রয়িংরুমে বসতে দিয়েছি।
আমি চেয়েছিলাম, ঘণ্টাখানেক অপেক্ষায় থাকুক। যাক, ঘণ্টা প্রায় হয়ে গেছে।আমার কাজও শেষ। এরা এমন একটা জাতি প্রয়োজনে সব করতে পারে। কোনো অপমানই গায়ে মাখে না। প্রয়োজন মিটে গেলে, তোমাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে একটা সেকেন্ডও চিন্তা করবে না।
“সবাই এমন করে।”, আমি বললাম, “সবাই এ ভাবে উন্নত হয়, সভ্য হয়। অন্যকে পদানত করাই হচ্ছে উন্নয়ন। তুমি যত বেশি লোককে পদানত করতে পারবে, বঞ্চিত করতে পারবে, শোষণ করতে পারবে— তুমি তত উন্নত হবে। ইংরেজরা সারা বিশ্বকে পদানত করতে পেরেছে, শোষণ করতে পেরেছে। তাই তারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতি। তুমি পারনি, তাই তুমি অনুন্নত। উন্নয়ন মানে তোমার জিনিস আমার কাছে চলে আসা। ইংরেজরা একসময় মোগল সম্রাটের দরবারে মাথা নিচু করে ঢুকেছে। তারপর একদিন সম্রাটকে বের করে দিয়ে নিজেরাই সিংহাসন দখল করে নিয়েছে। এটাই নিয়ম। মোগল দখল করেছে হিন্দুদের কাছ থেকে, লর্ড ক্লাইভ দখল করেছে মুসলিম থেকে। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা।
ছবি আঁকা শেষ হয়েছে? রচনা জানতে চাইল।
হয়েছে।
তাহসিন, তুমি ছেলেমেয়েগুলোকে একটু সঙ্গ দাও গিয়ে।
যাচ্ছি।
তাহসিন চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর রচনা কল্পনাকে বলল, তারা বসে আছে অনেকক্ষণ।
থাকুক। আমি তাদের ঘৃণা করি।
তাহলে তাদের দেশে এলে কেন?
তারা কেন আমাদের দেশে গিয়েছিল?
তোমার এত গর্ব কীসের, সহানুভূতিশীল হতে শেখো।। ভালোবাসতে শেখো। তাহসিনকেও তুমি অবহেলা করো। এটা ঠিক নয়। অবহেলা শেষ পর্যন্ত নিজের ওপর গিয়ে পড়ে। এটি অনেকটা রাগের মতো। ভাব্বাকে অবহেলা করে বলে ম্যামের উপর তোমার ভারি রাগ, কিন্তু তুমি যে তাহসিনকে অবহেলা কর— তার বেলা? ম্যামের প্রতি ক্ষুব্ধ হওয়ার আগে নিজের প্রতি নজর দাও।
কল্পনা বলল, চারদিকে শুধু অহংকার আর অহংকার; গর্ব আর গর্ব। অহংকার আর গর্ব মানুষকে যেভাবে হিংস্র করে তুলছে, তাতে আমি নিশ্চিত মানুষ আদিম যুগের চেয়ে এখন আরও অনেক পিছিয়ে গেছে।
আমি বললাম, এমন গর্ব হতে বের হয়ে এসে সর্বজনীন হতে না পারা পর্যন্ত মানুষে মানুষে হানাহানি রোধের কার্যকর কোনো উপায় বের করা যাবে না। তুমি বের হয়ে এসো।
ভাব্বা, আমি যদি আপনার মতো ভদ্র হয়ে যাই, তাহলে কেউ আর পাত্তা দেবে না। ম্যাম যেমন আপনাকে পাত্তা দেয় না। পাত্তা জোর করে আদায় করে নিতে হয়। যারা পারে না তারা পদদলিত হতে থাকে।
“তুমি কী বললে!” রচনা আকস্মিক রেগে গেল, “ম্যামের প্রতি তোমার এত অশ্রদ্ধা কেন? সব দোষ কি ম্যামের?”
সরি, আপু।
শোনো, যারা এত অল্পতে এত বেশি গর্বিত হয়ে পড়ে তাদের আসলে গর্ব করার কিছু নেই বলে অমন গর্ব করে।
কিন্তু সবাই গর্ব করে।
কে বলল?
তুমি বলেছ— ভাব্বা আমার গর্ব। বলোনি?
বলেছি।
কেউ বলে আমি হিন্দু এজন্য গর্বিত। কেউ বলে আমি ইহুদি এজন্য গর্বিত। কেউ বলে আমি ভারতীয় এটাই আমার গর্ব। কেউ বলে আমি মুহম্মদের উম্মত এজন্য গর্বিত, কেউ বলে আমি মুসলিম নই—এটাই আমার গর্ব। কেউ বলে আমি বাবার বড়ো ছেলে এজন্য গর্বিত, কেউ আবার মা-বাবার ছোটো ছেলে বলে গর্বিত। কেউ বলে নারীত্বই আমার গর্ব আবার কেউ বলে আমি পুরুষ এটাই আমার গর্ব। কেউ বলে আমি অমুকের সন্তান এর চেয়ে বড়ো গর্ব আর কিছু হতে পারে না। কেউ বলে মনুষ্য জন্মই আমার গর্ব। কেউ বলে আমি শিক্ষক এটাই আমার গর্ব, কেউ বলে আমি পুলিশ— এটাই আমার গর্ব। চারদিকে এত গর্ব যে, গর্বহীন কোনো মানুষ পাওয়া যায় না। মাঝে বলি— গর্বিত না কি গর্ভিত?
আমি বললাম, যাও এবার, ওরা অনেকক্ষণ বসে আছে তোমার জন্য।
যাচ্ছি।
কল্পনা রুম থেকে বের হতে যাবে এমন সময় নিনি ঢুকল চলমান ট্রে নিয়ে। শাড়ি পরেছে সে। বেশ লাগছে।
“নিনি আপু”, কল্পনা বলল, “মেহমানদের জন্য নাশতা নিয়ে এসো।”
দিয়েছি, নিনি আমাদের সামনে জুসের গ্লাস রাখতে রাখতে বলল।
“বাহ”, আমি বললাম, “আমাদের নিনিকে তো চেনাই যাচ্ছে না। চেহারায়, কথায় আর দায়িত্বে খাস ইংরেজ। কিন্তু পোশাকে খাঁটি বাঙালি কনে। কি গো নিনি— আমাদের ভুলে যাবে না তো?
হাসি দিয়ে পা ছুঁয়ে বলল, ইটস অল ফর ইউ।
তোমার স্বামীর খবর কী?
লজ্জিত হাসিকে গর্ব দিয়ে সাজিয়ে বলল, সে রাজ-রোজিকে নিয়ে শিক্ষাসফরে গেছে। আধ ঘণ্টার মধ্যে চলে আসবে। খবর দিয়েছি।
শিক্ষাসফর কোথায়?
ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি বোটানিক গার্ডেন।
তুমি গিয়েছ কখনো?
হ্যাঁ, আপুর সঙ্গে।
নিনির স্বামী হামিদ ফয়সল খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। দেশে উপযুক্ত চাকুরি না পেয়ে লন্ডন এসেছিল কাজে। কিন্তু সুবিধা করতে পারল না। কিছুদিন বাঙালির একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করেছিল। ড্রাইভিং জানত ভালো। একদিন কবীর চৌধুরীর সুপারিশ নিয়ে অক্সফোর্ডে রচনার কাছে আসে। রচনা তাকে নিজের গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্তীকৃত করে নেয়। বেশ অমায়িক ছেলে হামিদ। বাবা সংসদ সদস্য ছিলেন।
হামিদ রচনার কোয়ার্টার্সে ড্রাইভার-রুমে থাকত। এই ফাঁকে প্রেম হয়ে যায় নিনির সঙ্গে। বেশ ভালো প্রেম। অতঃপর বিয়ে।
নিনি এখন মিসেস খান।
নিনি তুমি – – -।
আমার কথা শেষ হওয়ার আগে রুমে ঢুকল আল্পনা আর শ্যামস। আমি এসেছি জেনে ব্রিস্টল থেকে চলে এসেছে। শ্যামস খাঁটি ভারতীয় কায়দায় পা ছুঁয়ে শ্রদ্ধা জানাল।
কী ব্যাপার শামসু, তুমি তো পুরো ভারতীয় হয়ে গেছ।
হেসে বলল, বউয়ের স্বভাব স্বামীতে, দাড়ির শোভা জামিতে।
বাহ!