সন্মিত্রা: সপ্তদশ পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
ম্যামকে রিং করি?
করো। লাউড স্পিকার অন করে দাও।
আল্পনা বলল, ভাব্বা, ম্যামকে আনেন না কেন?
বললাম, “আনব।” কিন্তু আনি না কেন তা আর বলছি না। বলা সম্ভবও নয়। সবকিছু সবাইকে বলা উচিত নয়। ঋধিতার প্রতি তাদের অনেক সম্মান।
কখন আনবেন? আল্পনার পরের প্রশ্ন।
ছেলেমেয়েদের দেখতে হয়। অনেক কাজ। তুমি সংসার করছ। বুঝো-না?
কল্পনার রুম থেকে বের হয়ে আমি আর রচনা অন্য রুমে চলে গেলাম। ঋধিতাকে রিং করল রচনা, ম্যাম, আমি রচনা।
কেমন আছ?
আপনার আশীর্বাদে ভালো আছি।
তোমার ভাইবোন?
সবাই ভালো।
তুমি কী চাও?
আপনার স্নেহ, ভালোবাসা এবং দয়া।
তুমি কোনোটাই পাবে না।
আমার দোষটা কী?
আমার স্নেহ পাওয়ার যোগ্যতা তোমাদের নেই। পরের খেয়ে বড়ো হয়েছ। যারা পরের খেয়ে বড়ো হয় তারা স্নেহ-ভালোবাসা পেতে পারে না। তোমরা পরভোজী, পরাশ্রয়ী এবং পরগাছা।
ঠিক বলেছেন ম্যাম। আমরা ঈশ্বররূপী একজন আশ্রয়দাতার দয়ায় বড়ো হয়েছি। আমরা পরভোজী, পরাশ্রয়ী এবং পরগাছা। তিনি না থাকলে আমাদের স্থান হতো বস্তিতে। আনত হওয়া ছাড়া আর কোনো প্রতিদান দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের নেই।
তোমার মনুষ্যরূপী ঈশ্বর কে?
আমার স্যার; মানে ভাব্বা। আপনার স্বামী।
তোমার ভাব্বা কোথায়?
বাংলাদেশেই তো।
তুমি কীভাবে জানো?
না, মানে তিনি তো বাংলাদেশেই থাকেন। তাই বলছি।
তিনি এখন লন্ডন। তুমি জানো না।
কখন এসেছেন?
রিং করো তাকে। হোটেলে উঠেছে মনে হয়। হোটেলে উঠলে তার খাওয়া-দাওয়ার ঠিক-ঠিকানা থাকে না। একটা অপদার্থ, গর্দভ। এজন্য একা কোথাও যেতে দিতে ইচ্ছে করে না। সারাক্ষণ টেনশনে থাকতে হয়। হোটেলে উঠলে ঘাড় ধরে নিয়ে যাবে তোমার বাসায়। দুটো থাপ্পড় দেবে আমার পক্ষ থেকে। দেবে তো?
আচ্ছা।
তুমি মনে হয় তার লন্ডনের মোবাইল নম্বর জানো না।
আগের নাম্বার আছে না?
নেই।
লিখে নাও।
বলুন।
শোনো মেয়ে, তোমার স্যারকে হোটেলে থাকতে দেবে না। বাসায় নিয়ে যাবে। গোসলটা করতে বলবে। পিঠটা ভালোভাবে ঢলে দিও। সে বিড়ালের মতো, সহজে গোসল করতে চায় না। এমন জঞ্জাল আর দেখিনি। জল দেখলে জলাতঙ্ক রোগীর মতো আঁতকে ওঠে। হোটেলে থাকলে আজেবাজে খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়বে। মনে থাকবে তো আমার কথা?
আপনি সত্যি মহান, প্রশংসার যোগ্য।
আমি প্রশংসার জন্য কিছু করি না। তৃপ্তির জন্য করি। আমি কিন্তু খুব স্বার্থপর, মনে রেখো। স্বার্থ ছাড়া কিছু বুঝি না। যারা সবার প্রশংসা পাওয়ার জন্য কিছু করে, পক্ষান্তরে তারা কিছুই করে না এবং কিছুই পায় না। এমন কাজ লেজুড়বৃত্তি ছাড়া কিছুই নয়। তুমি আমার প্রশংসা করছ, কিন্তু তোমার ভাব্বা মনে করে, আমি তার শত্রু। সে এত জ্ঞানী, এত কিছু বোঝে, কিন্তু আমার মনটা বোঝে না। এ কেমন মানুষ মা, তুমিই বলো। এজন্য বলদ ডাকি।
ভাব্বা তো আপনাকে খুব ভালোবাসেন।
কে বলেছে?
তাই আপনার সামান্য অবহেলাতেও রেগে যান।
সেটা তো আমার ক্ষেত্রেও হতে পারে। পারে না?
আমি বুঝি।
তুমি কীভাবে বুঝবে? তোমার তো স্বামী নেই। থাকলে বুঝতে স্বামীর অবহেলা এবং বউকে ছেড়ে অন্য মেয়ে নিয়ে ফষ্টিনষ্টি করা কত ভয়ংকর।
এমন হলে খুব কষ্ট লাগে।
নিজের জীবনে না-ঘটা পর্যন্ত কোনো ঘটনাই কষ্টের নয়। বরং রসিয়ে রসিয়ে আলাপের বিষয় মনে হয়। নইলে তোমরা ভাব্বাকে নিয়ে এত আহ্লাদ করো কেন? কেন আমাকে এত কষ্ট দাও।
ম্যাম, তিনি আমাদের ঈশ্বর, আমাদের পিতা, আমাদের বর্তমানের নির্মাতা। তিনি আমাদের সবকিছুর উৎস। আমরা তার পরগাছা। তিনিই আমাদের জীবন। তাকে ছাড়া আমরা বাঁচব কীভাবে?
কথা তো শিখেছ, কিন্তু তোমার ভাব্বা উঠল কোথায়? এ খবরটা তো নিলে না। আর তিনি যদি তোমাদের এতই ভালোবাসে, জানাল না কেন? লোকটা সুবিধার নয়, ভণ্ড। আজকের মধ্যে খুঁজে বের করো। আমাকে টেনশনে রেখো না। তুমি অনেক ভালো মেয়ে, আমি যা মুখে আসে বলে ফেলি, রাগ করলেও কিছু যায় আসে না, বুঝলে? শোনো…।
লাইন কেটে গেছে না কি কেটে দিল বোঝা গেল না। রচনা আবার রিং করতে চাইল। আমি নিষেধ করলাম। কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে এল।
ম্যামের সঙ্গে কী কথা হয়েছে আপু? তাঁকে আসতে বলেছেন? আল্পনা জানতে চাইল।
আমার দিকে তাকাল রচনা।
তার মুখে তৃপ্তি। তা রাশি রাশি হাসি হয়ে উছলে পড়ছে বৃষ্টির মতো। আজ হাসিটা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ প্রাণবন্ত এবং প্রদ্যোতময়। দশ হাজার খারাপের মধ্যে একটি ভালো থাকলে ওটিই তার কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে। এমন যাদের মন, দুখ তাদের কাছেই ঘেঁষতে পারে না।
জুসের খালি গ্লাসটা টেবিলে রাখতে রাখতে বলল, শুনলেন, দেখলেন তো স্যার, ম্যাম আপনাকে কেমন ভালোবাসেন।
তা ঠিক।
আপনি ভাগ্যবান। অসাধারণ একজন স্ত্রী পেয়েছেন। এজন্য তাকে আমি শ্রদ্ধা করি। তার কোনো কথা যতই আপাতশ্রবণে খারাপ মনে হোক, আমি তার প্রত্যেকটি শব্দ তার অবস্থানে থেকে বিবেচনা করি।
তোমাকে কী বাজে কথাটাই না বলল।
আমার মা আরও বেশি খারাপ কথা বলতেন। এটি আদর। আমি এটি দেখব কেন স্যার? অনেকগুলো ভালো কথা বলেছেন। সেগুলোর কী হবে তাহলে?
কিন্তু মাঝে মাঝে এমন মন্তব্য করে বসে যে, মনটাই খারাপ হয়ে যায়।
রচনা বলল, ভালো ভালোই। তবে সবসময় ভালো ভালো লাগে না। কৃষ্ণচূড়ার মাথা যদি সারা বছর লাল থাকত, তাহলে ওই লাল সাধারণ হয়ে যেত। এমন লাল কাউকে লালাভ করতে পারত না। তাই ম্যাম আমার কাছে এত শ্রদ্ধার। তিনি স্পষ্টবাদী, তিনি সহজ এবং সরল। গভীরতা আছে কিন্তু ঘোলা নয়, তাই সব দেখা যায়। পরিষ্কার মন আয়নার মতো।
তোমার ম্যামকে আবার রিং করে বলো, স্যার আমার বাসায় এসেছেন। তারপর বুঝবে, কী অবস্থা সে করে।
সে তো করবেনই।
কেন?
তিনি যদি জানতে পারেন আমরা তার সঙ্গে মিথ্যা বলেছি, রাগ করবেন না? যে কেউ এমন করবেন।
কল্পনা বলল, তোমরা কে কোন পক্ষ?
পক্ষ মানে?
ম্যামের পক্ষে না কি ভাব্বার পক্ষে?
আল্পনা, কল্পনা আর টুটুল বলল, আমরা ভাব্বার পক্ষ।
রচনা বলল, আমি ম্যামের পক্ষে।
কেন? কল্পনা বলল।
কারণ তিনি ভাব্বাকে ভালোবাসেন।
“ভাব্বা”, আল্পনা বলল, “ আপনি কোন পক্ষ?
নিরপেক্ষ।
নিরপেক্ষ থাকলে সবপক্ষের রোষানলে থাকতে হয়। কোনো একটা পক্ষ নিলে অন্তত একটা শত্রু কমবে। রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটলে উভয় পাশের গাড়ির ধাক্কা খাওয়ার শঙ্কা থাকে। এজন্য মধ্যপন্থিদের মদমত্ত পক্ষ বলা হয়। এরা সাধারণত বোধশোধহীন হয়। স্বকীয়তা বলে কিছু থাকে না। উভয়পক্ষের করুণার ওপর নির্ভর করে বাঁচতে হয়।