Warning: Constant DISALLOW_FILE_MODS already defined in /home/draminb1/public_html/wp-config.php on line 102

Warning: Constant DISALLOW_FILE_EDIT already defined in /home/draminb1/public_html/wp-config.php on line 103
সন্মিত্রা : এক মলাটে সন্মিত্রা: সন্মিত্রা সম্পূর্ণ উপন্যাস : প্রথম থেকে শেষ পর্ব – Page 18 – Dr. Mohammed Amin

সন্মিত্রা : এক মলাটে সন্মিত্রা: সন্মিত্রা সম্পূর্ণ উপন্যাস : প্রথম থেকে শেষ পর্ব

সন্মিত্রা:  অষ্টাদশ / ড. মোহাম্মদ আমীন

রচনা ম্যাম আছেন?
রিসিভার তুলতে ভেসে এল নারীকণ্ঠ। রচনা কাছে ছিল না, ওয়াশরুমে। আসা পর্যন্ত রিং বাজবে না। তাই রিসিভার আমাকে তুলতে হলো। এমনই রেওয়াজ। আমি তাদের বাসার সর্বজ্যেষ্ঠ সদস্য এবং প্রধান অভিভাবক।
হ্যালো, রচনা এ মুহূর্তে টেলিফোনের কাছে নেই।
আপনি নিশ্চয় ম্যামের ভাব্বা।
হ্যাঁ। আপনি?
নমস্কার, স্যার। আপনি কেমন আছেন?
নমস্কার।
স্যার, আমি প্রমিতা দাশ লাবণী।
কোন লাবণী?
যাদবপুর ইউনিভার্সিটির লাবণী।
সেই মুগ্ধকরঅসমসাহসিকা সুন্দরী প্রমি?
হাসি দিয়ে উত্তর দিল প্রমিতা।
কেমন আছ?
ভালো।
কিছু বলবে?
স্যার, আমি পিএইচডি করতে চাই।
কোথায় করবে?
অক্সফোর্ড।
আমি কি তোমাকে কোনো হেল্প করতে পারি?
রচনা ম্যামকে যদি বলেন।
বলব।
ম্যাম কোথায়?
কিছুক্ষণ পর রিং করো। তোমার ম্যাম এখন ওয়াশরুমে।
যদি অনুমতি দেন, তাহলে বাসায় আসতে পারি ।
কথার মধ্যে রচনা চলে এল, তোমার ফোন।
কে?
প্রমিতা।
রচনার দুহাতে কাপড়। আমি নিজের হাতে রিসিভারটা তার মুখে লাগিয়ে দিতে গেলাম, কথা বলো।
কে?
প্রমিতা।
কলকাতার প্রমিতা?
হ্যাঁ। তোমার স্মরণশক্তি তো অসাধারণ।
অক্সফোর্ডে থাকলে বাসায় চলে আসতে বলুন। অনেক ভালো মেয়ে, ব্রিলিয়ান্ট, সাহসী এবং উদার। সে না থাকলে কলকাতা বস্তিতে আমাদের কী অবস্থাটাই না হতো। এর আগেও কয়েকবার রিং করেছে। মিশুও করেছে।
তুমি কোথায়? প্রমিতাকে প্রশ্ন করলাম।
অক্সফোর্ড।
এখানে কেন?
বড়ো ভাইয়ের সঙ্গে বেড়াতে এসেছি।
চলে এসো বাসায়। তোমার ম্যামের অনুমতি মিলেছে। ঠিকানা জানা আছে?
ম্যামের ভিজিটিং কার্ড আছে আমার কাছে।
এক ঘণ্টার মধ্যে চলে এলো প্রমিতা। আগের চেয়ে সুন্দর দেখাচ্ছে। চোখ দুটো আরও বুদ্ধিদীপ্ত এবং প্রত্যয়ী মনে হলো। তার সুন্দরে সুন্দরের সংজ্ঞার্থ অন্যভাবে বিন্যস্ত হয়েছে।
প্রমিতা বাঙালি— এটি শুনে বাসার সবাই আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। কোনো বাঙালি বেড়াতে এলে অক্সফোর্ডের বাসার বাঙালিদের মন বাংলামেখলায় অনিন্দ্য হয়ে উঠে। গৃহটা হয়ে যায় নদীমাতৃক বাংলাদেশের ভাটিয়ালি গান।
প্রমিতাকে দেখে আল্পনা বলল, ওমা এ তো দেখি আমাদের কল্পু সোনার ফটোকপি। কি গো বালিকা, এতদিন আসনি কেন? কী মিস করলাম অজানারে।
প্রমিতা বলল, আমি তো দিদি কলকাতা থাকি।
রচনা বলল, তুমি কোন বিষয়ে কী নিয়ে পিএইচডি করতে চাও?
সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্র; আমি সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রী কি না।
নাম ঠিক করেছ?
সব ঠিক করে নিয়েছি বলে রচনার হাতে নীল প্রচ্ছদে ঢাকা লিগ্যাল সাইজের একটা খাতা দিয়ে বলল, ম্যাম এটাই আমার রিসার্চ প্রপোজাল।
কিছুক্ষণ উলটে-পালটে দেখে রচনা বলল, হয়নি।
আমি বললাম, এককথায় নাকচ করে দিলে?
অনেক দুর্বলতা আছে। এই ব্যাখ্যা দিয়ে অক্সফোর্ডে পিএইচডি করা যাবে না। বৃত্তি পাওয়া দূরে থাক। দেখামাত্র বাতিল করে দেবে।
মনটা খারাপ হয়ে গেল প্রমিতার। বরফ ধবল নতুন জামায় যেন কেউ কালো রং ছুড়ে দিয়েছে। তার এমন পরিবর্তন দেখে মনটা আমার খারাপ হয়ে গেল। সুন্দরী মেয়েদের অসুন্দর মুখ দেখলে আমার ফুরফুরে মনটাও ঝুরঝুরে হয়ে যায়। সহানুভূতির চোখে তার দিকে তাকালাম। বুদ্ধিমান মেয়ে। আমার মনোভাব বুঝে নিতে বিলম্ব হলো না।
স্যার কী করব এখন? আমার কাছে এসে মলিন মুখে কানে মুখ লাগিয়ে বলল, ম্যামকে একটু বলুন-না, ভাব্বা।
তুমি কতদিন আছ?
এই কাজের জন্য যতদিন থাকতে হয়।
বৃত্তি না পেলে নিজের টাকা দিয়ে পড়তে পারবে?
পারব।
তুমি প্রতিদিন দুপুরে চলে এসো বাসায়। আমি বলে দেব কীভাবে লিখতে হয়?
পায়ে ধরে শ্রদ্ধা জানিয়ে চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতে রচনা বলল, খেয়ে যাবে।
প্রমিতা সোফা থেকে দাঁড়িয়ে বিনয়ের সঙ্গে বলল, আর একদিন।
কথার ওপর কথা বলো কেন? বললাম— খেয়ে যেতে, খেয়ে যাবে; ব্যাস। আমরা পশ্চিমবঙ্গের নই, বাংলাদেশের।
এই প্রথম রচনার প্রফেসর-মেজাজ দেখলাম। অবাক হয়ে তার দিকে তাকাতেই লজ্জিত হয়ে বলল, “সরি, ভাব্বা। মাস্টারি করতে করতে সবাইকে শিক্ষার্থী মনে হয়।”
প্রফেসরের প্রফেসর মেজাজ না-হলে মানায় না।
আমার কথা শেষ হওয়ার পর প্রমিতার দিকে তাকিয়ে রচনা বলল, কী বলেছি শুনেছ?
এত কড়া সৌহার্দ এড়াতে পারল না প্রমিতা। খুশিতে প্রফুল্ল হয়ে গেল তার বিষণ্ন মুখ। আমি অবাক হয়ে গেলাম রচনার আতিথেয়তা দেখে। এমন সহার্দিক আহ্বান আর কোনোদিন কারও মুখে শুনিনি। প্রমিতা দুজনকে আবার পা ছুঁয়ে শ্রদ্ধা জানাল।
চুপ করে আছ যে? রচনা বলল।
“ম্যাম”, প্রমিতা বলল, “আপনার আদেশ আমার আশীর্বাদ।”
দাঁড়িয়ে কেন?
প্রমিতা বসতে বসতে বলল, আপনার আতিথেয়তা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
আল্পনা বলল, আজ যেতেই পারবে না দিদি। আমাদের বাংলা গল্প শোনাতে হবে। কল্পনা এলে বুঝতে পারবেন, আড্ডা কী জিনিস!
বলতে না বলতে কল্পনা চলে এল। প্রমিতাকে দেখে মহাখুশি।
প্রমিতা রচনার দিকে তাকাল।
রচনা বলল, রাতটা আমাদের সঙ্গে থেকে যাও। ওরা খুব খুশি হবে। বাংলায় কথা বলা, বাঙালির সঙ্গে কথা বলতে পারার মজা কত বেশি, আমরা বুঝি। তুমি বুঝবে না।
আল্পনা বলল, বাতাসের সমুদ্রে ডুবে আছি বলে বুঝি না, বাতাস কত প্রয়োজনীয়। নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য যখন হাসপাতালে যেতে হয় তখন বোঝা যায়। এতদিন বাংলাদেশে বাংলায় ডুবে ছিলাম বলে বুঝতে পারিনি বাংলা কত অনিবার্য। নিজের মায়ের অভাব যেমন অন্য কারো মা দিয়ে পূরণ যায় না, তেমনি কোনো বিদেশি ভাষা দিয়ে পূরণ করা যায় না মাতৃভাষার অভাব। যত দামি দুগ্ধই হোক না, তা কি মাতৃদুগ্ধের তুল্য হয়? ওসব খেয়ে ফার্মের পশুরু মতো চর্বি আর মাংসপুষ্ট অথর্বের কাতারে ভোগীদের লালসা টানা যায়,  চঞ্চল আর উদার রূপময়তায় ভরা আত্মমর্যাদাঋদ্ধ অনাবিল শান্তি পাওয়া যায় না।
আমি প্রমিতাকে উদ্দেশ করে বললাম, এই মেয়ে তোমার বড়ো ভাইকে বলে দাও, তিনিও রাতে খাবেন আমাদের সঙ্গে। খেয়েদেয়ে তিনি চলে যাবেন এবং তুমি থেকে যাবে।
রচনা বের হয়ে যাওয়ার পর প্রমিতাকে বললাম, এই মুহূর্ত থেকে কাজ শুরু করতে হবে। আমি কিন্তু বেশিদিন থাকব না।
আগে বিষয়টাকে আরও সুনির্দিষ্ট করে নাও।
আল্পনা, কল্পনা, টুটুল, প্রমিতা এবং আমি মিলে বিষয় ঠিক করে নিলাম।
পিএইচডি থিসিসের নাম হবে, The effects of Religious beliefs on individuals, families, states and human beings.
বেশ পছন্দ হয়ে গেল প্রমিতার।
এবার প্রস্তাবনা প্রস্তুত করার পালা। ভূমিকা লিখে দিতে হবে আমাকে। আমি বাংলায় লিখব। টুটুল আর প্রমিতা ইংরেজি করবে।
টুটুল বলল, তাহলে আমাদের গল্পের কী হবে?
গল্প তো হবে। তো প্রমিতা যদি ভর্তি হয়ে যেতে পারে তাহলে প্রতিদিন বাংলা গল্প শুনতে পারবে।
তবে তাই হোক।
আমি ভূমিকা লিখতে বসে গেলাম। প্রমিতা মন দিল তার থিসিস প্রপোজালে।
টুটুল একটা বই নিয়ে পড়া শুরু করল। বাংলা নয়, ইংরেজি বই। এখন এরা বাংলা ভালো বোঝে না। কিন্তু পড়তে পারে এবং বলতেও পারে। রাজ ও রোজি বাংলা প্রায় ভুলে যেতে বসেছিল। রচনার জন্য পুরোটা ভুলতে পারল না। বাসায় বাংলা বাধ্যতামূলক। তারা ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বলতে পারে, কিন্তু লিখতে পারে না। বাসার বাইরে গেলে বাংলা বলার সুযোগ থাকে না। বাসায় আর কতক্ষণই বাংলা হয়। বইগুলো সব ইংরেজিতে। ঘুমে তো বাংলা হয় না, স্বপ্নও দেখে ইংরেজিতে। তাই না ভোলাটাই কষ্টকর।
হয়ত অচিরে ভুলে যাবে সব।
ভুলে যাবে তারা একসময় বাংলাদেশি বাঙালি ছিল।