সন্মিত্রা: ঊনবিংশ পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
কান্না শুনে দৌড়ে বের হলেন মাদার মারিয়া। চোখেমুখে বিরক্তি। তিনি মানুষের ব্যথায় কাতর হন, তবে কান্না সহ্য করতে পারেন না।
মাদার মারিয়া স্লাম ডেভেলাপমেন্ট অর্গনাইজেশন-এর খ্রিষ্টান কমিউনিটির শিশু বিভাগের দায়িত্বে আছেন। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। চিকন, লম্বা; খুব ধীরস্থির এবং বিচক্ষণ। রচনা এই অর্গানাইজেশনেই পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড দান করেছিল। সংস্থাটি অজ্ঞাত পরিচয় ও হতদরিদ্র পরিবারের সদস্যদের মৃতদেহের সৎকারের কাজও করে থাকে। রচনা সপ্তাহে কমপক্ষে একদিন এখানে অফিস করে। সে এর লন্ডন শাখার প্রধান। প্রতিষ্ঠানটি তার খুবই প্রিয়। এর মাঝে সে নিজের অতীতকে বর্তমানে দেখতে পায়।
মারিয়া ধর্ম আর নীতিতে খুব কড়া। মাদার তেরেসার প্রবল ভক্ত। তাঁর কঠিন মতবাদ প্রকৃতি আর ঈশ্বরকে পৃথক করে দেখে না। তিনি মনে করেন, প্রকৃতি যাই করুক না কেন প্রকৃতির উপাদান হিসাবে মানুষের তা সানন্দে মেনে নেওয়া উচিত। মেনে নিতে পারে না বলে প্রকৃতিকে মানুষ নিজের সুবিধামতো সাজাতে যায়। ফলে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ে; ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে প্রকৃতি। মারিয়া মনে করেন, বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক বিরূপতার এটাই প্রধান কারণ।
মারিয়ার মনে ভালোবাসা প্রবল, কিন্তু এমন প্রকৃতিভক্ত যে, প্রকৃতির ইচ্ছাই তাঁর কাছে সবার চেয়ে বড়ো। তাঁর মতে, প্রকৃতিই জীবের লালনভূমি এবং প্রকৃতিকে লালন করার জন্য ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছেন। মানুষের একমাত্র ইবাদত প্রকৃতির সেবা। কারণ প্রকৃতি ঈশ্বরের প্রতিভূ এবং প্রকৃতির দাসত্ব করার জন্য মানবজাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে। দাস যদি প্রভুর ওপর প্রভুত্ব ফলাতে চায় তাহলে বিপর্যয় অনিবার্য।
মারিয়াকে দেখে অনেকে কান্না থামিয়ে দিলেন। কিন্তু ওয়েল্যান্ড এবং তার স্ত্রী আকিয়ারা কান্না থামাতে পারলেন না। তাদের সন্তান বেনেজিরো মারা গেছে।
ওয়েল্যান্ড সোমালিয়ান আকিয়ারা চায়নিজ। দুজনে ঝাড়ুদার। প্রতিদিন কাজ পান না। তাই প্রতিদিন খেতেও পারেন না। ধনী দেশে ধনী না হওয়ার কষ্ট গরিব দেশের গরিবদের চেয়ে অনেক বেশি। ধনী দেশে ধনী-গরিবের তফাতটাও বেশি। যেখানে ঐশ্বর্য বেশি সেখানে সামান্য কারণও অনেক ভয়ংকর মনে হয়।
আমার মন্ত্রী মহোদয়ের সামান্য জ্বর হলে সিঙ্গাপুর চলে যান। যে দেশের রাষ্ট্রপতিকে নিজের চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে হয়, যে দেশের চিকিৎসালয়ে ওই দেশের রাষ্ট্রপতি চিকিৎসা করাতে ভরসা পান না, সে দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা কত দুঃসহ তা বলা বাহুল্য।
ওয়েল্যান্ড দম্পতি সোমালিয়ান এক ব্যবসায়ীর বাড়ির গ্যারেজের পাশে একটা কুঁড়ে বানিয়ে থাকেন। আকিয়ারা চীনের ইউনান প্রদেশের মহিলা। প্রেমে পড়ে দেশ ছেড়েছেন। লন্ডন এসে প্রেমিক তাকে ছেড়ে সোজা শিকাগো। তারপর আর খবর নেই। প্রেমের মরা জলে ডোবে না। ভেসে ভেসে প্রেমিকাকে ছেড়ে আটলান্টিকের ওপারে চলে যায়। আকিয়ারা এখন বলে— যদি কোনো মানুষ হাজার জন্ম পাপের পর পাপ করে তাহলে ঈশ্বর তাকে শাস্তিস্বরূপ প্রেমে ফেলে বিয়ে পড়িয়ে দেন।
কী আর করা, প্রেমিকপ্রবর শিকাগো চলে যাবার পর আকিয়ারা আশ্রয়ের জন্য সোমালিয়ান ওয়েল্যান্ডের সঙ্গে বিয়ে বসে যান। ভালোই চলছিল দিন। কিন্তু ওয়েল্যান্ড যা আয় করতেন তার পুরোটাই অ্যালকোহলে শেষ করে দিতে থাকেন। এরপর একদিন অ্যালকোহলই তাকে শেষ করে দিল। ভারী কাজ করা সম্ভব হচ্ছিল না। বাধ্য হয়ে ঝাড়ুদার। তারপর থেকে অভাব নিত্য সহচর হয়ে যায়।
তাদের ছেলেটা আজ বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে।
যেখানে থাকত সেখানকার প্রতিবেশীরা লাশ নিয়ে এসেছে। অন্তত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াটা বিনামূল্যে করতে পারবে। গরিবের প্রতিবেশীরাও গরিব হয়। ধনী হলে আরো কষ্ট। ওপর থেকে শুধু উচ্ছিষ্ট আর ঘোলাজল পড়ে। যদিও উচ্ছিষ্টের সঙ্গে কিছু খাওয়ার জিনিস থাকে, কিন্তু ওই জিনিস নিচে আসে বীজাণু নিয়ে।
মারিয়া বললেন, কান্না বন্ধ করো। প্রকৃতিবিরুদ্ধ আচরণ ঠিক নয়।
মাদার, আমরা কী প্রকৃতিবিরুদ্ধ আচরণ করলাম? আকিয়ারা বললেন।
মৃত্যু প্রকৃতির অনিবার্য অংশ। কেউ এটাকে এড়িয়ে যেতে পারে না। প্রকৃতির সবচেয়ে প্রিয় জিনিস হচ্ছে বিনাশ। প্রকৃতি সবসময় রূপসি, সবুজ এবং সজীব থাকতে চায়। তাই সে পাণ্ডুর আর পাংশুটেদের বিনাশ করে দেয়। আমরা যেমন ফেলে দিই পুরানো আর অকেজো জিনিস। ছেলেটা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ, কষ্ট পাচ্ছিল। তাই প্রকৃতি তাকে ভালোবেসে নিয়ে গেল। আর তোমরা শোক প্রকাশ করে প্রকৃতিকে অভিসম্পাত দিচ্ছ। এটা কি প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজ নয়?
এটি সহমর্মিতা।
এমন সহমর্মিমতা ঈশ্বরবিরুদ্ধ। কান্না বন্ধ করো।
দলনেতা ড্যাফার বললেন, শোকের কান্না ইচ্ছা করে থামানো যায় না।
মাদার মারিয়া বললেন, শোক আর সহমর্মিতা এক নয়। সহমর্মিতা, করুণ পরিণতি প্রতিহত করার জন্য মর্ম-মমতায় এগিয়ে আসে। ছেলেটা যখন রোগে ভুগছিল তখন তোমরা কেউ এগিয়ে আসনি। চিকিৎসার অভাবে ছেলেটা কষ্ট পাচ্ছিল, তার মা-বাবাও কষ্ট পাচ্ছিল। তোমাদেরও ভালো লাগছিল না। তাই প্রকৃতি তাকে নিয়ে গেছে তার কাছে। এখন লাশ নিয়ে এসেছ পুণ্যের আশায়। শোক প্রকাশে তো আর পয়সা খরচ করতে হয় না। মৃত্যু যেহেতু অনিবার্য, সেহেতু তার মৃত্যুকে ভালোভাবে মেনে নেওয়া উচিত। তোমরা তাই করো, প্রকৃতিকে ধন্যবাদ দাও। ঈশ্বরকে বলো, ঈশ্বর আপনি যাই করেন ভালোর জন্য করেন।
তাই বলে কী মৃত্যুকে বরণ করে নেব? ড্যাফার বললেন।
না বরণ করে উপায় নেই। তোমরাই তো লিখো আর বলো—“মৃত্যুবরণ।” জীবন সুন্দর। এই সুন্দরকে যাতে দীর্ঘ সময় উপভোগ করা যায় তার সর্বাত্মক চেষ্টা করা উচিত। সুন্দর থেকে সুস্থ থেকে প্রকৃতিকে খুশি রেখে তা করতে হবে। অসুন্দর প্রকৃতিবিরুদ্ধ। প্রকৃতি এদের রাখবে কেন?
ড্যাফার বললেন, আমরা কী দোষ করেছি?
কারও মৃত্যুতে শোকের আড়ালে সুখ প্রকাশ করে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা উচিত নয়, যাতে প্রকৃতির প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ পায়। এতে প্রকৃতির প্রতি অবিচার করা হয়। তোমরা এমন কাণ্ড করছ যেন বেনেজিরো ছাড়া আর কেউ মরবে না। এসো, আমরা শোকের বদলে, সর্বান্তকরণে বেনেজিরোর বিদেহের শান্তি কামনা করি। তবে সবচেয়ে খুশি হতাম যদি ছেলেটাকে মরার আগে আমার কাছে নিয়ে আসতে।
চিৎকার আর চ্যাঁচামেচি শুনে রচনা বেরিয়ে এল। তার সঙ্গে আমিও।
রচনাকে দেখে মারিয়া নিচু গলায় বললেন, দেখুন ম্যাম ওরা কাঁদছিল।
“কাঁদতে দিন”, রচনা বলল, “পরিবেশ আর ব্যক্তির ক্ষতি না হলে কারও স্বাধীনতায় কখনো হস্তক্ষেপ করবেন না।”
এমন শোক করা কী ঠিক?
কেন ঠিক নয়?
ধর্মে নিষিদ্ধ।
নিষিদ্ধ কেন?
ঈশ্বর কী মনে করবেন? তাদের কান্নায় প্রকৃতি কষ্ট পাচ্ছে। ঈশ্বর এমন শোক প্রকাশ করতে নিষেধ করেছেন, যে শোক তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধাচারণের মতো হয়।
রচনা বলল, মাদার মারিয়া, কান্না কিন্তু শোক নয়।
তাহলে ম্যাম এটা কী?
প্রকৃতির অজেয় শক্তির স্বীকৃতি। মানুষ যে প্রকৃতির কাছে অসহায়, কান্না এটাই প্রমাণ করে। তাই না কাঁদলে বরং প্রকৃতিবিরুদ্ধ আচরণ হবে। এদের কান্না প্রকৃতিকে দয়ার্দ্র করবে, সিক্ত করবে। প্রকৃতি তুষ্ট হবে।
রচনার কথা শুনে মারিয়া খুব খুশি হলেন।
বললেন, ম্যাম, আপনি অনেক বড়ো দার্শনিক।
রচনা ড্যাফারকে ডেকে বললেন, আপনাদের এলাকায় এরকম দরিদ্র আর কোনো পরিবার আছে?
আছে।
তাদের তালিকা দেবেন।
দেব।
তালিকা পেলে ভবিষ্যতে এমন অবাঞ্ছিত মৃত্যু যাতে না হয় সেই চেষ্টা করব।
তাই হবে।
সবার সহযোগিতাই হচ্ছে কার্যকর কল্যাণ।
মারিয়া বললেন, আমিও এটা বলি ম্যাম।
রচনা সমবেতদের বলল, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ করে নিন। মিস্টার ড্যাফার?
ইয়েস, ম্যাম।
আপনি যাবার সময় আমার সঙ্গে দেখা করে যাবেন। সঙ্গে বেনেজিরোর মা-বাবাকে নিয়ে আসবেন।
মারিয়া বললেন, প্রকৃতি এবং ঈশ্বর আপনাদের এমন সজীব রাখুন, যাতে কাউকে প্রকৃতির অবহেলার স্বীকার না হতে হয়। পরিবেশকে ভালোবাসুন। সে আপনাকে প্রেম দেবে, উষ্ণতা, শিশু দেবে।তার প্রতি কদাচার করবেন না।