সন্মিত্রা: দ্বিতীয় অধ্যায় / ড. মোহাম্মদ আমীন
“চলুন?” রচনা ছাদে উঠে আমাদের কাণ্ড দেখে থমথমে গলায় বসন্তবিষণ্ণ আবদার ঢেলে বলল, “রাত কম হচ্ছে না কিন্তু।”
কেউ তার কথার প্রত্যুত্তর দিল না। সেও কিছু মনে করল না। আমি এলে সবাই এমন ইচ্ছেস্বাধীন হয়ে যায়। এখানে এখন বসন্ত। হাওয়ায় হাওয়ায় মানুষের হাসি প্রকৃতির সাজে গিয়ে নূপুর। কল্পনা, টুটুল এবং রাজ-রোজি আমাকে জড়িয়ে থাকা কাঁঠাল বোটার কোষ-থোকা। রচনা থোকার চারদিকে একবার ঘুরে এল। ফাঁক নেই ঢোকার। মাথার দিকে গিয়ে ঝুঁকে-বসে বলল, “ভাব্বা, অনেক রাত হয়ে গেল। আপনার সর্দি লেগে যাবে। চলুন, বাসায় ঢুকে পড়ি।”
“আমরা আজ বাসায় যাব না ”, রাজ বলল, “মাথার ওপর ছাতা আছে না?”
রোজি সমর্থন দিল, মাম, আজ ছাদেই থাকি? কী হবে? দারুণ লাগছে। বাসায় তো প্রতিদিন থাকি। ড্যাড আছে-না? উনি তো কাল চলে যাবেন। ”
ঠান্ডা লাগবে যে?
“উষ্ণতা দিচ্ছি-না ভাব্বাকে?” কল্পনা আমাকে রাজ-রোজি-সহ আরও জোরে জড়িয়ে ধরে বলল, “সর্দি লাগবে না। নিজে জায়গা পায়নি তাই ঈর্ষা, বুঝি-না!”
রাত হয়েছে ঠিকই। তবে পুরো শহর আলোয় আলোয় দিন। সূর্য ডোবার খপ্পড়ে অক্সফোর্ডও পড়ে, কিন্তু রাত আসে না কখনো। ছোটো একটা জীবন— এক সেকেন্ডও অবহেলায় হেলা করে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ইউরোপীয়ানরা এটি খুব ভালো বুঝে। তাই প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করে। এমনকি মৃত্যুশয্যার ভয়ঙ্কর ক্ষণগুলোও। মানুষের অর্ধেক জীবন চলে যায় ঘুমে। কী করুণ!
“তুমিও আসো”, আমি রচনাকে ডাকলাম, “এই যে এদিকে।”
“জায়গা তো নেই”, একদম ছোটো শিশুর মতো প্রফেসর রচনা অসহায় গলায় মলিন মুখে বললেন, “বিচ্ছুগুলো আপনার সব পাশ দখল করে নিয়েছে। আমার জায়গায় কোথায়? এখন আমার কী হবে? ”
“মাথার দিকে এসো।” সে আমার ডাকের অপেক্ষায় ছিল। দ্রুত চুলমাথা এলিয়ে দিল আমার মুখে। তার চুল আমাদের মুখ-মাথা নিশীথ করে দিল। আমি সবার মাঝখানে। পারিবারটা কাঁঠাল — তারা কোষ আমি বোটা। আন্তরিকতার এমন প্রাণোচ্ছ্বল প্রশান্তির গভীরতা অবর্ণনীয়। অনুভূতির পরমার্থতা সর্বদা কথায় বোঝানো যায় না বলে চুমো আর শিহরনের মতো শব্দ ব্যবহার করতে হয়।
স্নেহের গন্ধ মমতার কালি হয়ে পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় কবিতার সুভাস রচে যাচ্ছে নিবিড় মৌনতায়। এতদিন খেয়াল করিনি এমন চুলের বাহার। এ চুলকে ঘিরে কত কবির কত কবিতা, কত বাণী। নজরুল কী মমতায় লিখেছেন—
“মোর প্রিয়া হবে এসো রানি দেব খোঁপায় তারার ফুল,
কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির চৈতী চাঁদের দুল।”
ভাব্বা, আমার-না মাঝে মাঝে খুব এক লাগে। আপনি আগামীকাল চলে যাবেন, আমার কী হবে? এমনভাবে যদি প্রতিদিন থোকার মতো জড়িয়ে থাকা যেত?
তাহলে স্বাভাবিক হয়ে যেত। ভালো লাগত না। বরং বিরক্ত এসে ভীড় করত। প্রাপ্তি সহজলভ্য হয়ে গেলে মন বিতৃষ্ণার দখলে চলে যায়। এজন্য দাম্পত্য জীবনকে বলা হয় প্রেমের টর্চার সেল।
কিন্তু আমার যে এক লাগে।
আসলে সোনা মেয়ে, আমরা সবাই একা। শুধু ধরনটা আলাদা।
আপনার কথা মনে পড়লে কষ্ট লাগে, খুব কষ্ট লাগে।
কষ্টমুক্ত হাওয়ায় ইচ্ছেমতো ছুটাছুটি করার আনন্দ কত অনাবিল তা মুক্ত আছ বলে বুঝতে পারছ না। এই যেমন বাতাসের অগাধ সমুদ্রে ডুবে আছি বলে বুঝতে পারি না বাতাসের মূল্য। তবু স্বীকার করছি— তোমাকে আমি অনেক কিছু দিতে পারিনি। আরও অনেক কিছু দেওয়া উচিত ছিল। তোমার জীবনটাকে- – -।
“ভাব্বা, থামুন”, কল্পনা রীতিমতো ধমক দিল, “আপনি আমাদের অনেক অনেক দিয়েছেন। কেউ কাউকে এত বেশি দিতে পারে না; দেয়নি কখনো, পারবেও না।”
“হ্যাঁ”, রচনা বলল, “এত বেশি কারও পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়।”
“সবচেয়ে প্রিয় চাওয়াটা দিতে পারিনি”, আমি বললাম, “হয়তো দেওয়া উচিত ছিল। তবে সান্ত্বনা এটাই— এই না-দেওয়ার মধ্য দিয়ে আমি তোমাকে আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটাই দিয়ে দিয়েছি। সেটি কি জানো?
জানি না— জানি কি না।
এ আবার কেমন উত্তর?
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। আপনি বলুন।
দূরত্বের মগ্নশিখা অনন্ত প্রাপ্তির চিরসবুজ প্রত্যাশা। যে প্রত্যাশা আমরণ প্রতীক্ষার প্রহর গুণবে-না পাওয়ার স্মৃতিকে ভুলতে, মধুর-বিধুর কষ্টে। এই না-পাওয়া এত আনন্দ দেবে যে, শেষ না কখনো, ম্লান হবে না কখনো। কেবল সুন্দর বিষয়গুলো উঠে আসবে। আমাদের দুজনের মধ্যে আর কখনো ভালোবাসাহীন হওয়ার মুহূর্ত আসবে না, আসার কোনো কারণও ঘটবে না। কেননা, আমাদের মধ্যে মনুষ্যসৃষ্ট কোনো বন্ধন নেই। আকাশে ভেসে বেড়ানো বাতাসই আমাদের বন্ধন। কেউ আমাদের মধ্যে বিদ্যমান বায়ুবন্ধনকে ছিন্ন করতে পারবে না, কখনো না। এটি অসম্ভব।
ভাব্বা, আমি বুঝতে পেরেও অনুধাবনের চেষ্টা করিনি। কেবল বর্তমানে আবিষ্ট থেকেছি। অনন্তে মন দেওয়ার কথা ভাবিনি। আপনার মাঝে এত মগ্ন ছিলাম যে, মনে করতাম— আপনি আমার সব।
“নিনি রিটার্নড”, দরজার দিক থেকে ভেসে এল নিনির গলা। সে আমাদের জন্য নাস্তা নিয়ে এসেছে। “আসছি’ বলে কল্পনা আর টুটুল আমাকে ছেড়ে উঠে গেল নিনির হাত মুক্ত করতে।
রাজ-রোজি আর রচনা আমাকে জড়িয়ে। রচনার চোখ আর কপোল জলে জলে একাকার। রাজ-রোজি আর আমি একযোগে মুছে দিলাম হাত দিয়ে। একটা বিশাল শ্বাস ছেড়ে স্বাভাবিক হয়ে গেল মুহূর্তে।
“স্যার”, রচনা বলল, “ম্যাম আর বাচ্চারা কেমন আছেন? আমার আমাকে আমি মাঝে মাঝে ওখানে দেখতে পাই। দারুণ লাগে অমন ভাবতে।”
“শুধু একবার অবাধ্য হতে যদি
আমরা শেকল বন্দি হতেম
চিরদিন নিরবধি।” তা কি ভালো হতো? একবার মনে হয় ভালো হতো। আবার মনে হয় না। এখন ভালো আছি। এমন সাংঘর্ষিকতা কখনও চিন্তাকে তছনছ করে দেয়। তুমি যদি অবাধ্য হতে কল্পনার মতো।
ঈশ্বরের অবাধ্য হওয়া তার সৃষ্টির পক্ষে সম্ভব নয়। ভাব্বা, ঈশ্বরকেই অবাধ্য হওয়ার নির্দেশ দিতে হয়। আমি তো এমন কোনো নির্দেশ পাইনি। কীভাবে ঈশ্বরের অবাধ্য হই?
তাহলে এটাই ভালো হয়েছে। বাঁধনহীন বাঁধন দিয়েই তোমাকে চিরদিনের জন্য বেঁধে রাখব। বাঁধনহীন বাঁধন মুক্ত মহাকাল। তুমি কলসির নয়, সাগরের জল। তুমি অসীম অতল। আমি ইচ্ছেমতো পান করে যাব বাধাহীন বাধায়, গহন অবগাহনে। তুমি আমার ভালোবাসা, মুক্ত মহাকাল- – -।
আমার সঙ্গে গেয়ে উঠল কল্পনা, তার সঙ্গে সবাই—
“সাগর উদাস সুর দিয়েছে বৃষ্টি দিল তাল
তুমি মধুর নতুন জীবন স্বপ্ন দেউল ভাল।
ছিলাম আমি তৃষ্ণাকাতর শুকিয়ে যাওয়া নদী
ফুলেল স্রোতে ভাসিয়ে দিলে আমায় নিরবধি। “
ভাব্বা, আপনি আমাকে একটা চড় দিয়েছিলেন, ওটিই ছিল প্রথম। মনে আচ্ছে?
হ্যাঁ।
কোথায় বলুন তো?
ঢাকা বিমানবন্দরে প্রথম লন্ডন আসার দিন।
রচনা হাসিতে কষ্ট ঢেলে বলল, চড়টা ছিল আমাকে আপনার দেওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার। ওইদিন বুঝতে পেরেছিলাম— আপনি আমাকে কত ভালোবাসেন, আমার জন্য কত বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন। এবার পুজোর পালা। আমি আপনার পায়ে মাথা রেখে শুয়ে থাকব। আনত হব প্রার্থনায়।
আপু কফি? টুটুল বলল।
পরে।
ঠান্ডা হয়ে যাবে যে। ভাব্বা, আপনার কফি।
আমিও পরে।
আমার অনুভূতির ভেতর আগুন জ্বলছে। শিহরনে শিহরনে জগছে উদ্দাম চিৎকার। রচনাকে আজ আমার কাছে নতুন লাগছে। আগের রচনা পুরোটাই নিমিষে হারিয়ে গেল। আমি ভুলে যাই ঋধিতার কথা। ভুলে যাই রচনা আমার মেয়ে।
ভাব্বা?
কিছু বলবে?
আমি আপনাকে জড়িয়ে ধরে এভাবে ঘুমাই?
বাসায় যাবে না?
কল্পনা বলল, উন্মুক্ত ছাদই হোক আমাদের বাসা। সারারাত থাকব। দেখেন-না রাস্তায়, কত মানুষ। তারা কেবল বের হওয়া শুরু করেছে। সারারাত থাকবে নদীর তীরে, আকাশের নিচে, খোলা রাস্তায়, গাছের পাশে বনের মমতায়।
মাথা চুলকানোর আমি রচনা থেকে হাত তুলতে গেলাম। সে আঁকড়ে ধরে বলল, হাত সরাবেন না। কী করতে হবে আমাকে বলুন।
সরাব না।
যদি ম্যাম ফোন করে?
সুইচ বন্ধ।
কিন্তু- – –
কোনো কিন্তু নেই। আমার জীবন আমার। আমার শরীরের ব্যথা কেউ কি নিতে পারবে? তাহলে কেন অন্যের জন্য অহেতুক মাত্রাহীন এত বাড়াবাড়ি? কেন স্ত্রীপুত্রদের জন্য এত নৃশংস স্বার্থপরতা। আমাকে আমি কেন শান্তি দিতে পারব না?
ভাব্বা?
চুপ, কোনো কথা নেই।
কেন?
আজ নতুনের ডাক পেয়েছি নতুন সমারোহে,
তোমার মাঝে হারিয়ে আমি আকাশ-বিরল মোহে
স্নেহ যেটুকু সুপ্ত ছিল জেগেছে প্রেমদ্রোহে।
“আপু একটা গান করো”, কল্পনা বলল। কল্পনার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বললাম, আমিও তোমাকে অমন অনুরোধ করতে যাচ্ছিলাম। কল্পু আমার কথাটা চুরি করে নিল, কুম্ভিলক।
রচনা সুর নিল গলায়—
“আমি অকৃতি অধম বলেও তো কিছু
কম করে মোরে দাওনি;
যা দিয়েছ, তারি অযোগ্য ভাবিয়া
কেড়েও তা কিছু নাওনি॥”
অর্ধরাত শেষ করে বাসায় ঢুকলাম। ঘুম এল না কারও। আগামীকাল ছাড়তে হবে যুক্তরাজ্য। একনাগাড়ে আমার বিশ দিন রচনাদের হৃদয়ে কেমন দাগ কেটেছে তা হিথরো গিয়ে বুঝতে পারলাম।
বুঝতে পারলাম, বিদায় কত যাতনার হয়। কত প্রচণ্ড কষ্ট দিয়ে শুকনো চোখ থেকে গ্যালন গ্যালন অশ্রু ঝরায়। ঢাকায় এসে স্বাভাবিক হওয়া কষ্টের হয়ে গেল। রচনাদের সঙ্গে কাটানো বিশ দিন আমার জীবনে অনন্ত দিন হয়ে গেল।