সন্মিত্রা: বিংশ পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
আপু, পাগলা দাদু এসেছেন, চিৎকার দিল টুটুল। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার দিল আমার দুপাশে বসে থাকা রাজ-রোজি, কী মজা, পাগলা দাদু এসে গেছেন,হুররে!
কোথায়? জ্যোতির্বিজ্ঞানীর মতো একাগ্রচিত্তে আমার মাথায় সাদা চুল অনুসন্ধানে ব্যস্ত আল্পনা টুটুলের চেয়েও জোরে চিৎকার দিয়ে জানতে চাইল। তার চিৎকারের প্রতিধ্বনি যেন আনন্দ-প্রমোদিত ঝংকার। কানে ছন্দ ঢেলে দিচ্ছে। নিশ্চয় পাগলা দাদু খুব প্রিয় কেউ। আমরাও ছোটোবেলায় খুব প্রিয় কোনো গুরুজন এলে এমন আনন্দ চিৎকার দিতাম।
টুটুল চিৎকার দিয়ে বলল, ড্রয়িংরুমে বসিয়েছি।
“বসাও”, আল্পনা বলল।
পাগলা দাদু আপুর কথা জানতে চাইছেন।
“বলো, আপু নেই। যেতে দিও না। আপু রাগ করবে। অনেক দিন পর এসেছেন। কী খাবেন জিজ্ঞেস করো। নিনিকে বলো খাবার রেডি করতে। সবাই একসঙ্গে খাব, তাই না ভাব্বা?”
তাই, কিন্তু —
কিন্তু মানে?
পাগলা দাদু কে?
প্রফেসর স্যামুয়েল গডফিন মেমুড আব্রাহাম গোপাল চিকুচি।
এত লম্বা নাম?
দালিলিক নাম স্যামুয়েল গডফিন।
কোন দেশি নাম? কোন দেশি মানুষ?
তিনি কোন দেশের মানুষ সেটা কাউকে বলেন না।
কেন?
তিনিও জানেন না মনে হয়। জানতে চাইলে বলেন—
কী বলেন?
“পৃথিবী আমার দেশ,
বিমুগ্ধ প্রেম-রেশ
সীমান্ত আর পাসপোর্ট
সব ভুয়া সব ঝুট।
দারুণ তো! আমি বললাম।”
রচনা আপুর কাছে শুনেছি রাশিয়ার কাছ থেকে ক্রীত আমেরিকান অঙ্গরাজ্য আলাসকায় তাঁর জন্ম। জাপান, ভারত, মিশর এবং লন্ডনে গবেষণা করেছেন। কলকাতাতেও ছিলেন অনেকদিন। বাংলাও জানেন, হিন্দিও জানেন।
সংস্কৃত?
তাও জানেন। অদ্ভুত মানুষ।
অধ্যয়ন?
শেষ অধ্যয়ন অক্সফোর্ডে। কর্মজীবনও এখানে। অনেক দিন দর্শনের শিক্ষক ছিলেন। এখন রিটায়ার্ড। এমিরেটাস করতে চেয়েছিল। প্রত্যাখ্যান করেছেন।
ছেলেমেয়ে নেই?
না।
বিয়ে করেননি?
না।
কেন?
তিনি মনে করেন, মেয়ে এবং পুরুষ ভুল করে পরস্পর ভিন্ন প্রকৃতির দুটি পৃথক গ্রহ থেকে পৃথিবীতে চলে আসা দুটি ভিন্ন প্রজাতির জীব। তাই নারী-পুরুষে কখনো মিল হয় না। তিনি তাঁর আদিগ্রহ থেকে বিপরীত লিঙ্গের কোনো মানুষ আসার অপেক্ষা করছেন। এলে তাকে বিয়ে করবেন। এখনও অপেক্ষায় আছেন। তাই বিয়ে থা করেননি।
কতদিন অপক্ষো করবেন?
যতদিন না পান।
অনেক ভালো মানুষ, শুধু হাসেন আর হাসান। বর্তমান বিশ্বের সম্ভবত একমাত্র বুদ্ধিমান ও শিক্ষিত মানুষ। যার সঞ্চয় প্রবণতা একদম নেই।
রিলিজিয়ন, মানে কোন ধর্মাবলম্বীর সংসারে জন্ম?
“হাসা এবং হাসানোই তার ধর্ম”, আল্পনা বলল, “লন্ডনে তিনি আমার একজন প্রিয় মানুষ। আমাদের সবার প্রিয়। রচনা আপু তাঁকে খুব শ্রদ্ধা করেন। পাগলা দাদুর কথা শুনলে মনটা ভলো লাগায় ভরে যায়। সব কষ্ট নিমিষে হাওয়া হয়ে যায়।”
তোমরা যে পাগলা দাদু ডাক, তিনি জানেন?
জানেন।
কথাটির অর্থ জানেন?
জানেন।
কিছু মনে করেন না?
সবাই তাকে ‘ম্যাড ফিলোসফার’ ডাকেন, কিন্তু আড়ালে। সামনাসামনি কেউ ডাকেন না। টুটুলই তাকে প্রথম একদম সামনাসামনি পাগলা দাদু ডেকেছিল। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, ‘পাগলা দাদু’ কথার অর্থ। টটুল বলেছিল—ম্যাড গ্র্যান্ডফাদার।
রাগ করেনননি?
টুটুল রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল, না। বরং আমাকে চকলেট দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ম্যাড ফিলোসফার-এর চেয়ে ম্যাড গ্র্যান্ডফাদার অনেক মধুর।
চকলেট দিয়েছিলেন কেন?
তিনি কারও কথায় খুশি হলে চকলেট দেন। বলেছিলেন—এতদিন পর কেউ নির্ভয়ে আমার যথার্থ স্বীকৃতিটা দিতে সাহস পেল। সামনাসামনি কেউ ম্যাড ফিলোসফার বলার সাহস পায় না। অথচ আড়ালে প্রায় সবাই আমাকে তাই ডাকে। মানুষ জন্মগতভাবে ঈর্ষাপরায়ণ। কেউ কাউকে প্রকাশ্যে স্বীকৃতি দিতে চায় না। কিন্তু মনে মনে ঠিকই স্বীকার করে। টুটুল, ইউ আর গ্রেট।
আসেন না ভাব্বা,“ আল্পনা বলল”, পাগলা দাদুর সঙ্গে পরিচিত হই; যাবেন?
মোহিত হয়ে শুনছিলাম পাগলা দাদুর গুণগান। এমন দুর্লভ চরিত্রের লোকের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার সুযোগ ছাড়া উচিত হবে না। পরিচয় হওয়ার আহ্বান পেয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আল্পনা তখনো আমার চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল। এসময় কল্পনা এসে তার হাত থেকে চিরুনিটা এক প্রকার জোর করে টেনে নিয়ে বলল— মেজাপু, তুমি জামা নিয়ে এসো। ভাব্বাকে আমিই পরিয়ে দেব।
না, আমি। তোমরা সবসময় পরাও। ক্লাস করে এসেছ। হাতমুখ ধুয়ে এস।
পাগলা দাদুকে দেখার জন্য আমি পাগল হয়ে গেছি। ঝগড়া বড়ো হওয়ার আগে মিটিয়ে দিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে রওনা দিলাম। আমার দুহাতে দুজন।
ড্রয়িংরুমে ঢুকে দেখলাম, মাঝখানের বড়ো সোফাটার মধ্যিখানে একটা চিকন শরীর বসে আছে। নড়ছে কি নড়ছে না। কপাল একটু কাত করলে এবং মুখটা আর একটু বড়ো হলো স্টিভেন হকিং বলে ভুল হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। শরীরের ওপর ফোলানো ফুটবলের চেয়ে বড়ো একটা মাথা। তাতে দুগ্ধধবল চুল, কিছু কিছু চুল দলছুট হয়ে গলা অবধি নেমে এসেছে। কাঠির মতো চিকন, কিন্তু কাশফুলের মতো সাদা হাতের চামড়ার নিচে শুয়ে থাকা রগগুলো হাতের চেয়ে বড়ো হয়ে ফুলে আছে। যেন চামড়ার নিচে অনেকগুলো সাপ কিলবিল করছে। কালো কোটের ওপর সাদা দাঁতের বিচ্ছুরিত হাসি রোদের দীপ্তিকেও হারিয়ে দিচ্ছিল।
তাকানোমাত্র বোঝা যায়, শুধু মুখ নয়, সারা শরীর এবং শরীরের পোশাকগুলোও হাসছে। এমন বিস্তৃত হাসির সর্বাঙ্গীণ মানুষ আমি আর দেখিনি। তাঁকে দেখে আমার আগ্রহ আরও পুলকিত হয়ে উঠল। বয়স কত ধারণা করা সম্ভব হলো না। আশিও হতে পারে একশ ত্রিশও হতে পারে।
‘আপনার মতো সুখী মানুষ আমি দেখিনি”, পরিচয়পর্ব শুরু করার আগে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে বললাম,“ এতক্ষণ আপনার গুণগান শুনছিলাম।”
তিনি আমার আপাদমস্তক লক্ষ করে হাসলেন, মাথা নাড়লেন।
হাসি পরিব্যাপ্ত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ যা আছে তা পরিপূর্ণ। আগের হাসিকে আমার দিকে তাক করে বললেন, সুখী হতে হলে সুখের কথা পুরোটা ভুলে যেতে হয়।
আপনি কি তা ভুলে গেছেন?
হ্যাঁ। তাই আমি সুখী মানুষ।
ভুলতে না পারলে?
লোভ জেগে থাকে। লোভ যতক্ষণ জেগে থাকে সুখ ততক্ষণ ভয়ে কাছে আসে না, দূরে সরে থাকে। লোভ হায়েনা এবং হরিণ সুখ। লোভে কার না ভয় স্যার? আমি তো লোভকে লোভীর চেয়েও ভয়ংকর মনে করি। লোভীদের কাছে সম্পদই ভালোবাসার উৎস।
পাগলা দাদুর স্যার সম্বোধন শুনে বুঝলাম, রচনা তাঁকে আমার কথা বলেছে।
বললাম, আপনি আমাকে চেনেন?
কাছে থাকলে কি অত ভালো করে চিনতে পারতাম? রচনা এমনভাবে আপনার কথা বলেছে—কলকাতার সন্ধ্যার ট্রেনে দেখলেও চিনে নিতে পারতাম। কেবল বর্ণনা শুনে আপনার একটা ছবি এঁকে দিয়েছিলাম রচনাকে, দেখেছেন?
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, আপনিই তাহলে সেই ছবির আঁকিয়ে?
রচনা আমার সঙ্গে বাজি ধরেছিল। আমি নাকি আপনার ছবি আঁকতে পারব না। তার ধারণা ছিল, কোনোদিন যাকে দেখিনি, শুধু কথা শুনে কীভাবে আঁকব! বাচ্চা মেয়ে, তবু হারিয়ে দিলাম। সে দেখি হেরেও কষ্ট পায়নি। পরাজিত হয়ে এত আনন্দ পেয়েছিল, আমাকে চুমোই দিয়ে দিল একটা। আহ্ কী মধুর মেয়ে, ভিন গ্রহের আর কোনো অধিবাসীকে এমন মধুর হতে দেখিনি।
আমার পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
নেই। আপনাকে আমি আগাগোড়া চিনি। রচনা মা চিনিয়ে দিয়েছে।
আপনি কেমন আছেন?
আহহা, এটা প্রশ্ন নয়।
কী?
সৌজন্যসূচনা।