সন্মিত্রা: একবিংশ পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
পাগলা দাদু ডাকলে কষ্ট হয় না?
আমার প্রশ্ন শুনে প্রফেসর স্যামুয়েল গডফিন মেমুড আব্রাহাম গোপাল ওরফে চিকুচি এমনভাবে ওষ্ঠাধর নাড়লেন, যেন আমি প্রশ্নটি করব তা তিনি জানতেন। চোখ পিটপিট করে কল্পনার দিকে তাকিয়ে পরক্ষণে আমার দিকে ফিরে বললেন, কষ্ট হবে কেন?
সত্যি, কষ্ট লাগে না?
না। বরং পাগল ডাকলে আমার ভালো লাগে। শুধু ভালো নয়, খুব ভালো লাগে।
কী বলেন?
“পাগল ডাকে”— এজন্য কি আমার হাসি বন্ধ হয়েছে? আমি এতদিন এই স্বীকৃতিটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। যথার্থ স্বীকৃতি পেলে হাসতে হয়। এটি স্বীকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা।
কী অবাক!
স্যার, আপনি কী ওই বিশালত্বের পরিমাপ করতে পারবেন, যেই বিশালত্ব ধারণ করতে পারলে একজন মানুষ পাগল হয়? মানুষ তাকে পাগল ডাকে এবং পাগল ডাকলেও ওই মানুষের খারাপ লাগে না, বরং ভালো লাগে?
মানে?
পাগল ডাকলে পাগল ছাড়া আর কারও খারাপ লাগে না।
সব মানুষের খারাপ লাগে।
আমি কি তাহলে মানুষ নই?
মানুষ হবেন না কেন? বলতে চাইছিলাম অধিকাংশ মানুষের খারাপ লাগে।
অধিকাংশ মানুষই পাগল। আমার কথা নয়- চিকিৎসাবিজ্ঞানের কথা।
আপনি অনেক জ্ঞানী মানুষ।
আপনাদের টেগোরকে আমার খুব ভালো লাগে। অনেক বড়ো কবি। নিজেকে অনেক জায়গায় পাগল বলেছেন ইশারায়-ইঙ্গিতে এবং সরাসরি।
চিকুচি কথাগুলো বলা শেষ করে রবীন্দ্রনাথের একটি গানে সুর দিলেন,
টুমি মোর ফাউ নাই ফাউ নাই পরিচয়,
টুমি জারে যানো সি জে কেহো নয় কেহো নয়...।” কেমন হলো?
গেয়ে যান।
আর জানি না। পাগল না হলে আপনি জ্ঞানী হবেন কীভাবে?
অনেক ভালো আপনি। শ্রদ্ধামাখা গলায় বললাম।
রবীন্দ্রনাথের আর একটা গানে সুর দিলেন চিকুচি, “পাগলা হাওয়ার বাডল ডিনে পাগল আমার মোন যেগে ওথে…।” আর বলব না। রবীন্দ্রনাথ নিজের মনকে পাগল বলেছেন। পাগল মন জেগে উঠেছে। ভালো মন জাগতে পারে না।
কেন?
পাগল না হলে তুমি ভালো হবে কীভাবে?
উদার মন আপনার।
চিকুচি আবার সুর দিলেন রবীন্দ্রনাথে, “জগট জুরে উডার সুরে আনন্ড গান বাজে…,।” এটাও আর বলব না।
পুরো বলেন না কেন?
পাগল হতে না পারলে তুমি উদার হবে কীভাবে?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তো আপনি দেখি পুরোটাই পড়ে ফেলেছেন?
আগে একটু একটু জানতাম, বাকিটুকু শিখিয়েছে রচনা-মা।
মুগ্ধকর।
টাগোর আমার প্রিয় কবি। আমি সত্যানুসন্ধানী একজন মানুষ। সত্যের সন্ধানে থাকি।
আপনার পরিচয়?
ঠিক জানি না।
পূর্বপুরুষ?
পূর্বপুরুষ পথ ভুলে অন্য গ্রহ থেকে এখানে এসে পড়েছে। সত্য জানলে আপনি পাগল না হয়ে পারবেন না এবং সত্য যদি বলেন তাহলে যারা সত্য জানে না তারা আপনাকে পাগল বলবে। কেউ কেউ মেরেও ফেলতে চাইবে। ভারতের মানুষে এমন হিংস্রতা দেখেছি।
অবাক হয়ে বললাম, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা বললেও মনে হয় আমার এত খুশি লাগত না। আপনি একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ।
অনেকে বলেন, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, এটা ঠিক নয়।
এমন ধারণা!
যে গ্রহ থেকে আমরা এসেছি সে গ্রহে আমাদের জীবনশক্তি আহরণ এবং ধারণের পুরো জিনিস রয়ে গেছে। এখানে তা নেই। আমরা তো উলঙ্গ পতিত হয়েছি। আমাদের পূর্বপুরুষ আসার সময় শুধু শরীরটা নিয়ে এসেছিল। পৃথিবী নামের গ্রহে মানুষ এখনো পুরো অভিযোজিত হতে পারেনি। তাই আমাদের মরে যেতে হয়। ভিন গ্রহের উপাদানই আমাদের মৃত্যুকে নিয়ন্ত্রণ করে। তারাই সৃষ্টির সেরা জীব।
কিন্তু মানুষ যে বলে, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব?
আমি আমাকে শ্রেষ্ঠ বললে হবে? তবে যদি আমি নিজেকে পাগল বলি—এটি সবাই মেনে নেবে। কারণ পাগলকে মানুষ হেয় চোখে দেখে। হেয় প্রাণীরা সবসময় অন্যকে হেয় বানাতে চায়, হেয় দেখতে চায়। এটা অবশ্য আপনাদের সাধারণ ধারণার জন্য বলছি। পাগলা ডাক, কিন্তু আমার কাছে আপনাদের প্রায়োগিক অর্থের বিপরীত একটা শব্দ। Get mad, then get over that.
“পাগলা দাদুর তত্ত্বগুলো নিয়ে এখন বেশ আলোচনা হচ্ছে”, আল্পনা বলল, হকিংও পাগলা দাদুর ভক্ত।
আমি আপনাকে কী ডাকব? জানতে চাইলাম।
আল্পনা, কল্পনা আর টুটুলের দিকে তাকিয়ে চিকুচি বললেন, এরা যদি আমাকে পাগলা দাদু ডাকে, তাহলে আপনি ডাকবেন পাগলা বাবা। কলকাতায় অনেক পাগলা বাবা দেখেছি। পাগলা বাবা নিয়ে অনেক গানও হয়েছে। টেগোর গেয়েছেন: কেন আমায় পাগল করে যাস, ওরে চলে যাওয়ার দল – -।
বাংলাদেশেও পাগলা বাবা আছে, আমি বললাম।
ওঁরা ঋষি। ওরা আর্ষ, ওরা আর্য। ওরা মৌনী। জগতের অনেক বিষয় তাদের জ্ঞাত, কিন্ত প্রকাশ করেন না। পাগলমাত্র ঋষি। আমাকে এক আর্ষ বলেছেন—
“কথা বড়ো ঠিক,
এ ভুবনে যে পাগল সেই যথার্থ প্রেমিক।”
অধ্যাপনায় শিক্ষার্থীদের কোন বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে বলতেন?
আমি ছাত্রদের শিখিয়েছি একটাই। এজন্য অনেক দিন শিক্ষকতা করতে পেরেছি। বেশি শেখালে আসলে কিছুই শিখতে পারে না, ঠিক তোমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মতো। তোমরা চাও— শিশুরা সব বিষয়ে দক্ষ হয়ে উঠুক, তাই তারা কোনো বিষয়ে দক্ষ হতে পারে না। এখন বিজ্ঞানের যুগ, বিশেষজ্ঞের যুগ। ডান চোখের চিকিৎসা যিনি করবেন, তিনি বাম চোখের চিকিৎসা করতে পারবেন না। কাণ্ডজ্ঞান থাকলে হয়। তোমরা চাও বৃক্ষজ্ঞান। তোমরা চাও সব একজনকে শিখিয়ে দিতে। তাই তারা কিছুই শিখতে পারে না। পক্ষান্তরে শেখাটা বোঝা হয়ে যায় বলে শিখতেও চায় না। এজন্য তাদের শিক্ষাটা হয়ে যায় অন্ধের হস্তীদর্শন।
আপনি ছাত্রদের একটাই শেখান, সেটা কী,?
সব মানুষ পাগল—আমি ছাত্রদের এটাই শিখিয়েছি ।
হোয়াট!
আমিও মানুষ। তাহলে আমার তত্ত্ব অনুযায়ী আমি কী? চিকুচি জানতে চাইলেন।
আমরা চুপ করে আছি দেখে চিকুচি বললেন, সাহস পাচ্ছেন না তো? কিন্তু মনে মনে বলছেন পাগল। সবাই তেমন, আমার অবর্তমানে আমাকে পাগল ডাকে, কিন্তু সামনে পাগল বলার সাহস পায় না। তাহলে তারাও যে পাগল— এটি প্রকাশ্যে স্বীকার করে নেওয়া হবে। কারণ আমি-মানুষ যদি পাগল হই, তাহলে তুমি-মানুষও পাগল, কী বলেন? আর তুমি যদি পাগল না হও তো মানুষ হলে কীভাবে?
আপনার তত্ত্ব ভুল হতে পারে না?
ভুল একটা ভৌতিক শব্দ। দর্শন এবং বিজ্ঞান একই জিনিস। আমি ধর্মকেও দর্শন বলতাম, যদি ধর্ম দর্শনের মতো প্রতিষ্ঠিত কোনো মতবাদ নিয়ে গবেষণা করে তার ভুলত্রুটি জানায় রত হওয়ার সুযোগ থাকত; ভুল পাওয়া গেলে তা ভুল বলে মেনে নেওয়ার বিধান থাকত। দর্শন আর বিজ্ঞানে কোনো ভুল নেই। কারণ এটা নিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে, প্রবহমান জল কখনো বিষাক্ত হতে পারে না। বদ্ধ জলই বিষাক্ত হয়। যে মতবাদের রীতিনীতিগুলো অপরিবর্তনীয় সে মতবাদ বদ্ধ জলাশয়ের মতো বিষাক্ত জলের একটি দুঃসহ যন্ত্রণা।
তাহলে ভুলটা কী?
জ্ঞান কী? প্রশ্নের উত্তরের বদলে চিকুচি প্রশ্ন করলেন।
আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। তার আগে চিকুচি বললেন, আপনি কী বলবেন জানি না, আমার মতে জ্ঞান হচ্ছে ভুল চিহ্নিত করতে পারার সামর্থ্য অর্জন। শিক্ষার মাধ্যমে এটি অর্জিত হয়। তাই শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে ভুল বের করার সামর্থ্য অর্জন করা, বৃদ্ধি করা; নিবিড় করা। এজন্য আমি ভুলকে বলি শুদ্ধে উপনীত হওয়ার পথোৎস। তাই ভুল না থাকলে শুদ্ধও নেই।
বিশ্বাস?
জ্ঞান, সত্য আর শুদ্ধতার ভাইরাস। এটি প্রবল হলে জ্ঞান দুর্বল হয়ে পড়ে। জ্ঞান দুর্বল হলে মানুষ আস্তে আস্তে নিজের বিবেকের পরিবর্তে মতবাদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। তখনই সৃষ্টি হয় লোভ, লালসা। সৃষ্টি হয় অন্যের প্রতি ঘৃণা। এরূপ মানুষ নিজের মতবাদ ছাড়া বাকি সব মতবাদকে শ্রেষ্ঠ করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পুরো পৃথিবীটাকে সবার জন্য দুর্বিষহ করে তোলে।