Warning: Constant DISALLOW_FILE_MODS already defined in /home/draminb1/public_html/wp-config.php on line 102

Warning: Constant DISALLOW_FILE_EDIT already defined in /home/draminb1/public_html/wp-config.php on line 103
সন্মিত্রা : এক মলাটে সন্মিত্রা: সন্মিত্রা সম্পূর্ণ উপন্যাস : প্রথম থেকে শেষ পর্ব – Page 23 – Dr. Mohammed Amin

সন্মিত্রা : এক মলাটে সন্মিত্রা: সন্মিত্রা সম্পূর্ণ উপন্যাস : প্রথম থেকে শেষ পর্ব

সন্মিত্রা: ত্রয়বিংশ  পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন

রচনা প্রমিতার পিএইচডি থিসিসের প্রস্তাবনায় একাগ্র। সে একমনে পড়ে, কিন্তু প্রফেসর হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের কোনো লেখায় এমন একাগ্রতা দিতে দেখিনি। দুই-এক পৃষ্ঠা উলটে তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত দিয়ে দিতে দেখেছি। প্রমিতার প্রপোজাল যত পড়ছিল আগ্রহ তার তত বাড়ছিল। চোখ আর কপালের কুঞ্চন বলে দিচ্ছিল সন্তুষ্টির পরিমাণ।
সোনা, কেমন হয়েছে প্রপোজাল? পুলকিত মনে প্রশ্ন করলাম।
“চমৎকার”, একশব্দে বিশাল একটা উত্তর দিয়ে আবার পড়ায় মন দিল।
রচনার জবাব শুনে প্রমিতা হাসল। আমিও। তার হাসি আমার মনকে হাসির চেয়ে আরও বেশি হাসিয়ে দিল। আমার নির্দেশনায় লেখা প্রপোজাল রচনার পছন্দ হয়েছে, তার মানে কী? তাহলে কি আমিও অক্সফোর্ডে পিএইচডি করার যোগ্য? নিজের প্রশ্নে নিজেই বিষণ্ন হয়ে উত্তর দিই মনে মনে— “বামন হয়ে চাঁদে হাত, শখ কত ছোটো জাত।” জীবনে আমি কখনো ফেল করিনি। অ্যাকাডেমিক বিষয়ে রচনার প্রশংসা পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। সে জীবনে কখনো দ্বিতীয় হয়নি।
আপনিই প্রপোজালটা রেডি করে দিয়েছেন, তাই না ভাব্বা?
কে বলল?
বাক্য বিন্যাস এবং যুক্তি।
মানে?
আপনার ভাষা আমি কোটি লোকের লেখা থেকেও পৃথক করে নিতে পারব।
কীভাবে?
বাক্যের কোথায় কোন শব্দ আপনি বসান, সেই ১৯৯২ থেকে রপ্ত করে আসছি। ভাব্বা, লেখা ব্যক্তির চেহারার মতো অদ্বিতীয়।
তোমার বাক্যসজ্জাও আমার মতো।
আমি আপনার সৃষ্টি। আপনার মতোই তো হবে।
আমি লিখেছি, প্রশংসাটা কি এজন্য?
তা তো বটে, কিন্তু এত ভালো লেখা আপনার মগজ ছাড়া আর কার মগজ থেকে বের হতো— এটাও তো আমাকে ভেবে দেখতে হবে। তবে- – -।
তবে কী? সংশয় নিয়ে বললাম।
প্রথম খসড়াটায় কিছু অ্যাকাডেমিক বিষয় ছিল না। অবশ্য এগুলো জ্ঞানের বিষয় নয়, প্রাতিষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতা। প্রমিতাকে বলে দিয়েছিলাম— ঠিক করে নিতে।
বাবা গো, আমি তো অ্যাকাডেমিক কেউ না। নন-অ্যাকাডেমিক মানুষ। পাখির মতো মনের আনন্দে গেয়ে যাই। নাম্বার-সনদে কোনো আগ্রহ নেই।
প্রমিতা বলল, ম্যামের কথামতো ঠিক করে নিয়েছি।
“এখন বেশ ভালো হয়েছে”, রচনা বলল, “বলা যায় নিখুঁত।”
আমিও কী তাহলে একটা প্রস্তাবনা দেব?
“দিতে পারেন। তবে পিএইচডি হবে না”, রচনা অধ্যাপকীয় হাসি দিয়ে বলল, “বাছাইয়ে ঝরে যাবেন। পাগলা দাদুর মতো অবস্থা হবে।”
তাঁর কী হয়েছিল গো?
তিনি পিএইচডির একটা থিসিস জমা দিয়েছিলেন।
তারপর?
সেটি এত উচ্চমার্গের ছিল যে, পরীক্ষকদের কেউ বুঝতেই পারেননি।
সত্যি!
পাগলামি মনে করে তাঁর প্রপোজালই বিবেচনায় আনা হয়নি।
অবাক তো!
নোবেল ইউনিভার্সিটি হিসেবে পরিচিত হার্ভার্ডে প্রপোজালটি জমা দেওয়া হয়। কয়েকজন অধ্যাপক এটি পড়ে পাগলামি মন্তব্য লিখে রেখে দিলেন। কয়েক মাস পর চিকুচি গেলেন খবর নিতে। অধ্যাপকগণ ব্যাখ্যা চাইলে চিকুচি যা বলেছিলেন, তা শুনে তাঁরা এত মুগ্ধ আর হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন যে, চিকুচিকে পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। একই সঙ্গে হার্ভাডে অধ্যাপনার প্রস্তাব।
হ্যাঁ, এমনই হয়।
প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়ন মূলত আইন আর সামাজিক রেওয়াজে বাঁধা একটি অস্থিতিস্থাপক রশি। টানলে বাড়ে না, বেশি টানলে ছিঁড়ে যায়। ওই সীমানার বাইরে গেলে বলবে— আপনি কিছুই জানেন না কিংবা যা জানেন তা পাগলামি। ভালো শিক্ষার্থী ভালো প্রফেসর হতে পারে, ভালো বিজ্ঞানী নয়, ভালো স্রষ্টা নয়। সৃজনশীল হতে হলে মেধা নয়, প্রতিভা লাগে।
আমি জরুরি বানান লিখে জেলা প্রশাসকের যে বকা শুনেছিলাম তা কখনো ভুলব না। বলেছিলেন— তুমি বিসিএস পাশ করলে কীভাবে? জরুরি বানানে যে ঈ-কার হয় তাও জান না।
ভাব্বা, নির্ধারিত সীমানার বাইরে যে বিশাল জগৎ রয়ে গেছে তা কয়জনই বা স্বীকার করেন? স্বীকার করা মানে তো— অজ্ঞতাকে মেনে নেওয়া। এমন কজনই বা পারে! যারা বিচার করবেন— তারা কুয়োর ব্যাঙের মতো নিজস্ব সীমানার বাইরে কী আছে তা যদি না জানেন তো বিশাল জগতের খবর তাদের কাছে অবিশ্বাস্য রূপকথা হয়ে যায়। আপনি তো সীমানার অনেক বাইরের চিন্তক।
আমাকে কজনই বা চেনে?
চেনার কী প্রয়োজন?
আধুনিক সভ্যতার অণুবিজ্ঞান চয়নে পরিচয় একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। অনেক সময় পরিচয় মূল্যায়নের বড়ো একটা শর্ত হয়ে যায়। অমর্ত্য সেনের চেয়ে অমিতাভ বচ্চন অধিক পরিচিত। অথচ বিশ্বকল্যাণে তার অবদান শূন্য।
আপনি তো স্যার ভগবান নন যে, পরিচয়-প্রসত্তির জন্য সৃষ্টিকে যুদ্ধে ঠেলে দেবেন। যত পরিচয় তত অবক্ষয়। অধিক পরিচয় ব্যক্তিগত প্রশান্তির বিঘ্নতা ডেকে আনে। আপনার জ্ঞান, আপনার লেখা— আমি মনে করি যিনিই পড়বেন তিনিই নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ হবেন। একজন হোক, হলো তো। এর চেয়ে বড়ো আর কী আছে, স্যার? সাধারণমানের লেখা সাধারণ লোকের জন্য। পৃথিবীতে সাধারণ লোকের সংখ্যাই তো অধিক, না? বেশি জন আগ্রহ নিয়ে পড়বে এবং পড়ে বুঝবে— এমন লেখা লিখতে জ্ঞান লাগে না। লেখা যত উচ্চমার্গের হবে পাঠক তত কমবে। এ তো গণতন্ত্র না যে, মাথা গুনে জয় ঘোষিত হবে।
প্রমিতার থিসিস গৃহীত হওয়ার সম্ভবনা কতটুকু?
শতভাগ।
সত্যি?
আবার স্যার শূন্যও হতে পারে।
কেন?
অক্সফোর্ডের সিলেকশন নিয়ে আগেভাগে কিছু বলা যায় না। এই ইউনিভার্সিটির উনসত্তর জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিষয়ে নোবেল পেয়েছেন। স্টিভেন হকিং, ডর্থি হজকিং, রবার্ট হুক, অস্কারওয়াইল্ড, টিএস ইলিয়ট, জে আর আর টলকিন, থমাস হব, জেরেবি বেনথাম, ভিএস নাইপল, জন ডন, পিবি শেলি, অ্যাডাম স্মিথ, আলফ্রেড মার্শাল, অমর্ত্য সেন প্রমুখ বিরল মেধার অনেক লোক এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ছিলেন। বললে, সারাদিন বলা যাবে। এখানে পিএইচডি করতে হলে ওই স্তরে উপনীত হওয়ার যোগ্যতা সম্পন্নদের রাখা হয়।
এতক্ষণ প্রমিতা চুপচাপ আমাদের কথা শুনছিল। রচনার কথা শেষ হওয়ার পর বলল, ম্যাম, নোবেল প্রাপ্তির সংখ্যা বিবেচনায় এক নম্বর ইউনিভার্সিটি কোনটি?
হার্ভার্ড। দ্বিতীয় ক্যামব্রিজ, তৃতীয় ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলি। অক্সফোর্ডের স্থান নোবেল বিজয়ীর সংখ্যা বিবেচনায় নবম। চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে যথাক্রমে ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো এবং কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি। কিন্তু খ্যাতির দিক থেকে অক্সফোর্ড এখনো বিশ্বসেরা।
এটি সম্ভবত অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ডিকশনারির জন্য।
এসময় রুমে ঢুকললেন এক ভদ্রলোক। বয়স তেইশ-চব্বিশের বেশি হবে না। রচনা আগন্তুককে দেখিয়ে বলল, র‌্যাফায়েল। আমি তার পিএইচডির গাইড। তার থিসিস আর প্রমিতার থিসিস প্রায় অভিন্ন। আমিই ডেকে পাঠিয়েছি। র‌্যাফায়েলের বাড়ি লুক্সেমবার্গ। ধর্মমতে সত্যাশ্রীয়।
সত্যাশ্রয়ী মানে?
বিশ্বাসাশ্রয়ী নই।
শুনেছি তোমাদের দেশের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী না কি বিদেশে অধ্যয়ন করে?
“ঠিক শুনেছেন স্যার”, র‌্যাফায়েল বলল, “তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অনেক মেধাবী শিক্ষক আমাদের দেশে শিক্ষকতা করার জন্য চলে আসেন।
তোমাদের প্রত্যেকটা ইউনিভার্সিটি বিশ্বখ্যাত। তারপরও এত ছাত্রছাত্রী বাইরে পড়তে যায় কেন?
ধনীরা যায় না।
কারা যায়?
আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে টিউশন ফি অক্সব্রিজের টিউশন ফির পাঁচ গুণ। যদিও একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত সরকারি সুবিধা পাওয়া যায়।
তোমাদের শিক্ষার মানও তো উন্নত।
মান যেমনই হোক, সুনাম তো আর অক্সব্রিজের মতো না। কিন্তু খরচ করতে হয় প্রচুর। নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতাহীন একজন নতুন শিক্ষকের প্রারম্ভিক বেতন উনাশি হাজার ডলার। এবার ভেবে দেখুন, টিউশন ফি কত হতে পারে। আমাদের দেশে তুলনামূলকভাবে আর্থিক অবস্থা যাদের খারাপ তারাই লন্ডন-আমেরিকা এবং ফ্রান্স-জাপান পড়তে যায়।
র‌্যাফায়েল, তোমাকে কী জন্য ডেকেছি জানো?
জানি না, ম্যাম।
প্রমিতাকে দেখিয়ে রচনা বলল, এ আমার বোন। তার থিসিস প্রপোজাল জমা হয়েছে। অতিরিক্ত কপি তোমাকে পড়তে দিয়েছিলাম, দেখেছ?
দেখেছি।
কেমন হয়েছে?
অসাধারণ।
অ্যাকাডেমিক কোনো বিষয় বাদ পড়েছে?
না।
কোথাও কোনো ঘাটতি আছে কি না দেখেছ?
কোনো ত্রুটি আমার চোখে পড়েনি।
তাকে সাক্ষাৎকার বিষয়ে একটা ভালো ধারণা দেবে।
ম্যাম, আপনার বোনের সাফল্য আমার পিএইচডি থিসিসের অংশ হয়ে গেল।
ধন্যবাদ।