সন্মিত্রা: ষড়্বিংশ পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
রিং পড়ার পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে রিসিভার তুলে নিল রচনা। স্পিকার অংশের ছিদ্ররাজি হাতে চেপে ধরে সুসানার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার স্বামী।
দিন।
এখানে না। ড্রয়িংরুমে চলে যান। আমি ফরোয়ার্ড করে দিচ্ছি।
সুসানা ড্রয়িং রুমে চলে গেলেন। ফিরে এলেন তিন মিনিট পর। দেখলামÑ মুখটা ভীষণ মলিন। যাওয়ার সময় উজ্জ্বল ছিল। মনে হলো আকস্মিক কোনো কারণে অপরাধবোধে ভুগছেন।
মনে হলো, অনাকাক্সিক্ষত কোনো কথোপকথনের কারণে তার মন এত বিষণ্ন। কিন্তু এমন হওয়ার কথা না। সুসানা সাধারণ কেউ নন। তার স্বামীও অসাধারণ। ঝগড়া হবে কেন?
হতে পারে। যে-কোনো মুহূর্তে যে-কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। সুখ-দুখ হাহাকার, তারই নাম সংসার।
দিন।
এখানে না। ড্রয়িংরুমে চলে যান। আমি ফরোয়ার্ড করে দিচ্ছি।
সুসানা ড্রয়িং রুমে চলে গেলেন। ফিরে এলেন তিন মিনিট পর। দেখলামÑ মুখটা ভীষণ মলিন। যাওয়ার সময় উজ্জ্বল ছিল। মনে হলো আকস্মিক কোনো কারণে অপরাধবোধে ভুগছেন।
মনে হলো, অনাকাক্সিক্ষত কোনো কথোপকথনের কারণে তার মন এত বিষণ্ন। কিন্তু এমন হওয়ার কথা না। সুসানা সাধারণ কেউ নন। তার স্বামীও অসাধারণ। ঝগড়া হবে কেন?
হতে পারে। যে-কোনো মুহূর্তে যে-কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। সুখ-দুখ হাহাকার, তারই নাম সংসার।
সুসানাকে দেখলে প্রথম উড়োজাহাজ ভ্রমণের কথা মনে পড়ে যায়। ওই দিন তিনি আমার জন্য যা করেছেন তা না করলে হয়তো সেদিনই মারা যেতাম। ত্রিশ হাজার ফুট ওপরে উড্ডীয়মান উড়োজাহাজে সে ছাড়া আর কোনো ঐশ্বরিক সহায়তা পাওয়ার পথ খোলা ছিল না। কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারলে অনেকটা ভালো লাগে। সুসানা এখন আমার বন্ধু।
বললাম, হঠাৎ এমন মনমরা যে?
ভালো লাগছে না।
কী হয়েছে?
টিভি দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি মানুষের কষ্ট সহ্য করতে পারি না। সব কষ্ট আমার ওপর চেপে বসে।
আপনার প্রতিটা কাজে তার প্রমাণ পাই। আপনি অসীম দয়ার অধিকারী একজন পরিপূর্ণ মানব। পৃথিবীর সব মানুষই আপনার আপনজন। এমন মানুষের কষ্ট পাওয়ার উপাদান চারদিকে ভূরিভূরি।
বেশি কষ্ট পাই তখন, যখন আমার সম্প্রদায় অন্যকে কষ্ট দেয়। মুষড়ে পরি তখন, যখন ঘনিষ্ট কেউ অন্যের দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমন ঘটলে অপরাধবোধ আমাকে ভীষণ লজ্জায় ফেলে দেয়। মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি আর আস্থা থাকে না।
বললাম, দয়ালু মানুষের মন খুব নরম থাকে। আসলে কী হয়েছে?
ইসরায়েলি বাহিনী গতকাল কয়েকশ মুসলিম পরিবারকে বসতবাটি হতে উচ্ছেদ করে দিয়েছে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেক মুসলিম নিহত হয়েছে। নিহতদের কয়েকজন শিশু। কী মর্মান্তিক! যে ধর্মের হোক, যারা মতবাদ কিংবা ঈশ্বর-ভগবানের নামে মানুষ হত্যা করে তারা অমানুষ।
“মধ্যপ্রাচ্য ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছে”, মাসাহিতো বললেন, “দেখবেন, এভাবে চলতে থাকলে একদিন রসাতলে চলে গেছে।”
ঐশ্বরিক মতবাদই অশান্তির মূল কারণ, আমি বললাম।
“হ্যাঁ”, সুসানা বলল, “ধর্মই বিশ্বব্যাপী বসতি উচ্ছেদ, শরণার্থী সমস্যা, হানাহানি আর রক্তপাতের মূল কারণ। অথচ শিশুদের কোনো ধর্মীয় বোধ নেই। নিহত শিশুদের অপরাধ— তারা ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেনি। মানুষের প্রতি মানুষের এমন আচরণ আমার লজ্জার বিষয়। ইহুদিরা প্রায় ছন্নছাড়া অসহায় মুসলিমদের ওপর অত্যাচার করছে— ইহুদি হিসাবে বিষয়টি আমাকে ভীষণ পীড়া দেয়।
“কিছু করার নেই”, আমি বললাম, “ ঐশ্বরিক মতবাদ যতদিন থাকবে হানাহানিও ততদিন থাকবে। এটি যেখান থেকে আসুক সঙ্গে কেবল লোভ, হানাহানি আর ঈর্ষা নিয়ে আসে। সর্বজনীন কল্যাণের কোনো কিছু এখানে নেই।”
কাল থেকে শুধু মনে ভাসছে ফিলিস্তিনি নিরীহ শিশুদের রক্তাক্ত দেহ। যখন শিশুদের মারছিল তখন তাদের অসহায় চোখ কী ভাবছিল— মানুষ হিসেবে তার জন্ম নিয়ে! কী ভাবছিল হত্যাকারীদের নিয়ে! ইসরাইলের মাটি মানব শিশুর রক্তে রঞ্জিত হলো ইহুদিদের দ্বারাই। এত শক্তি ইসরাইলের— শিশু মারতে হবে কেন? তাও আবার মুসলিমের মতো নিরীহদের! জোহাভা এত নৃশংস কেন?
রচনা বলল, পৌরাণিক কাপালিকদের শক্তির মাত্রা নরবলির ওপর নির্ভর করত। যত বেশি সংখ্যক নরবলি দেওয়া যাবে তত বেশি শক্তি সঞ্চিত হবে। ঐশ্বরিক মতবাদ কাপালিকীয়। এছাড়া তার টিকে থাকার উপায় নেই।
মাসাহিতো বললেন, আধুনিক বিজ্ঞানের যুগেও ঐশ্বরিক মতবাদ নিয়ে মানুষ, মানুষের ওপর কী জুলুমই না করে যাচ্ছে। মতবাদ আসার পর থেকে পৃথিবীতে হানাহানি বেড়ে গেছে। এর আগে এমন ছিল না। মতবাদ এসে ঘরে ঘরে আর জনে জনে যুদ্ধ লাগিয়ে দিয়েছে।
“আপনি অবাক হয়ে যাবেন কষ্টে”, সুসানা বললেন, “যদি ইহুদি-মুসলিম পরস্পর ঘৃণা আর হানাহানি দেখেন। পৃথিবীর সব ঘৃণা জড়ো করলেও তাদের পরস্পরের ঘৃণার কাছে তুচ্ছ হয়ে যাবে। সব সাগর-মহাসাগরের জল, এমনকি অতল মাটি পর্যন্ত ঘৃণায় রাতের মতো কালো হয়ে যাবে।
রচনা বলল, শৌর্য-বীর্য, প্রভাব-প্রতিপত্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, আত্মমর্যাদা প্রভৃতি বিবেচনায় বর্তমানে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী মুসলিম। তাদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে ইহুদি। খুব কষ্ট লাগে।
“রুগ্ণ দেহে ভাইরাসের আক্রমণ বেশি ঘটে”, মাসাহিতো বললেন, “ এরা এখন একা। কেউ নেই এদের সঙ্গে। প্রতিপক্ষ যতই ক্ষুদ্র হোক না, আক্রমণ হতে বাঁচতে হলে শক্তি, ঐক্য, বন্ধু আর বুদ্ধি প্রয়োজন, যা মুসলিম সম্প্রদায়ের নেই। পৃথিবীতে এখন ধর্ম কেবল দুটি— এক মুসলিম দুই বিধর্মী বা ননমুসলিম।”
আমি বললাম, অথচ একসময় পৃথিবীতে তাদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল।
সুসানা বললেন, সপ্তম শতক হতে ষোড়শ শতক পর্যন্ত প্রায় হাজার বছরের অধিক এশিয়া-ইউরোপে মুসলিমদের বেশ প্রভাব ছিল। তখন প্রভাব বিবেচনায় মুসলিমদের স্থান ছিল দ্বিতীয়। ইহুদিরা একটু সহানুভূতির জন্য পঞ্চদশ শতকেও মুসলিমদের দ্বারে দ্বারে ঘুরত। মুসলিমরা তখন তাদের অবহেলা করেছে। ঘৃণায় তাড়িয়ে দিয়েছে। এখন তারা বিশ্বসেরা। মুসিলমরা মধ্যযুগের তলোয়ার থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। অন্যরা তলোয়ার ছেড়ে বহু আগে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ধরেছে।
আমি বললাম, পৃথিবীতে খ্রিষ্টান দুই দশমিক দুই বিলিয়ন, যা মোট জনসংখ্যার সাড়ে একত্রিশ ভাগ। কিন্তু বিশ্বে তাদের প্রভাব তেত্রিশ ভাগ। মুসলিমের সংখ্যা প্রায় এক দশমিক সাত বিলিয়ন, যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার বাইশ দশমিক তিন দুই ভাগ। অথচ তাদের প্রভাব মাত্র চার ভাগ। হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা এক বিলিয়ন; এটি পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার চৌদ্দ ভাগের কম কিন্তু বিশ্বে তাদের প্রভাব বারো ভাগ।
মাসাহিতো বললেন, জোহাভাকে ধন্যবাদ দিতেই হয়।
তিনি কী করলেন আবার?
অনুসারীদের যে শক্তি দিয়েছেন— ধন্যবাদ। না-দিলে নিমকহারামি হয়ে যায়, কী বলেন— সুসানা?
সবই তার, সবই তিনি, সবই তার ইচ্ছা— এই তো ঐশ্বরিক মতবাদ। কিন্তু তাকে যে বেঁচে থাকার জন্য অনুসারীদের ওপর নির্ভর করতে হয়!
সুসানার কথার মাঝে আমার মোবাইলের রিং বেজে উঠে। মোবাইলের দিকে চোখ দিলাম। আলো জ্বলছে না। তার মানে মোবাইল নয়, কলিংবেল।
“কী মুশকিল”, আমি বললাম, “বাজে বেল মনে হয় মোবাইল!”
রচনা বলল, এই আওয়াজ যেভাবে আপনাকে চেতনার মাঝেও অচেতন রাজ্যে নিয়ে যায়, তেমনি আমাদের কলিংবেল বাজলেও আমাদের আপনার কাছে নিয়ে যায়। আপনার প্রতিটি আচরণ আমাদের সঙ্গে বাঁধা।
রচনার কথার সঙ্গে কথা লাগিয়ে কল্পনা বলল, এবং আপনার পরিবর্তন আমাদের পরিবর্তনের সঙ্গে একই চেইনে অবিচ্ছেদ্য। অতএব, আপনিই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য।