সন্মিত্রা: সপ্তবিংশ পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
আপু?” দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে টুটুল বলল, “মেহমান এসেছেন।”
ফাতিমা আর মুনওয়ারা বুঝি?
হ্যাঁ।
ঘড়ি দেখলাম।
হাতে আর বেশি সময় নেই। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে লুসি চলে আসবেন। লুসি মানে প্রফেসর স্টিভেন হকিং-এর বড়ো মেয়ে। ফাতিমা এবং মুনওয়ারা দুজনই আমার অপরিচিত। চোখে কৌতূহল নিয়ে রচনার দিকে তাকালাম। রচনা বুঝতে পারল আমি তাদের পরিচয় পেতে উৎসুক।
বলল, ফাতিমার পুরো নাম ফাতিমা বিনতে ইখওয়ান সাইদ। বাহরাইনে জন্ম। ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের লেকচারার। মুনওয়ারা গণিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, প্রফেসর মাইক গিলসের প্রিয় ছাত্রী। ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসার সময় গণিতও রেখে আসে। তাই সাহিত্যের ছাত্রীর মতো রসিক। চর্ম আর মর্ম দুটোই চমৎকার। ইউরোপীয়ানদের চেয়েও উদার, অমায়িক আর মার্জিত। অ্যারাবিয়ান মরুর একটা বালিও পাবেন না দেহমনের কোথাও। সব সবুজে সবুজে বনানী।
বালি এখন না-থাক, একসময় ছিল তো, না কি?
হয়তো বা।
“তাহলে আমি উঠে বসলাম”, বলেই রচনার কোল থেকে মাথা তুলে বসে পড়ি।
“এরা দুজনেই অত্যাধুনিক”, সুসানা বললেন, “ যেমন আছেন তেমন থাকেন।”
রচনা আর সুসানার কথা বিশ্বাস করলাম পুরোপুরি। তবু আগের মতো শুয়ে থাকার মনোবল পেলাম না। কোনো আসরে মুসলিম বা কোনো ধর্মীয় গুরু থাকলে সবাই কেন জানি অন্য রকম সতর্কতা গ্রহণ করে। তাদের হয়তো অনেকে শ্রদ্ধা করে, কিন্তু আপন মনে করে না। খুব ঘনিষ্ঠ হলেও মনে করে আগন্তুক। এদের মনে সর্বদা স্বর্গ-নরক কিলবিল করে।
নিজের আচরণ ছাড়া বাকি সব শাস্ত্রবহির্ভূত।
নিজের আচরণ ছাড়া বাকি সব শাস্ত্রবহির্ভূত।
ড্রয়িংরুমে বসতে বলো।
আমরা বেডরুমে। তাদের ড্রয়িংরুমে কেন?
ভাব্বা, সবাই যাচ্ছি।
রচনার কথা শেষ হওয়ার আগে মাসাহিতো আর সুসানা ড্রয়িংরুমের দিকে রওয়ানা দিলেন। তিন বোন আমাকে কাঠের গুঁড়ির মতো বিছানা থেকে টেনে তুলে কাঁধে চড়িয়ে সোজা ড্রয়িংরুম। আমি লজ্জায় জড়সড়ো হলেও ঘটনার আকস্মিকতায় কিছু বলতে পারলাম না। বলার বোধ আসার আগেই তার আমাকে ড্রয়িংরুমে আমার সংরক্ষিত আসনে বসিয়ে দিল। মনে হলো নতুন দুই মেহমানের কাছে আমার সংকোচ দূর করার কৌশল।
নতুনদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন সুসানা, অক্সফোর্ডের দুই মুসলিম প্রতিভা। দুজনে দাঁড়িয়ে ইসলামি কায়দায় সালাম দিলেন।
নিনি চা-নাশতা নিয়ে এল।
লন্ডনি কায়দায় সবার দৃষ্টি টেনে বলল, How nice the moment; dear friends, please take, freely.
নিনির দিকে তাকালাম। ঢাকার কঙ্কালসার ভিক্ষুক নিনিকে মনে হচ্ছে কোনো বহুজাতিক কোম্পানির চেয়ারম্যানের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী। শাড়ি পরেছে। ভালো ইংরেজি শিখে ফেলেছে। চমৎকারভাবে টেলিফোন রিসিভ করতে পারে, ঠিক লন্ডনি কায়দায়। উপাচার্য পর্যন্ত বুঝতে পারেন না নিনির উৎস।
তুমি তো নিনিকে পুরোদস্তুর ইংরেজ বানিয়ে দিয়েছ হে?
ভাব্বা, দেখতে হবে না মেয়েটা কার?
কার?
কার আবার, আপনার!
প্রমিতা কোথায়?
রাজ-রোজির সঙ্গে। ড. ডায়সন তাদের আরবি শেখাতে আসবেন। প্রমিতাও আরবি শিখছে।
ডায়সন কোন দেশের লোক? আমি জানতে চাইলাম।
খাজাকস্তান। খুব ভালো আরবি জানে। ফাতিমা আর মুনওয়ারার চেয়েও ভালো।
সুসানার চোখ টেলিভিশনে। বিবিসি বারবার ইসরাইলি সেনাদের ফিলিস্তিনি বসতি উচ্ছেদের খবরটা দেখাচ্ছে। খবর দেখে সুসানা অস্থির হয়ে পড়েছেন। যতবার খবরটি দেখাছে ততবারই লজ্জায় কুঞ্চিত হয়ে যাচ্ছেন। রচনা বিষয়টি টের পেয়ে টিভিটা বন্ধ করে দিল।
“এই যে মানুষের প্রতি মানুষের জুলুম”, সুসানা বললেন, “সব হচ্ছে ঈশ্বরের নামে। সবাই ঈশ্বরের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সবার উদ্দেশ্য একই, তাহলে এত হানাহানি কেন? কেন এত রক্তপাত। কাউকে অত্যাচারিত হতে দেখলে আমার মনে হয় সে আমার মা-বোন, বাবা-ভাই।”
আমি বললাম, পৃথিবীতে যত মানুষ আছে তাদের বেঁচে থাকার জন্য যা প্রয়োজন তা পর্যাপ্ত পরিমাণ রয়েছে। আশ্রয়ের অভাব নেই তবু লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। চিকিৎসার কোনো অভাব নেই তবুও বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে হাজার হাজার লোক। বাতাসে অক্সিজেনের অভাব নেই, আকাশে আলোর অভাব নেই, জলাশয়ে জলের অভাব নেই। তবু চারদিকে হাহাকার। জ্ঞানের মতো অবারিত বিষয়ের অভাবে অশিক্ষা ক্রমশ পৃথিবীকে গ্রাস করে ফেলছে। বস্ত্রেরও কোনো অভাব নেই, তবু পশুর মতো উলঙ্গ মানুষের ভিড়ে হাঁটা যায় না রাস্তায়। এর কারণ কী জানেন?
রচনা একটা আপেল আমার হাতে তুলে দিতে দিতে বলল, ভোগোগ্রতা এবং সভ্য মানুষের আরও সভ্য হওয়ার উন্মাদনাই এমন বর্বরতার প্রধান কারণ। সভ্যতা মানুষকে সঞ্চয় নামক দৈত্যের ক্রীতদাস বানিয়ে দিয়েছে।
সুসানা বলল, ঈশ্বরকে সৃষ্টি করার পর থেকে মানুষের লোভ বেড়ে গেছে। তাকে পুরো পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা হিসেবে প্রতিটি দলের ঈশ্বরই পৃথিবীর দখল নিতে চাইছে, কিন্তু কেউ বুঝতে চাইছে না যে, পৃথিবী একটা এবং এটিই সবার। পৃথিবীকে দখলে রাখতে হলে সবার উচিত পৃথিবীকে নিজের মনে করে তার প্রতিটি উপাদানের যত্ন নেওয়া। পৃথিবী আমাদের জননী। জননীর দখলের জন্য জননীকে নিয়ে টানাটানি করলে জননীই সবার আগে ধ্বংস হয়ে যাবে। কী হবে তখন মানব জাতির?
“যে ব্যবস্থায় অস্ত্র দিয়ে সবকিছু করা যায়”, রচনা বলল, “এবং অর্থ দিয়ে পার্থিব সব বস্তু কেনা যায়, সেখানে এমন বিষয়ই স্বাভাবিক। মানুষের হাতই মানুষের ঈশ্বর। মানুষের হাতের শক্তিই ঈশ্বরের শক্তি। মানুষের চিন্তা, বুদ্ধি আর বিবেচনা দ্বারা একতরফাভাবে তা প্রযুক্ত হয়। অনেকে তাই হাত বাড়াতে ব্যস্ত।”
মাসাহিতো বললেন, প্রভাব বিস্তারে সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ তেমন কিছু নয়। আধুনিক বিশ্বে কৌশলই আসল, প্রযুক্তিই কার্যকর শক্তি। কেউ যদি মধ্যযুগের তরোয়াল দিয়ে আধুনিক যুগে প্রভাব বিস্তার করতে চায়—তার কপালে খারাবি ছাড়া আর কিছু থাকতে পারে না।
আমি বললাম, প্যালেস্টাইন, কাশ্মীর, আফগানিস্তান, ইরাক, মায়ানমার, আফ্রিকা এসব রাষ্ট্রে কী হচ্ছে?
সুসানা বললেন, পৃথিবীর একশ সত্তর কোটি মুসলিম মাত্র এক কোটি চল্লিশ লাখ ইহুদির কাছে রাঁধুনির বঁটির তলায় পড়ে থাকা পুঁটি মাছ যেন। কী অদ্ভুত লাগে। তারা নিজেদের পরিবর্তনের কোনো চেষ্টাই করছে না। অথচ পরিবর্তনটা কঠিন কিছু না। মধ্যপ্রাচ্যে ষোলোটি মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রে মাথার সংখ্যা প্রায় তিনশ আটষট্টি মিলিয়ন। আয়তন প্রায় বাহাত্তর লাখ বর্গকিলোমিটার। ষোলোটি মুসলিম রাষ্ট্রকে মাত্র সাতাত্তর লাখ মাথার বিশ হাজার সাতশত সত্তর বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি ইহুদি রাষ্ট্র পুতুলের মতো নাকানি-চুবানি খাওয়াচ্ছে।
ফাতিমা বলল, এটি আমেরিকার ষড়যন্ত্র।
মুনওয়ারা বলল, ষড়যন্ত্র বা সহায়তা নয়, মূলকথা হচ্ছে জয়পরাজয়। যুদ্ধে কেবল জয়ই ন্যায়-অন্যায় নির্ধারণ করে। ষড়যন্ত্র স্বার্থের ক্রীতদাস। স্বার্থ আছে বলে আমেরিকানরা ইসরাইলের পক্ষে ষড়যন্ত্র করছে। এক কোটি চল্লিশ লাখ ইহুদি যদি মার্কিন ষড়যন্ত্রকে তাদের অনুকূলে নিয়ে যেতে পারে একশ সত্তর কোটি মুসলিম কেন পারছে না?
ইহুদিরা দিন দিন দেশের আয়তন বাড়িয়ে যাচ্ছে। এমনভাবে চলতে থাকলে, আগামী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য তো ইহুদির করতলে চলে। মুসলিমদের এমন অধঃপতনের যথেষ্ট কারণ আছে এবং তা সবাই জানে। তবু প্রতিরোধ করতে পারছে না।
কারণটা কী? ফাতিমা বলল।
অনৈক্য, সুসানার উত্তর। একতাবব্ধ হতে পারলেই হলো।
আর একটি আছে, মাসাহিতো বললেন।
কী?
আধুনিক বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে যথাযথভাবে অভিযোজিত হতে না পারা।
রচনা বলল, সপ্তম শতক থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বিশ্বে ইহুদিদের কোনো প্রভাবই ছিল না। ইহুদিরা কীভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়েছে তার একটি পরিসংখ্যান দেখা যেতে পারে, ১৯০১ থেকে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত নয়শ চার জন ব্যক্তি বিভিন্ন বিষয়ে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তন্মধ্যে দুশো জন ইহুদি। যা মোট নোবেল পুরস্কারের বাইশ দশমিক ছয় ভাগ। অথচ ইহুদির সংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক দুই ভাগেরও কম। মুসলমানদের মধ্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর সংখ্যা দশ। যা মোট নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর মাত্র এক ভাগ। অথচ সারা বিশ্বে মোট মুসলমানের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার বিশ ভাগ।
এত করুণ দশা কেন? ফাতিমা বলল।
সুসানা বললেন, প্রথমত তারা আধুনিক বিজ্ঞানে তত আগ্রহী নয়। বহু মেধাবী ধর্মীয় শিক্ষায় চলে যায়।
“ দ্বিতীয়ত তারা মুসলিম।”, সুসানা বললেন, “মুসলিমদের অন্য ধর্মাবলম্বীরা সাধারণত ভালো চোখে দেখে না।”