সন্মিত্রা: অষ্টাবিংশ পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
আমরা এত পিছিয়ে?
ফাতিমার প্রশ্নের উত্তরে মুনওয়ারা বলল, এত না, আরও বেশি।
কিন্তু কেন? সংখ্যায় আমরা দ্বিতীয়; প্রভাবে এত নিচে কেন?
পৃথিবীতে এমন দেশ খুব কম আছে, যেখানে মুসলিম আছে কিন্তু অন্তর্কোন্দল নেই। পাকিস্তান-আফগানিস্তানের দিকে তাকালে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়। যেখানে ধর্ম প্রবল সেখানে অন্তর্কোন্দলও প্রবল। নির্ভেজাল ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে একদল মুসলিম আরেক দল মুসলিমকে হত্যা করছে। মায়ানমারের দিকে তাকাও। তারপর অনুধাবন করো, মুসলিমরা কত অসহায়। আমরা কিছুই করতে পারছি না। ইহুদিরা নিরাপত্তায় এত দক্ষ হয়ে উঠেছে যে, পৃথিবীর বড়ো বড়ো দেশও নিরাপত্তার জন্য ইসরাইলের শরণাপন্ন হচ্ছে; আমাদের প্রতিবেশি সৌদি আরব। ইয়ামেনের যুদ্ধে মুসলিমরাই মুসলিমের রক্তখেকো। ইরাকেও একই অবস্থা ঘটেছে। ইরানেও এমন ঘটতে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের মোট আয়তনের এক ভাগ ভূমি ইসরাইলের, কিন্তু প্রভাব নব্বই ভাগ।
“অনেকে আবার বলে বসবেন”, সুসানা বলল, “আমেরিকা ইসরাইলকে সাহায্য করছে, তাই মুসলিমদের এ দুরবস্থা। আমেরিকা কেন মুসলিমকে সাহায্য করছে না। সাহায্য পাওয়ার যোগ্যতা যার আছে, সবাই তাকেই সাহায্য করে। আমেরিকার অনুগ্রহ নিয়ে অনেক মুসলিম রাষ্ট্র তাদের পদানত হয়ে আছে, তাবেদারি করছে। সাহায্য করবে কেন? অনুগ্রহ করে কাউকে দখল করা গেলে সাহায্যের মতো ব্যয়বহুল প্রকল্প কী প্রয়োজন! আমেরিকা তাদের সাহায্য করে যারা আমেরিকাকেও সাহায্য করতে পারে। জোহভাও তাদের সাহায্য করে, যারা নিজেদের সাহায্য করে। অতএব জোহাভা এবং আমেরিকার চরিত্রগত মিল দেখা যায়। মুসলিম এত বড়ো একটি সম্প্রদায়, তারা আমেরিকার বা অন্য কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে কেন? আমেরিকারই তাদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা উচিত। পুরো মধ্যপ্রাচ্য একটি একক দেশ হলে কী শক্তি তাদের হতো—বুঝতে পারছেন?
আমি বললাম, মুসলিমদের চিন্তাভাবনা আর দূরদর্শিতায় মারাত্মক গন্ডগোল। তারা সাতশ বছরের অধিক কাল ভারত শাসন করেছে, কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ভারতবর্ষে তাদের প্রভাব শূন্য হয়ে গেছে। শুধু অনার্য-ভূমি হিসেবে পরিচিত খুদে বাংলাদেশ ছাড়া ভারতবর্ষের আর কোনো রাষ্ট্রে মুসলিম প্রভাব নেই। আওরঙ্গজেব যদি তাঁর তিন ভাইকে বিতাড়িত করতে পারেন তো, তাঁর অনুসারীদের কী অবস্থা হয়েছে? মুসলিম শাসন অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। যদি সব মুসলিম ঐক্যবদ্ধ হয়ে শাসন করত তাহলে এখন উপমহাদেশের দ্বিতীয় প্রধান প্রভাবশালী ভাষা থাকত ফারসি-আরবি।
মুনওয়ারা বলল, আমরা গ্রহণোদারতায় অত্যন্ত দীন। ইহুদিদের প্রধান শত্রু মুসলিম, কিন্তু হিব্রুর পাশাপাশি মুসলিমের ভাষা আরবি ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের রাষ্ট্রভাষা। শত্রুকে দমন করতে হলে শত্রুর ভাষা আত্মগত করাই সবচেয়ে কার্যকর ও নিরাপদ কৌশল। তাই প্রত্যেক ইসরাইলির জন্য আরবি শেখা বাধ্যতামূলক।
“ইসরাইলই মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র উদার গণতান্ত্রিক দেশ”, মাসাহিতো বললেন, “যেখানে উপযুক্ত হলে একজন শ্রমিকের মতামতকেও মূল্য দেওয়া হয়, কিন্তু কোনো সন্ত্রাসীকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না। অথচ তারা ধর্মের কারণে শত শত মুসলিমকে হত্যা করছে। কী নৃশংস!”
সুসানা বলল, এটাই ধর্মের নিকৃষ্ট দিক।।
ফাতিমা বলল, তাদের এত প্রভাব কেন?
সুসানা বলল, বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তির আশি ভাগ ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে। বিশ্বের হোটেল ব্যবসার নব্বই ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে ইহুদি। পৃথিবীর প্রভাবশালী দশটি পত্রিকার নয়টির নিয়ন্ত্রণ ইসরাইলের হাতে। পৃথিবীর সবগুলো শ্রেষ্ঠ এবং গুরুত্বপূর্ণ বই হিব্রুতে অনূদিত হয়েছে। পরিবর্তনকে যুগোপযোগী রাখার জন্য নিউজিল্যান্ড এবং ব্রিটেনের মতো ইসরাইলেরও কোনো লিখিত সংবিধান নেই। যুগোপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণই তাদের সংবিধান। মোজেস কী বলেছেন তা রাব্বিদের বিষয়। সময়মতো পরিস্থিতি অনুযায়ী উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্তব্য। এ নিয়ে রাব্বিদের কোনো মাথাব্যথ্যা নেই।
রচনা বলল, মুসলিমদের বড়ো সমস্যা, সমালোচনা সহ্য করতে না পারা। সবচেয়ে বড়ো সীমাবদ্ধতা সমালোচনার পথ রুদ্ধ করে দেওয়া। বাক্স্বাধীনতা না থাকলে সৃজনশীলতা স্থবির হয়ে যায়। যেখানে অন্যরা সমালোচনাকে শিক্ষক মনে করে, সেখানে মুসলিমরা সমালোচনাকে মনে করে শত্রু। যারা সমালোচনা সহ্য করতে পারে না তাদের কোনো হালনাগাদ শিক্ষক থাকতে পারে না। অন্ধকার অতীতই তাদের শিক্ষক। যাদের শিক্ষক অতীত, তাদের ভবিষ্যন্নোয়নের সব পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
ভাব্বা, একটা ধাঁধা বলি, কল্পনা বলল।
বলো।
পৃথিবীর কোন দেশ মৃতকে জীবিত করতে পারে?
কোন দেশ?
ইসরাইল।
কীভাবে?
তারা মৃত হিব্রুকে শুধু জীবিতই করেনি। একদম যুবক করে ফেলেছে। এখন এটি পৃথিবীর অনত্যম জীবন্ত ও চঞ্চল ভাষার একটি। খুব কঠিন ভাষা।
মাসাহিতোর মোবাইলে রিং করলেন লুসি। তিনি ক্যাম্পাসে ঢুকে গেছেন। তার মানে কয়েক মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবেন।
“দেরি করা যাবে না”, মাসাহিতো বললেন, “কারও কোনো কাজ বাকি থাকলে সেরে নিতে পারেন।”
রচনা বলল, সবাই রেডি।
রচনার কথা শেষ হতে না হতে কলিংবেল বেজে উঠল। নিনি দরজা খুলে দিল। রুমে ঢুকলেন লুসি হকিং— স্টিভেন উইলিয়াম হকিং-এর মেয়ে। চমৎকার চেহারা। হাসি দিয়ে রুমটাকে আরও মোহিত করে দিলেন। ক্যামব্রিজে তাদের বাসায় আমাদের দাওয়াত। স্টিভেন হকিং সময় দেবেন কয়েক মিনিট। কৃতিত্ব মাসাহিতো, সুসানা আর রচনার।
লুসি বসতে না বসতে রিং এল আমার মোবাইলে।
বাংলাদেশ থেকে ঋধিতা।
হ্যালো, কেমন আছ?
রাখো তোমার কেমন আছ।
কী ব্যাপার?
শামীম, তুমি কি লন্ডনে বিয়ে করে ফেলছ?
এমন প্রশ্ন কেন?
কেটে রিং করো, আমার মোবাইলে ব্যালেন্স নেই।
রিং করে আবার সৌজন্য উক্তি, কেমন আছ?
লন্ডনে একসঙ্গে তোমার তিনটা বউ।
আমি চুপ।
কথা বলো না কেন?
আমি চুপ।
এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর তুমি দিতে পারবে না। কয় দিন হয় গিয়েছ? আমার সন্তানদের একটি বার রিং করেছ?
আমি চুপ।
তারা বুঝে না মনে করো? সব বুঝে। সন্তানদের রিং করনি কেন?
করেছি, কিন্তু আমার গলার আওয়াজ শুনে থ্যাংক ইউ বলে রেখে দিয়েছে।
তারা তোমার সঙ্গে কথা বলবে না।
কেন?
আমি নিষেধ করে দিয়েছি।
নিষেধ করার কারণ?
তুমি বাপ নও, ভাপ, ছোটোখাটো অভিশাপ। কষ্ট হচ্ছে?
না। বিবাহিত জীবনে স্বামী বা স্ত্রী কারো কষ্ট থাকতে নেই।
কেন?
একজনের কষ্ট দুজনকে কষ্ট দেয়।
আচ্ছা, তাহলে রাখি।