সন্মিত্রা: ত্রিংশ পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
হকিং-এর বড়ো ছেলে রবার্ট আমাদের স্বাগত জানালেন। লুসিই পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর সঙ্গে। ভদ্রলোকের প্রতিটি আচরণ মনকাড়া। তিনি আবার মাসাহিতোর ঘনিষ্ঠ। কনিষ্ঠ সন্তান টিমুথি ক্যামব্রিজের বাইরে।
আমরা হলরুমে গিয়ে বসলাম। আয়তনে বিশাল হলেও বেশ গোছানো। পুরো রুম বই আর যন্ত্রে ঠাসাঠাসি করছে। জড় না হলে ভয়ংকর অবস্থা হতো। প্রথমে আমাদের আপ্যায়ন করা হলো হালকা নাশতা দিয়ে।
নাশতা শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট পর যান্ত্রিক হুইল চেয়ারে করে হকিংকে আনা হলো। নিয়ে এলেন লুসি। পাশে রবার্ট। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানালাম। তাঁর সঙ্গে কীভাবে আলাপ করতে হবে এবং কী করতে হবে, লুসি আর রবার্ট শিখিয়ে-পড়িয়ে দিয়েছেন।
হকিং, ভয়ংকর এক দানবীয় যান্ত্রিক চেয়ারে সমাসীন। এত মারাত্মক যন্ত্র আমি আর দেখিনি। হকিং, হুইল চেয়ারের পিঠে এমনভাবে হেলে আছেন— মনে হচ্ছে একটি হাড়বিহীন মাংসপিণ্ড। মাথার খুলি না থাকলে চোখ-মুখ আর নাক-কান একাকার হয়ে যেত জলে ভেজা তুলতুলে নরম ময়দার মতো। তিনি পরেছেন কালো ব্লেজার। তার নিচে সাদা স্যুয়েটার। জুতো জোড়াও কালো। কালো রং তাঁর শরীরব্যাপী এত বেশি চকচক করছে মনে হলো— পুরো শরীর কালো হীরায় ঢাকা। অত্যন্ত দামি আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত হকিংকে এত ভালোভাবে নিরীক্ষণ করেও জীবিত মনে করার কোনো সূত্র খুঁজে পেলাম না। অবশ্য আমার ওই রকম মেধা কোনোকালে ছিল না। তিনি নড়ছেন কি না বোঝাই যাচ্ছিল না।
তিনি কী জীবিত? রচনাকে কানে কানে বললাম।
রচনা ফিসফিস করে বাংলায় বলল, শরীর মৃত, কিন্তু মস্তক প্রবলভাবে সজাগ। চোখের দিকে তাকান। কী তেজালো আর তীক্ষ্ণ খেয়াল করে দেখেন! আমরা কী বলেছি, তাও বুঝে নিয়েছেন।
খেয়াল করার জন্য তাকালাম। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে কিছুই ধরা পড়ল না। চোখ কি আসলে নড়ছে? চোখ কি জীবিত? তাও বোঝা গেল না। আমার চোখ নিশ্চয় রচনার চোখের চেয়ে কম দেখে।
জাপান হকিং-এর প্রিয় দেশ। ওই দেশে গেলে মাসাহিতোই সবচেয়ে কাছে থাকতেন হকিংয়ের। হকিং, কাজী নজরুল ইসলামের মতো মেয়েদের সঙ্গই প্রত্যাশা করতেন। এমন মৃত শরীরের মাঝে জীবিত হকিংকে দেখে আমার শরীর অনুপম অনুভূতিতে ভরে গেল। শিউরে উঠল ভয়ানক অনুভূতিতে। নড়াচড়া দূরে থাক, ভয়েস সিনথেসাইজার ছাড়া তিনি কথাও বলতে পারছেন না।
লুসি চেয়ারের পাশে গিয়ে বাবার মাথায় হাত দিলেন।
হকিং-এর শরীর থেকে বের হয়ে এল বোধগম্য আওয়াজ, অতিথিদের স্বাগত?
লুসি আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। সুসানা এর আগে তার অ্যান্টি ব্যালাস্টিক মিশাইল বিশেষজ্ঞ স্বামীকে নিয়ে কয়েকবার এসেছেন। হকিং সুসানার কাছে তার স্বামীর কথা জানতে চাইলেন।
রচনা বলল, আপনি বিজ্ঞানী, কিন্তু ধর্ম কী?
হকিং বললেন, ধর্মের আশ্রয় রাজশক্তি। বিজ্ঞানের আশ্রয় পর্যবেক্ষণ, যুক্তি, জ্ঞান, অবাধ বাক্স্বাধীনতা আর বাস্তবতা। বিজ্ঞান কাজ করে, ধর্ম ভোগ করে, সে জড়। বিজ্ঞান বলতে পারে, দেখাতে পারে; এর প্রায়োগিক কার্যকারতা আছে। ধর্ম বলে এবং ভবিষ্যতে দেখানোর আশ্বাস দেয়; তবে দেখাতে পারে না, সে স্রেফ কল্পনা। শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানই টিকে থাকবে। ধার্মিকদের বিজ্ঞানের আশ্রয়ে বেঁচে থাকতে হয়। বিজ্ঞানের কাছে ধর্ম নিরর্থক। বিজ্ঞান স্বাধীন। তাই সে সৃজনশীল এবং ক্রম পরিবর্তনের মাধ্যমে সুন্দর হয়, সমৃদ্ধ হয়, বিকশিত হয়। বিজ্ঞান সৃজনশীল। ধর্ম স্থবির।
আপনার ধর্ম? মাসাহিতো প্রশ্ন করলেন।
বিজ্ঞানই আমার ধর্ম। আমার ধর্মই পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করছে। এখানে হার্দিক কোনো বিষয় নেই। শক্তির হৃদয় থাকতে পারে না। ঈশ্বরকে অনেকে শক্তি বলেন। তাহলে হৃদয় কেন?
আমি বললাম, স্বর্গ-নরক?
যান্ত্রিক হাসিতে রুমটাকে গমগম করে দিয়ে হকিং বললেন, স্বর্গ এবং নরক যথাক্রমে বোধহীনদের আনুগত্য আদায়ের কৌশল।
তাহলে ঈশ্বর?
ঈশ্বর বলতে কিছু নেই। যদি থাকে, তাহলে ঈশ্বর কী করত পৃথিবী সৃষ্টির আগে? পৃথিবী কোনো ঈশ্বর সৃষ্টি করেনি। কোনো ঈশ্বরই আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারে না। মানুষের ভাগ্য মানুষই নির্ধারণ করে। বিজ্ঞান যারা বোঝে না তারাই সৃষ্টির রহস্য ব্যাখ্যায় ঈশ্বরকে নিয়ে আসে। বিজ্ঞান বিশ্ব সৃষ্টির যে ব্যাখ্যা দিয়েছে তাতে ঈশ্বরের ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়নি।
সুসানা বললেন, পৃথিবীর এমন বিস্ময়কর বিজ্ঞান যুগেও মানুষে মানুষে এমন হানাহানি কেন?
হকিং বললেন, ধর্ম যেখানে প্রবল চিন্তা সেখানে আড়ষ্ট। চিন্তা যেখানে আড়ষ্ট জ্ঞান সেখানে সীমিত। জ্ঞান যেখানে সীমিত হানাহানি সেখানে ভয়ংকর তো হবেই।
আপনার আনন্দ কী?
আমার তিন সন্তানের মুখ। আমার কাজ এবং আমার পরিবার।
আমাদের প্রতি কোনো উপদেশ? রচনা প্রশ্ন দিয়ে প্রশ্নমুক্ত বাক্যটি বলল।
শিশুদের জন্য লেখো। শিশুদের জন্য করো। শিশুরাই আগামী। শিশুরাই বর্তমানকে আগামীর সৃষ্টিতে মুখর রাখে।
বেশিক্ষণ থাকা গেল না। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট আসার সময় হয়ে গেছে। এর আগে হকিংকে তাঁর সেবক আর সহকারীগণ প্রস্তুত করে নেবেন। আমাদের দ্রুত বের হয়ে যেতে হবে।
বললাম, আপনি জে এন ইসলামকে চেনেন?
আমরা পরস্পর বন্ধু এবং শিক্ষক ছিলাম। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে ফেব্রুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন। আমি বয়সে তাঁর চেয়ে বছর তিনেক ছোটো। আমরা একসঙ্গে অঙ্ক করতাম। আমার কম্পিউটার লাগত, ক্যালকুলেটর লাগত। তাঁর লাগত না। তিনি নিজেই কম্পিউটার ছিলেন।
সময় শেষ। বের হয়ে এলাম হকিং-এর জগৎ থেকে আমাদের জগতে।
রচনা বলল, মানুষের বয়স বাড়লে যন্ত্রের ওপর নির্ভরতা বেড়ে যায়।
তা তো অবশ্যই।
পৃথিবী বুড়ো হয়ে যাচ্ছে।
কীভাবে বুঝলে?
পৃথিবীর বয়স বাড়ছে এবং ক্রমশ বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। যত বয়স বাড়ছে, তত বেশি বিজ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে । বুড়ো হলে মানুষ যেমন নির্ভর হয়ে পড়ে লাঠি, ওষুধ এবং অন্যের সেবার ওপর।
এতক্ষণ আমি কোথায় ছিলাম?
মাসাহিতো বললেন, আমারও একই প্রশ্ন।
ফাতিমা বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ লুসি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এবং ব্রহ্মাণ্ডের রহস্যতম প্রতিভার অদ্বিতীয় মানুষটিকে দেখার আর কথা বলার সুযোগ করে দিলে।
বাবা বলেন, মেয়েরাই পৃথিবীর রহস্যতম, এমনকি ব্রহ্মাণ্ডের চেয়েও।
মাসাহিতো বললেন, তিনি নারীর চেয়েও রহস্যময়। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে একুশ বছর বয়সে তাঁর মোটর নিউরন রোগ ধরা পড়ে। ডাক্তার বলেছিলেন, সর্বোচ্চ দুই বছর বাঁচবেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শক্তি কমতে কমতে এক সময় পুরোই নিশ্চল মূর্তি হয়ে পড়েন। তবু এখনো জীবিত।
ফাতিমা আমার কানে কানে বললেন, স্যার, হকিং নাকি আসলে অনেক আগে মারা গেছেন। এই শরীরটা তার প্রক্সি। এটি কি সত্য?
আমি জানি না।
হকিং-এর কম্পিউটার বাণী আমাকে এতই বিমোহিত করে রেখেছে যে, আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, তাঁর সঙ্গে দেখা করেছি। তাঁর কথা শুনেছি। মনে হয়েছিল, অন্য কেউ তাঁর হয়ে কথা বলছেন।
“ শোনো মেয়ে”, আমি বললাম, “পৃথিবীতে impossible বলে কিছু নেই।”
রচনা বলল, impossible শব্দের অর্থই তো স্যার, I’m possible। হকিং যদি অসুস্থ না হতেন, আমার তো মনে হয় তিনি এত বিখ্যাত হতেন না। তার সমস্ত চেতনা মাথায় গিয়ে জড়ো হয়েছে। ফলে একাগ্রতা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পেরেছে। লক্ষ লক্ষ লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে আমাদের চেতনা ধাবিত হয়। তাই কোনো লক্ষ্য ভালোভাবে লক্ষ করার সুযোগ হয় না।
আমি বললাম, সত্যজিত রায় ইমপসিবল-এর বাংলা করেছিল, আম পচে বেল।
আম পচে কি বেল হয়? মাসাহিতো হাসির সঙ্গে প্রশ্ন করলেন।
হয় না। তাই ইমপিসবলও হয় না।
মানুষের চিন্তা ক্ষমতার এক-সহস্রাংশও যদি একাগ্রতায় ফেলা যায়, তাহলে একজন মানুষ স্বাভাবিক মেধার অধিকারী একশ কোটি মানুষের সম্মিলিত মেধার চেয়েও অধিক সৃজনশীল হতে পারে। নিশ্চল হকিং-এর মেধা থেকে আমরা এই শিক্ষা পেতে পারি। তাঁর আইকিও স্কোর ছিল একশ ষাট। আইনস্টাইনের একশত পঁচাত্তর।
“আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে”, রচনা বলল, “পৃথিবীর সর্বোচ্চ আইকিউ স্কোরধারীগণও এত বিখ্যাত নন। অস্ট্রেলীয়-মার্কিন গণিতজ্ঞ টেরেন্স টাউ -এর আইকিউ স্কোর দুশো ত্রিশ। আইনস্টাইনের প্রায় দ্বিগুণ। তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ। এ পর্যন্ত তাঁর স্কোর কেউ ডিঙাতে পারেনি “
দ্বিতীয় স্থানে কে? মুনওয়ারা বললেন।
ম্যারিলিন ভস স্যাভ্যান্ট। তাঁর স্কোর দুশো আটাশ। তিনিই পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান মহিলা। স্কোরের তফাত মাত্র দুই। তিন নম্বরে ক্রিস্টোফার হিরাতা। তিনিও মার্কিন নাগরিক।
মুনওয়ারা বললেন, সব উচ্চ আইকিউধারী কি আমেরিকান?
আমি বললাম, তাই তো দেখা যাচ্ছে।
“মনে হয়”, মাসাহিতো বললেন, “ঈশ্বর আমেরিকাকে খুব ভালোবাসে।”