সন্মিত্রা: একত্রিংশ পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
হকিং অবাক হয়ে গিয়েছিলেন বিশ্বব্যাপী “অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম” বইটির বিক্রি আর জনপ্রিয়তা দেখে।
“বইটি আমি পড়িনি”, সুসানার কথা শেষ হওয়ার পর মুনওয়ারা বলল।
কেন? জানতে চাইলেন ফাতিমা।
এত বহুল বিক্রীত বই সাধারণত সাধারণ মানের হয়। সাধারণ লোকজন কেবল মনোরঞ্জনের জন্য এসব বই পড়ে থাকেন। বিষয়ভিত্তিক গবেষণাধর্মী কোনো বই এত বিক্রি হয় না। জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতো কঠিন বিষয়ের ক্ষেত্রে তা আরও সত্য। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর গবেষণামূলক লেখা বোঝার মানুষ সারা বিশ্বে সর্বোচ্চ – – –
“এক লাখের বেশি হবে না”, মুনওয়ারার কথা শেষ হওয়ার আগে মাসাহিতো বললেন, “হকিং অবাক হলেও আমি কিন্তু অবাক হইনি।”
কেন?
সায়েন্স ফিকশন শিশু-কিশোর আর সাধারণ পাঠকদের কাছে সবসময় জনপ্রিয়। হকিং-এর মতো বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীর লেখা হলে তো কথাই নেই। বলা হয়— বইটি প্রায় দশ কোটি কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। ‘ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ যদি জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে লেখা গবেষণামূলক বই হয়, তাহলে সাধারণ পাঠকের পক্ষে এর মর্মার্থ বোঝার কথা নয়। না বুঝলে কেউ ওই বই কেনে না। দশ কোটি বই বিক্রি হয়েছে— মানে পৃথিবীতে দশ কোটি জ্যোতির্বিজ্ঞানী আছে। এটি কী বিশ্বাসযোগ্য? সারা পৃথিবীতে জ্যোতির্বিজ্ঞানীর সংখ্যা বিশ হাজারের বেশি হবে না। সব জ্যোতির্বিজ্ঞানী একটি করে বই কিনলে বিক্রি হয় বিশ হাজার। কিন্তু দশ কোটি বই কীভাবে বিক্রি হলো? তার মানে এটি বিজ্ঞান নয়, কল্পকাহিনি। জে এন ইসলামের ‘The Ultimate Fate of the Universe’ জ্যোর্তিবিজ্ঞানের বই। তাই এটি সাধারণের বোধগম্যের বাইরে ছিল। এজন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের বাইরের লোকজন বইটি কেনা দূরে থাক, নামও জানে না। অথচ, পৃথিবীর সব বিশ্বতত্ত্ববিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের বইটি কিনেছেন। পৃথিবীর সব নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে এটি পাঠ্য।
কথার মাঝখানে রুমে ঢুকল প্রমিতা। থিসিসের তথ্য সংগ্রহের জন্য তার দেশে যাওয়ার কথা। চোখে তাড়াহুড়ো। ব্যস্ততায় পড়লে তার চেহারা আকাশের মতো রহস্যময় সুন্দরে ভরে যায়। সে জরুরি কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু আমাদের আলাপের মাঝে বলাটা শোভনীয় মনে করছে না। রচনা তার পিএইচডির গাইড। খুব সমীহ করে। কারও প্রতি সমীহটা খুব হয়ে গেলে শ্রদ্ধার ঊর্ধ্বাংশের সিংহভাগই ভয়ে পরিণত নয়। অনেকটা পানি জমে বরফে পরিণত হওয়া। প্রমিতারও তা হয়েছে। রচনাকে দেখলে জড়সড়ো হয়ে যায়।
প্রমিতা বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। বলতে চাইছে— স্যার, আমাকে একটু কথা বলার সুযোগ করে দিন।
আমি তার মনের কথা পড়ে নিলাম।
কিছু বলবে?
আজ আমার ফ্লাইট।
“ঠিক আছে, যাও”, রচনা বলল, “তথ্য-উপাত্ত যেভাবে সংগ্রহ করতে বলেছি ঠিক সেভাবে করবে। প্রাইমারি ডাটা যত বেশি দেবে, তোমার থিসিস তত বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাবে। সেকেন্ডারি তথ্যনির্ভর থিসিস আমি গ্রহণ করব না। আমার যাচাই করা থিসিস হতে হবে অদ্বিতীয়। ”
প্রমিতা চলে যাওয়ার পর মাসাহিতো বললেন, হকিং-এর অসুস্থতা তাঁর খ্যাতির অনুকূলে কাজ করেছে। যত না কাজ করেছে প্রতিভা। এটি মানুষের সহানুভূতি টেনেছে।
“জে এন ইসলামের প্রতিভা, সৃষ্টি এবং অবদান স্টিভেন হকিং-এর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।” সুসানা বললেন, “কিন্তু প্রচার মোটেই পাননি। বোস-আইনস্টাইন তত্ত্বের ওপর গবেষণা করে তিন জন বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পেলেন— বোসের ভাগ্যে জুটল না। হকিংকে নিয়ে চৌদ্দোটি চলচ্চিত্র ও ধারাবাহিক হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানের পুরস্কার পেয়েছে অর্ধশতাধিক। এগুলো তাঁকে খ্যাত হতে সাহায্য করেছে। এটি করেছে স্টিভেন হকিং-এর দেশ এবং ইংরেজিভাষী। জে এন ইসলামের বাংলাদেশ এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন তাঁর জন্য কিছুই করেনি।
আমি বললাম, একুশে পদক দেওয়া হয়েছে।
ভাব্বা, এটি মহারানি ভিক্টোরিয়ার গলায় বেলি ফুলের মালা দেওয়ার মতো। পদক দিয়ে জামাল নজরুল ইসলাম নয়, বাংলা একাডেমিই সম্মানিত হয়েছে। কিছু কিছু মানুষের পায়ে চুমো খাওয়াও পুজো পাওয়ার চেয়ে সম্মানের। বাংলাদেশের স্কুল-কলেজে পঠিত বিজ্ঞানের বইয়ে হকিংকে আইনস্টানের তুল্য করে উপস্থাপন করা হয়েছে, কিন্তু জামাল নজরুল ইসলামের নামটা পর্যন্ত কোথাও রাখা হয়নি। বাঙালিরা আসলে নিকৃষ্ট একটা জাতি। পিতৃহন্তা জাতি আর কত ভালো হয়।
“ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বীয় কসমোলজি কেন্দ্রে হকিং-এর আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে।”, সুসানা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনারা জে এন ইসলামের জন্য কয়টা করেছেন, স্যার? দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে ‘আফ্রিকান ইনস্টিটিউট অব ম্যাথম্যাটিক্যাল সায়েন্স’-এর সামনেও হকিং-এর আবক্ষ মূর্তি আছে। জে এন ইসলাম ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে ক্যামব্রিজ থেকে বাংলাদেশ চলে গিয়েছিলেন। আমার মনে হয়, না গেলে ভালো করতেন। বাংলাদেশ কিছু পাক বা না পাক পৃথিবী আর একজন আইনস্টাইন পেতেন। জামাল নজরুল ইসলাম বাংলাদেশে গিয়ে পৃথিবীকে বঞ্চিত করেছেন। দেশের জন্য পৃথিবীকে বঞ্চিত করা মোটেও উচিত হয়নি। “
রচনা বলল, তিনি মনে করেছিলেন, মুসলিম হিসেবে যে বঞ্চনার শিকার তাঁকে ব্রিটেনে হতে হচ্ছে, নিজ দেশে তেমন হতে হবে না। কিন্তু তিনি কি জানতেন দেশে তাঁর জন্য আরও ভয়াবহ দুর্যোগ অপেক্ষা করছিল! মুসলিমরা নিজেদেরই নিজেদের সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত করে।
“হকিং প্রতিভাবান”, মাসাহিতো বললেন, “জে এন ইসলাম তাঁর চেয়েও প্রতিভাবান। পার্থক্য হচ্ছে, হকিং জগদ্বিখ্যাত, কিন্তু জামাল নজরুল ইসলাম তা নয়। একজন অবতার আর আমার মধ্যে পার্থক্য কি জানেন?”
কী? ফাতিমা বলল।
অবতার যা বলেন তা হাজার হাজার লোক বিশ্বাস করে, তা যথার্থ হোক বা না হোক। আর আমি যা বলি তা দুই-একজন মানে ও জানে। যদিও তা সর্বদা যথার্থ হয়।
সুসানা বললেন, ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে রজার পেনরোজের সঙ্গে মিলে হকিং, আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে একটি নতুন মডেল তৈরি করেছিলেন। এই মডেলের ওপর ভিত্তি করে হকিং, পেনরোজ-হকিং তত্ত্ব প্রমাণ করেন। এই কাজে আর একজন লোক ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের জে এন ইসলাম। অথচ কোথাও তাঁর নাম রাখা হয়নি। কৃষ্ণবিবর নিয়ে হকিং-এর চেয়ে জে এন ইসলামের কাজ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটি পাশ্চাত্যের সব বিজ্ঞানীই জানতেন। কিন্তু তারা বাংলাদেশি অধিকন্তু মুসলিম কাউকে এই কৃতিত্ব দিতে রাজি ছিলেন না। রাজি থাকবেনই বা কেন, আগে ঘর, তারপরই তো পর।
“তাঁর ওপর প্রচণ্ড অবিচার করা হয়েছে”, আমি বললাম, “শুধু বিদেশে নয়, দেশেও।”