সন্মিত্রা: দ্বাত্রিংশ (৩২) পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
ভাব্বা?
কল্পনার গলা।
আমি তখনো শুয়ে। পাশে রাজ-রোজি। তারা ঘুমিয়ে। রচনা শিয়রে বসে গল্প-কথার সঙ্গে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করে রচনার কথা শুনছিলাম। কল্পনার আওয়াজ পেয়ে চোখ খুলে আবার বন্ধ করে নিলাম। সে টের পায়নি। আমার পা দুটির ওপর দুহাতের আদর চাপের সাদর মমতা ঢেলে পা দুটো টেনে নিয়ে গা ঘেঁষে বসে পড়ল। ঢাকার বাসায় এখন আমার মেয়েটিও এই কায়দায় বসে। যদিও দুজনের বয়সের ফারাক অনেক।
ভাব্বা, আবার ডাক দিল কল্পনা।
রচনা ফিসফিস করে বলল, চুপ! স্যার ঘুমাচ্ছেন।
তুমি কথা বলছিলে না এতক্ষণ?
কথা নয়, গল্প করছিলাম।
গল্প কি কথা নয়?
গল্প আর কথা এক নয়। যেমন এক নয় আদর আর গালি, উপন্যাস আর কাব্য, আদর আর শাসন। গল্প শুনতে খারাপ লাগে না। কথা শুনতে অনেক সময় খারাপ লাগে।
গালিও এক প্রকার কথা। গল্পও এক প্রকার কথা।
তবে এক নয়। আমি ঘুমপাড়ানি গল্প করছিলাম। এ তিন জনে করা যায় না। তুমি ওসব বুঝবে না। আরও বড়ো হও। এখন যাও তো।
কল্পনা প্রতিবাদী। সে যখন প্রতিবাদ করে তখন ঝড় ওঠে। এ মুহূর্তে ঝড় তুলে সে আমার বিশ্রামে ব্যাঘাত আনতে চাইল না। আমার মুখ দেখে বুঝে নিল, আমি নীরবতা চাইছি। তাই চুপ থেকে আমার পা টিপে যেতে লাগল।
এতক্ষণ কথা বলছিল রচনা। আমি নীরব একাগ্রতায় শুনে যাচ্ছিলাম। রচনা বলছিল তার অতীত। আমি শুনছিলাম বর্তমানে বসে। কথা অতীতকেও বর্তমানে নিয়ে আসতে পারে। আসলে আমি শুনছিলাম না কি আমিও তার মতো অতীতে চলে গিয়েছিলাম জানি না। কল্পনা আসায় রচনার কথা থামল, কিন্তু আমার চিন্তার জোয়ারের আবেগ আরও প্রবল হয়ে উঠল। কথা বন্ধ হলে চিন্তারাশি মেঘের মতো অস্থির হয়ে যায়— মাথায় কিলবিল করে গরম জলের অণুর মতো। এজন্য লেখকদের কাছে একাকিত্বই কাম্য হয়। তারা একা হলে সঙ্গবন্যায় প্লাবিত হওয়ার সুযোগ পায়।
এতক্ষণ ছিল রচনা এখন যুক্ত হয়েছে কল্পনা। কল্পনা আসায় ভাবনা আমার আরও ঘনীভূত হলো। রচনার প্রাণ কল্পনা। কল্পনা ছাড়া কেউ কি রচনা করতে পারে? চোখ বন্ধ রেখে আমি মন খুলে মনে মনে আমাকেই প্রশ্নটা করলাম। মেয়েটা শুধু তার নামের মতো কল্পনা নিয়ে আসে।
চোখ খুলে বললাম, কল্পু, তোমার পাগলা দাদু কেমন আছেন?
ভালো।
নতুন কোনো তত্ত্ব দিয়েছেন?
দিয়েছেন। দ ধ-তত্ত্ব।
এটা এবার কী? দ ধ-তত্ত্ব মানে দরিদ্র ও ধনী তত্ত্ব। গরিবের কষ্ট অল্প হলেও সবাই বোঝে, কিন্তু ধনীদের কষ্ট কেউ বোঝে না। ধনী হওয়ার কষ্ট অধনীরা জানে না। তাই তারা ধনী হওয়ার জন্য এত উন্মাদ। ধনীরা ধনের শিকলে এত প্রবলভাবে বাঁধা থাকে যে, শত চেষ্টা করেও ছিঁড়তে পারে না। যদি ছিঁড়তে পারত তাহলে পৃথিবীর সব ধনীই দরিদ্র হয়ে যেত। উভয়ে অভাগা। ধনীদের মৃত্যুভয় এত ভয়ানক যে, সারা পৃথিবীর সব দরিদ্র মানুষের মৃত্যু একীভূত করলেও এত ভয়াবহ হবে না।
কানের কাছে মোবাইল বেজে উঠল। রচনা মোবাইলে চোখ দিয়ে মুখে হাত দিল। মানে ঋধিতা রিং করেছে ঢাকা থেকে। সবাই চুপ মেরে গেল। আমি মোবাইল নিলাম। ঋধিতা কী বলবে এবং কীভাবে বলবে, জানা আছে। স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনের কথোপকথন একশ শব্দ দিয়ে ভালোভাবে চালিয়ে নেওয়া যায়। বাকি সব শব্দ সৃষ্টি হয়েছে বিবাহপূর্ব আলাপ এবং বিরহের জন্য।
ঋধিতা বলল, কোথায় তুমি?
রচনার বাসায়।
হকিং কী বলেছে?
তোমাকে দেওয়ার জন্য ভালোবাসা বা সময় কোনোটাই মানুষের থাকবে না, যদি তুমি সবসময় রেগে থাক কিংবা অভিযোগ নিয়ে বসে থাক।
বাজে কথা বলো না, আসল কথা বলো।
নারী মাত্রই রহস্যের ভান্ডার নিয়ে জন্মায়। এই রহস্য প্রকৃতির রহস্যের চেয়ে অপরিসীম। প্রকৃতির রহস্য নারীর রহস্যের গহ্বরে তলিয়ে যায়।
হকিং-এর চেয়ে ভালো কী বলবেন? সে তো আর বিজ্ঞানী নয়। তোমার মতো একজন কল্পকাহিনির লেখক মাত্র। পার্থক্য এই— তাঁর বই কোটি কোটি বিক্রি হয়, তোমার বই গুদামে পড়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত টোঙাওয়ালার কাছে যায়।
একমত।
শুনেছি হকিং বিশ বছর আগে মারা গেছে। আচ্ছা, তুমি রচনাদের বাসায় থাক, তিন তিনটা যুবতি মেয়ে। তোমার লজ্জা করে না? তোমার জায়গায় আমি হলে ফুটপাতে থাকতাম। সবকিছুর একটা সীমা থাকা উচিত। তুমি কেন ওই দেশে যাও আমি বুঝি না? লুচ্চামি করার জন্য। তোমাকে আর কখনো আমি ইংল্যান্ড যেতে দেব না।
ঠিক আছে দিও না।
তুমি কী করছ?
তোমার সঙ্গে কথা বলছি। এসব ফাতরামি না করে তাড়াতাড়ি চলে এসো। মেয়েগুলোকে শান্তিতে থাকতে দাও। আর কত পাপ করবা, বয়স তো কম হচ্ছে না; এক পা তোমার কবরে ঢুকে গেছে।
হকিংও ঠিক এই কথা বলেছেন।
কী বলেছেন?
রিয়েলিটির কোনো ইউনিক পিকচার নেই। দৃষ্টিভঙ্গির ওপর এটি নির্ভর করে। কাপড় যদি ধর্ষণের কারণ হতো, তাহলে প্রত্যেক শিশুই ধর্ষিত হতো। বোরকা যদি নৈতিকতার উৎস হতো তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে এক পুরুষের একসঙ্গে এতগুলো বউ থাকত না।
রাখ তোমার হকিং বাণী। তোমার প্রিয়তমা রচনাকে মোবাইলটা দাও।
মোবাইলটা রচনার হাতে দিয়ে আমি অপ্রয়োজনে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। মানুষ সাধারণত মল-মূত্র ত্যাগ বা নিজেকে পরিষ্কার করার জন্য বাথরুমে ঢোকে। কিছু কিছু দার্শনিক বাথরুমে ঢুকে নিজেদের আবিষ্কার করার জন্য। আমি কোনোটা করার জন্য ঢুকিনি। অজুহাতকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য ঢুকেছি। তিন-চার মিনিট পর কথা শেষ হলো। আমি বের হয়ে এলাম। রচনা আমার হাতে মোবাইলটা দিল।
ঋধিতা বলল, তোমার প্রিয়তমাকে বলেছি।
কী বলেছ?
ক্ষুধার্ত হায়েনাকে বিশ্বাস করা যায় কিন্তু কোনো পুরুষকে নয়। এমনকি লাশ হলেও, বাপ হলেও। তোর শামীম স্যার, ষাঁড়ের চেয়ে জঘন্য। আমার পুরুষের কবরের পাশ দিয়ে যেতেও ভয় করে। খবরদার, একদম বিশ্বাস করবা না।
ভিএস নাইপল বলেছেন— তিনি কখনো নিজের জীবনী লিখবেন না।
কেন লিখবেন না?
নিজের সবকিছু মানুষকে জানিয়ে দিলে নিজের বলে কিছু থাকে না। যার গোপন বিষয় গোপন থাকে না, তার পোশাকের দরকার কী? লজ্জা নিবারণ আর রুচিবোধের পরিচায়ক হচ্ছে পোশাক আর কথা হচ্ছে ব্যক্তিত্বের ধারক। যার-তার সব কথা বলে ফেলা মানে উলঙ্গ শরীরে মাছের বাজারে যাওয়া।
ঋধিতা বলল, তাই তো তোমাকে বরাবর আমি উলঙ্গ পাই। কল্পনাকে দাও।
মনে মনে ভাবলাম— তাকে দেওয়া উচিত হবে না। কল্পনা, রচনা নয়। সে মুখের ওপর উচিত জবাব দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হবে না। তাদের কিছু হবে না, শেষ পর্যন্ত বিপদটা যাবে আমার ওপর। শিল-পাটায় ঘষাঘষি, মরিচ ব্যাটার গলায় ফাঁসি।
বললাম, সে কলেজে চলে গেছে।
এত সকালে?
অক্সফোর্ডে সকাল-বিকাল নেই।
কল্পনা মেয়েটা একটা আস্ত বেয়াদব। বেশি কথা বলে। এই বয়সে এত কথা কীসের? এর চরিত্রের দোষ আছে। পেলে এক চপেটাঘাতে বত্রিশ দাঁত ফেলে দেব মাগির।
হকিং কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেছেন।
কী কথা?
পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় সৃষ্টি মেয়ে।
এজন্য মেয়ে দেখে পুরুষেরা পাগল হয়ে যায়। পুরুষরা ব্যক্তিত্ব দাবি করে, মেয়ে দেখলে উলঙ্গ হতে তিন মিনিট লাগে না। শোয়ার জায়গা হলেই চলে। আর কোনো কারণ লাগে না। এমন নিকৃষ্ট জীব সৃষ্টিতে আর নেই। আই হেট পুরুষ।
এটা কী আমার জন্য না সব পুরুষের জন্য?
লাইন কেটে গেল।