সন্মিত্রা: পঞ্চত্রিংশ (৩৫) পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
দৌড়ে এসে পা ছুঁয়ে শ্রদ্ধা জানাল প্রমিতা দাস লাবণী। উচ্ছ্বাসের মমতায় জড়িয়ে ধরে বলল, “স্যার, আই রেসপেক্ট ইউ, লাভ ইউ, লাভ ইউ ভেরি মাচ।”
আমার কলকাতা আসার খবর রচনাই তাকে দিয়েছে। বলে দিয়েছে—আমি কত তারিখ কোন উড়োজাহাজে কলকাতা পৌঁছব এবং কখন কোন হোটেলে উঠব। জানতাম প্রমিতা আসবে, কিন্তু রুমে ঢোকার এত অল্প সময়ের ব্যবধানে যে, চলে আসবে তা ভাবিনি।
মনে হলো প্রমি নয়, রচনাই আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। কথার ভঙ্গি পর্যন্ত রচনার। এমনকি হাসিটা পর্যন্ত। তাকে সবাই ডাকে লাবণী। আমি ডাকি প্রমি।
তুমি একা এসেছ? তার সাদর আদরে স্নেহ ঢেলে বললাম।
বাবাও এসেছেন। তিনি এসেছেন কাজে। আপনাকে নেমন্তন্ন করতে।
কোথায়?
রিসেপশন রুমে।
আসতে বলো।
অফিসের কয়েকজন লোক আছে। তাদের বিদায় করে আসবেন।
ধনী লোক জাস্ট ঢেঁকির মতো। মক্কা গেলেও ধান ভানতে হয়। তো, তোমার তথ্য সংগ্রহ কেমন চলছে?
স্যার, সব শিয়ালের একই রা।
যদি কোনো শিয়াল ডাকতে অক্ষম হয়?
তারপরও ডাকার চেষ্টা করে। এ ডাক আরও ভয়ানক। অজ্ঞের প্রতিবাদ সর্বদা পাশব হয়। অজ্ঞ মানুষ আর বুনো জানোয়ার অভিন্ন। আমি ভাবতাম হিন্দুদের মধ্যে গোঁড়ামি কিছুটা কম। ওমা, শেষমেষ দেখলাম ধারণাটা সঠিক ছিল না।
কী হয়েছে?
গতকাল একদল নারীপুরুষ আমাকে বধূ হওয়ার যোগ্য কি না যাচাই করতে এলেন। হবু বরের নাম বিমল রায়। বাবার বন্ধুর ছেলে। আমেরিকা থেকে তড়িৎ প্রকৌশল বিদ্যায় মাস্টার্স। কথা শুরু হলো কেমন আছেন দিয়ে। কিছুক্ষণ পর, বের হয়ে এল আসল রূপ।
আসল রূপ মানে?
রায় বাবু বললেন, লাবণী, আপনার প্রিয় ব্যক্তি কে?
তুমি কী বললে?
আপনার নাম বললাম। নাম শুনে বিমল বাবুর নাক-মুখ কুঁচকে ফোসকা। যেন বর মশাইকে আমি থাপ্পড় দিয়েছি।
বললেন- – –
কী বললেন?
মুসলিম কীভাবে হিন্দুর প্রিয় ব্যক্তি হয়? “কেন, অসুবিধা কী?” বললাম, “আমার মায়ের প্রিয় ব্যক্তি এপিজে আবদুল কালাম।” বিমল বাবু বললেন, “মুসলমান মাত্রই অস্পৃশ্য যবন, ছোটোলোক। তারা গোমাংস ভক্ষণ করে, দেব-দেবী মানে না, বেদ মানে না। তারা মলের চেয়েও নিকৃষ্ট।” আমি বললাম, “আটশ বছর মুসলিমরা ভারত শাসন করেছে। তখন হিন্দুরা মুসলিম রাজা-বাদশাদের চাকর ছিল। তাদের স্নেহধন্য হওয়ার জন্য লাখ লাখ ব্রাহ্মণ রাজপদতলে পৈতা পেতে বসে থাকত।” বিমল রায় বললেন, “ওভাবে অভিযোজিত হয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করেছিল বলেই ইংরেজ আসার পর আমরা মুসলিমদের গোলাম বানিয়ে রাখতে পেরেছি। এখন তাদের কোথাও অস্তিত্ব আছে?”
“বিমল বাবু তো ঠিকই বলেছেন।”, আমি বললাম, “আবুল মনসুর আহমেদ, নাম শুনেছ?”
আমার রাজনীতির পঞ্চাশ বছর বইয়ের লেখক।
হ্যাঁ। তিনি লিখেছেন, “জমিদাররা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব প্রজার কাছ থেকে কালীপূজার মাথট আদায় করিতেন। এটা খাজনার সাথে আদায় করা হইত। খাজনার মতোই বাধ্যতামূলক ছিল। না দিলে খাজনা নেওয়া হইত না। ফরাজি পরিবারের ছেলে হিসাবে আমি গোঁড়া মুসলমান ছিলাম। মূর্তি পূজার চাঁদা দেওয়া শেরেকি গোনা। এটা মুরুব্বিদের কাছে শেখা মাসলা। কিন্তু মুরুব্বিরা নিজেরাই সেই শেরেকি গোনা করেন কেন? এ প্রশ্নের জবাবে দাদাজি, বাপজি, চাচাজি বলিতেন: না দিয়া উপায় নাই। এটা রাজার যুলুম। রাজার যুলুম নীরবে সহ্য এবং গোপনে আল্লাহর কাছে মাফ চাওয়া ছাড়া উপায় নাই ।”
স্যার, বিমল বাবু লোকটা খুব গোঁড়া এবং ভীষণ মৌলবাদী। বলে কী— “উপমহাদেশে মুসলিমরা এখন সর্বভারতে ক্রীতদাসের চেয়েও তুচ্ছ। সারা বিশ্বে সব ধরনের মানুষের কাছে মুসলিমরা অস্পৃশ্য। আর আপনি এমন নিকৃষ্ট জাতের একজনকে বানিয়েছেন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। লাবণীজি, বিড়ালের বংশে কখনো বাঘ জন্মায় না।”
আমি কী বলেছিলাম জানেন স্যার?
কী বলেছিলে?
বলেছিলাম, “বাবু মশাই তিনি শুধু আমার প্রিয় ব্যক্তি নন, আমি তাঁকে ভালোবাসি।” প্রশ্ন করলেন, “কেমন ভালোবাসেন?” বলেছিলাম, “আমাকে আমি যেমন ভালোবাসি ঠিক তেমন। একজন মানুষ তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে যেমন ভালোবাসে তেমনি। আপনার সঙ্গে বিয়ে হলে আপনাকে যেমন ভালোবাসব তেমনি।” আমার কথা শুনে বিমল বাবুর মুখটা মেঘের আষাঢ়। চোখে হতাশার ঝড় এনে মিনমিনে গলায় বলেছিলেন, “ছি ছি! হিন্দু রমণীর মুখে এ কী কথা!”
বাবা বললেন, “তিনি লাবণীর শিক্ষক।” বিমল বাবু উত্তর দিলেন, “শিক্ষক হোক আর যাই হোক, যবন মাত্র ঘৃণার্হ।” বাবাকে বললাম, “এটা বর, না কি জ্বর? তিনি তো মানুষ নন, উচ্চশিক্ষিত বলদ। আমেরিকায় কী শিখেছেন? একটা বলদ নিয়ে এসেছেন আমার জন্য? আমার কথা শুনে অতিথিদের চেহারা লাল হয়ে গেল।” বাবা হাসতে হাসতে বলেছিলেন, “কিছু মনে করবেন না। মেয়ে আমার তাঁর খুব ভক্ত।” বললাম, “বাবা, এদের সঙ্গে আর কোনো কথা নেই। অতিথি নারায়ণ। খাইয়ে বিদায় করে দিন। আর কী থাকে! ”
তোমার পরিবারের সদস্যরা রাগ করেননি?
উত্তর দেওয়ার আগে দরজার কড়া নড়ে উঠল।
“ইয়েস, কাম ইন” বলার পর রুমে ঢুকলেন কার্তিক দাস। হাতে খুব দামি একটা ব্রিফকেস। নমস্কার দিয়ে বললেন, সুপ্রভাত। কেমন আছেন?
“ভালো। আশা করি আপনিও ভালো আছেন।” দাঁড়িয়ে নমস্কার ও প্রত্যুত্তর দিলাম, “কী সৌভাগ্য আমার। আপন প্লিজ বসুন। ”
মেয়ে আমার আপনাকে কিন্তু খুব ভালোবাসে।
প্রমি?
স্যার।
ভালোবাসা কী?
জ্ঞান। যদি বলেন স্যার, এটি আমাদের কী দেয়? আমার উত্তর হবে—, জানার প্রেরণা। যেখানে জ্ঞান আর প্রেরণা নেই, সেখানে ভালোবাসা নিরর্থক। যে ভালোবাসায় এসব আসার সুযোগ নেই, সেটি ভালোবাসা নয়, ধস্তাধস্তি। আমি স্যার, অযথা ধস্তাধস্তি করতে কেন যাব? আপনি আমার ভালোবাসা মানে, আপনি আমার জ্ঞান।
কার্তিক বাবু ব্রিফকেস থেকে দুটো প্যাকেট বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, প্লিজ, আমার পক্ষ থেকে ক্ষুদ্র একটি সম্মান, বলতে পারেন রেসপেক্ট টোকেন। একটি আপনার জন্য। আরেকটি রচনা ম্যামের জন্য। দুটোই কিন্তু আপনার প্রমির পছন্দ। কিনেছেও সে। মেয়ে আমার গর্বের নিধি। আমার কাছে কিন্তু হিন্দু-মুসলিম নয়, মানুষই প্রথম বিবেচ্য।
“বাবা”, প্রমি বলল, “আমি হিন্দু কেন?”
তুমি হিন্দু পরিবারে জন্ম নিয়েছ, তোমার মা-বাবা হিন্দু তাই তুমি হিন্দু। কিন্তু তুমি যদি ইহুদি পরিবারে জন্ম নিতে তাহলে ইহুদি হতে। শিখ পরিবারে জন্ম নিলে শিখ, খ্রিষ্টান পরিবারে জন্ম নিলে খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ পরিবারে জন্ম নিলে বুড্ডিস্ট, বাহাই পরিবারে জন্ম নিলে বাহাই, সাবাকিজম পরিবারে জন্ম নিলে সাবাকিজ, জুদাইজম পরিবারে জন্ম নিলে জুদাইজ, আহমাদিয়া পরিবারে জন্ম নিলে আহমাদিয়া, অ্যানিমিজম পরিবারে জন্ম নিলে অ্যানিমিজ হতে।
মুসলিমের কথা বললে-না যে?
মা, ওরা খুব স্পর্শকাতর। দেশ বিভাগের পর বিক্রমপুরে আমাদের পারিবারিক মন্দিরটা ধ্বংস করে দিয়েছিল। আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজনকে হত্যা করা হয়।
হিন্দুরা কি কম স্পর্শকাতর? তারা বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছে কেন? যাই হােক, বলতে পারি, আমি হিন্দু— এটা আমার কৃতিত্ব নয়। বাবা, আমি যদি সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করি তুমি কি কিছু মনে করবে?
এমন করতে হলে তোমাকে বর্তমান ধর্মের সব বিশ্বাস মিথ্যা গণ্যে পরিত্যাগ করে এতদিন যে ধর্মকে বাতিল ও মিথ্যা বলে জেনে এসেছ তাকে অকাট্য সত্য মেনে নিতে হবে। ভগবান, দেব-দেবী, শ্রীকৃষ্ণ সবাই মিথ্যা আর ভুয়া হয়ে যাবে।
তার মানে ব্যক্তির ধর্ম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাস এবং তার সঙ্গে জন্ম থেকে যা সত্য জেনে এসেছি তা সর্বৈব মিথ্যা হয়ে যাবে। তাই না বাবা?
হ্যাঁ।
অর্থাৎ, ধর্ম হচ্ছে এমন সত্য যা ব্যক্তির বিশ্বাস পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মিথ্যা হয়ে যায়। যতবার ধর্ম পরিবর্তন হবে ততবার এমন ঘটবে। এভাবে সব ধর্ম মিথ্যা হয়ে যাবে। আবার গ্রহণ করলে আবার সত্য হয়ে যাবে। তাই তো?
“হ্যাঁ মা।”, কার্তিক দাস আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনারা আলাপ করুন। আমি কিন্তু গেলাম। কিন্তু হোটেলের কিছু খাবেন না। বাসা থেকে আসবে। যতদিন থাকেন আপনার জন্য একটা গাড়ি সবসময় থাকবে। আমি কিন্তু ঘটি নই, বাঙাল। আমার মন কিন্তু ঘটির মতো বদ্ধ কলসি নয়, বাঙালির পদ্মা- মেঘনার মতো খোলা। রাতে আমার বাসায় নেমন্তন্ন। আপনাকে লাবণী নিয়ে যাবে।”
কার্তিক দাস বের হয়ে যাওয়ার মিনিট পাঁচেক পর মোবাইলে আলাপ করতে করতে আবার হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলেন। কথ্যমান মোবাইলটি প্রমিতার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, তোমার সঙ্গে বিমল কথা বলবে।
কী কথা?
কী বলতে চায় শোনো।
প্রমিতা মোবাইলটি নিয়ে বিমলকে বলল, “আমি আপনার ভাষায় আমার যবন স্যারের সঙ্গে হোটেল রুমে বসে আড্ডা মারছি। কথা যা হবার তা এখানে হবে। ইচ্ছে হলে চলে আসুন।” তারপর মোবাইলটা তার বাবার হাতে তুলে দিয়ে সোফায় আমার পাশে বসে পড়ল।
মোবাইল নিয়ে কার্তিক বাবু তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলেন। স্থির থাকার সুযোগ নেই। ধনীদের ধন ও সময় দুটোরই বড়ো অভাব।