সন্মিত্রা: ষট্ত্রিংশ পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
স্পষ্টবাদী হওয়া ভালো, তবে অতিরিক্ত কোনো কিছু ভালো না। বলতে চাইছি— যা তুমি হাত বুলিয়ে আদায় করতে পারবে তার জন্য ঘুষি দেওয়া কী প্রয়োজন? প্রচণ্ড ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তার প্রয়োগ না করে কৌশলে কার্য আদায় করাই বাহাদুরি।
হঠাৎ একথা কেন স্যার?
কী ভাবলেন তারা তোমাকে নিয়ে?
কারা?
বিমল রায়ের লোকজন।
অন্যে আমাকে নিয়ে কী ভাবেন, সেটি আমার দেখার বিষয় নয়। স্যার, আমি আমার মতো থাকব, আমার মতো চলব, আমার মতো করব। তবে অন্যের ক্ষতি করে নয়। আমার আচরণে ঈর্ষান্বিতদের প্রতি করুণা প্রদর্শন ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই। আমি আমার ইচ্ছাকে আমার ইচ্ছেমতো প্রকাশ করব। আমার জীবনের লক্ষ ছিল অক্সফোর্ডের বৃত্তি। তা পেয়েছি এবং তাতে আপনার অবদান অনস্বীকার্য। আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমি যাকে ভালোবাসি তাকে আমার মতো করে উপস্থাপন করব। এতে যদি কেউ কষ্ট পায় এবং ঈর্ষায় কারো বুক ফেটে যায়, তাহলে আমার কী করার আছে? আমার আনন্দে যারা কষ্ট পায়, তারাই আমার কষ্টে আনন্দ পায়। এমন হীনদের আনন্দ দিতে যাব কেন?
তা বলছি না। বলছি— সবকিছু উগড়ে দেওয়া ঠিক না।
মিশুকে আসতে বলি?
বলো। তুমি কিন্তু ভরি রাগী।
আমার রাগ সবার জন্য নয়, বিমলদের জন্য।
তোমার বলাগুলো আরও মার্জিত করে বলতে পারতে।
আমার রাগ, অহংবোধে বিধ্বস্ত এবং আত্মবোধে অনড় নীচ মনের পুরুষদের কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য। আমার রাগ আমার আত্মরক্ষার ক্ষেপণাস্ত্র। আমার জন্ম লাঞ্ছিত হওয়ার জন্য নয়।
কথা দিয়ে হোক বা অস্ত্র দিয়ে হোক— কাউকে আঘাত করা কি ভালো?
অবশ্যই ভালো নয়। কিন্তু ওই রকম পাষণ্ড পুরুষকে নিচে নামিয়ে না দিলে যে পৃথিবী দুপেয়ে জানোয়ারের দখলে চলে যাবে। স্যার, আপনার কাছ থেকেই এমন শিখেছি। সরলে সারল্যং কুর্যাৎ, শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ। এ নিয়ে কোনো আপস করা মেয়েদের উচিত নয়।
প্রমির বাড়ি থেকে খাবার এল। প্রচুর খাবার। ভেবেছিলাম মিশু এলে একসঙ্গে খাব। সে বিকেলের আগে আসতে পারবে না। অগত্যা দুজনে খাওয়া শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
প্রমি খাবারগুলো টেবিলে সাজাতে সাজাতে বলল, স্যার, আমি কে ?
তুমিই বলো?
অনেকে বলে আমি অহংকারী, বেয়াদব এবং উগ্র। এও শুনি আমি নাকি বেশ বিনয়ী, নিরহংকারী, অমায়িক। কেউ বলে ভালো, কেউ বলে খারাপ। কেউ বলে আস্তিক, কেউ বলে নাস্তিক। কেউ বলে জ্ঞানী, অনেকে বলে মূর্খ। কেউ বলে বুদ্ধিমান, কেউ বলে পাগল। নিষ্ঠুরও ডাকে অনেকে, আবার অনেকে বলে মমতাময়ী। কেউ বলে স্বর্গী, কেউ বলে নরকী। কেউ বলে কুলাঙ্গার, কেউ বলে কুলশ্রী। কেউ বলে লাবণী, কেউ বলে প্রমিতা। আপনি বলেন— প্রমি। স্যার, আসলে আমি কে?
তুমি কে?
আপনি বলুন-না স্যার?
তুমি আয়না।
ধন্যবাদ স্যার।
তবে তুমি অহংকারী।
আপনিই আমার অহংকার।
কী!
রচনা ম্যামের মতো বললাম। স্বার্থহীন ভালোবাসা, ঈর্ষাহীন শিশু এবং অহংকারহীন নারী প্রকারন্তরে রক্তহীন জীবের মতো অবশ। ক্রীতদাসের মতো নিজকীয়তাহীন। অহংকার আমার নিজকীয়তার প্রতিরোধ ব্যূহ।
তবে কথা দিয়ে কিংবা এড়িয়ে গিয়ে তুমি যে সমস্যার সমাধান করতে পারবে তার জন্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার না করাই উত্তম। মশা মারতে কামান দাগানো যেন না হয়।
কিন্তু অন্যে অশালীন হলে?
কেউ অশালীন হলে তোমাকেও অশালীন হতে হবে—তা সর্বদা ঠিক নয়। যা শালীনতা অতিক্রম করে তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। তোমার থিসিসের কাজ কতটুকু হয়েছে?
প্রায় শেষ। স্যার, আপনি কখন যাচ্ছেন ব্রিটেন?
আগামী মাসে।
একসঙ্গে যাই?
যাওয়া যায়।
তবে স্যার, টিকিটের ভাড়টা আমি দেব।
আমার তো টিকিট করাই আছে। আমার সঙ্গে যেতে হলে তোমাকে আগে ঢাকা যেতে হবে কিংবা ঢাকা হয়ে যেতে হবে।
আমি স্যার ঢাকায় যাব।
স্বাগত।
কয়েকদিন থাকব। আপনার সঙ্গে ইচ্ছেমতো ঘুরব। আমার ঠাকুরদার বাড়ি বিক্রমপুর দেখব। আপনার গ্রামের বাড়ি দেখব।
আর কী দেখবে?
ঢাকেশ্বরী মন্দির আর ষাট গম্বুজ মসজিদ।
আর কী দেখবে?
ম্যামকে।