সন্মিত্রা: সপ্তত্রিংশ (৩৭) পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
ঢাকা আসার কয়েকদিন পর ফোন করলেন জামাল নজরুল ইসলাম।
“গতবার একটা কাজে গিয়েছিলাম”, জামাল নজরুল ইসলাম বললেন, “আমার কাজ নয়, দেশের কাজ। নিজের কাজের জন্য কখনো কারও কাছে হাত পাতিনি। আমার তো অভাব নেই। উত্তরাধিকারসূত্রে যা পেয়েছি তা পরিবারের জন্য যথেষ্ট। ক্যামব্রিজে থাকার সময় সরকারি কাজে যা প্রয়োজন হতো তা বলার সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যেতাম। বাংলাদেশে আসার পর বুঝলাম—প্রচণ্ড প্রয়োজনেও ন্যূনতম তহবিল পাওয়া দুষ্কর। কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। তদবির হলে অপ্রয়োজনীয় বিষয়টাও কর্তৃপক্ষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। দেশের উন্নতির জন্য এমন নির্বিকার দেশপ্রেমিক পৃথিবীতে আর কোথাও নেই।
কেন দেশে এলেন? বাঙালি এত নিকৃষ্ট জাতি যে, ব্যক্তিবোধের বাইরে যেতে পারে না। তাদের দেশপ্রেম কেবল পেটের মধ্যে ঘুরপাক খায়। অন্যের কষ্টই তার আনন্দ। এদেশে স্যার, মৃত্যুর আগে মূল্যায়ন পেতে হলে আপনাকে ডাকাত হতে হবে।
আরো কয়েকবার রিং করেছিলাম। পাইনি। কোথায় গিয়েছিলে?
কলকাতা ছিলাম।
বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর হলো বাংলাদেশিদের আচরণ। ভালোভাবে দাঁড়ানোর জন্য পা প্রয়োজন। কিন্তু তারা নিজের পা কেটে কোমর বানিয়ে নেয়। জল পান করে না, মটি পান করে। তাই নদী ভরাট করে। মাতৃস্তন থেকে দুগ্ধ পান করতে অনীহা। তাই স্তনরূপী পাহাড় কেটে মাতৃবক্ষকে সমতল করে দিচ্ছে। কী বোকা! কী জঘন্য! দেশের মাটিতেই যে আমাদের দাঁড়াতে হবে, সেটা তারা বুঝে না। তোমাদের প্রশাসন নিয়ে আমি মোটেও সন্তুষ্ট নই।
কী হয়েছে স্যার?
আমি একটা মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করতে চাই। এজন্য বিশ কোটি টাকার একটা প্রাক্কলন দিয়েছিলাম। ইউজিসির অত টাকা নেই। তারা প্রকল্প-প্রস্তাবটি সুপারিশ-সহ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। কয়েক বছর হয়ে গেল কোনো খবর নেই। মনীন্দ্র, মানে তোমার বিভাগের প্রফেসর বললেন, তোমার কথা। তুমি নাকি এখন বেশ প্রভাবশালী। তাই লজ্জার মাথা খেয়ে বলে ফেললাম। কিছু করতে পারবে?
সাধ্যমতো চেষ্টা করব।
বাবা, একটু চেষ্টা করে দেখো।
আসলেই স্যার আপনার বাংলাদেশ আসা ঠিক হয়নি। ক্যামব্রিজে থেকে গেলে ভালো হতো। এখন বিশ্ব মানেই বিশ্বগ্রাম। দেশের জন্য নত হওয়া গৌরবের, কিন্তু আপনার এই নত হওয়াকে আমার কাছে গৌরবের মনে হচ্ছে না। লজ্জার মনে হচ্ছে।
কেন?
সবাই উপহাস করবে। বলবে— হরিলুটের ব্যবস্থা করছেন। বানরের গলায় মুক্তোর হার দেওয়া কি উচিত?
আমি এখানে একটা ক্যামব্রিজ করতে চেয়েছিলাম।
সবখানে কী আর সবকিছু করা যায়?
যাবে না কেন?
চট্টগ্রামে কী স্যার ঢাকা করা যাবে?
আমি চট্টগ্রামকে চট্টগ্রাম রেখে ক্যামব্রিজের দ্যোতনা দিতে চাইছি। আমার দেশকে আমার মতো করে বিশ্বমানের সাজ দেব। তুমি কি জানাতে পার আমার প্রকল্প প্রস্তাবটা কী অবস্থায় আছে?
স্যারের সঙ্গে কথা শেষ করে পরিকল্পনা বিভাগে কয়েকজনকে রিং করলাম। জানা গেল, মানমন্দির অনেক দিন আগের প্রস্তাব, ওই ফাইলের খবর কেউ জানে না।
আমি ছোটো অফিসার। এত বড়ো তদবির কার্যকর করার ক্ষমতা আমার নেই। মনে পড়ে গেল, সৈয়দ আবুল হোসেন এমপি-র কথা। তিনি আমাকে সন্তানের মতো স্নেহ করেন। বিরোধী দলের এমপি হলেও সরকারে তাঁর বেশ প্রভাব।
তাঁকে রিং করে পুরো ঘটনা খুলে বললাম। তিনি অস্ফুটে বললেন, এ দেশের প্রশাসন থেকে এর চেয়ে ভালো কিছু আশা করা যায় না।
স্যার, পরিকল্পনা সচিব আপনার খুব ভক্ত। আপনি এলজিইডি মন্ত্রণালয়েল প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন ওই সচিব যুগ্মসচিব মর্যাদায় আপনার অধীনে কাজ করেছেন। তাকে বিষয়টা বলুন, যাতে মানমন্দির প্রকল্পটা পাশ করিয়ে দেন।
তিনি আমাকে তাঁর অফিসে যেতে অনুরোধ করলেন। গেলাম। সৈয়দ আবুল হোসেন আমার সামনে পরিকল্পনা সচিবকে রিং করলেন। নির্দেশনামতে, পরদিন পরিকল্পনা সচিবের কাছে গেলাম। প্রায় দুই বছর আগের ফাইল। অবাক হয়ে দেখলাম, আমি যাওয়ার আগে ফাইলটি বের করে সচিবের সামনে রাখা হয়েছে। সৈয়দ আবুল হোসেনের তদবিরের আলাদা মাজেজা। বাংলাদেশে এমন কোনো সচিব নেই, যিনি তাঁর দেওয়া টাই পরেননি গলায়, জুতো পরেনি পায়ে।
সচিব আমাকে যথেষ্ট সহানুভূতি দেখালেন। বললেন, মানমন্দির প্রকল্পে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিতে আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করব।
খুশি হয়ে চলে এলাম। এক সপ্তাহ পর আবার গেলাম। সচিব সাহেব বললেন, “মনির সাহেবের কাছে যেতে। এই ধরনের প্রকল্প মনির সাহেব দেখেন। গেলাম। মনির সাহেব রুমেই ছিলেন। বয়োজ্যেষ্ঠ অফিসার। তবে পদমর্যাদায় আমার সমান। মাথায় টুপি, মুখে দাড়ি। আর কয়েক বছর চাকুরি আছে।
বললাম, মানমন্দিরের প্রজেক্টটার কী খবর?
তিনি বললেন, মন্দির কেন? মসজিদ করেন, পাশ হয়ে যাবে। আপনি মুসলিম হয়ে হিন্দুদের মন্দিরের তদবির করছেন কেন?
এটি হিন্দুদের মন্দির নয়?
তাহলে কী?
অভজারভেটরি (Observatory)।
কাজ কী?
পৃথিবী ও মহাশূন্য পর্যবেক্ষণ এবং পরিমাপ গ্রহণের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ একটি জটিল গবেষণাগার। জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যোতিষশাস্ত্র, জলবায়ুবিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ের গবেষণার জন্য মানমন্দির স্থাপন করা হয়। ইসরোর মতো।
ইসরো আবার কী?
ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। ইংরেজিতে এর নাম Indian Space Research Organisation, সংক্ষেপে ISRO বা ইসরো। এটি ভারতের প্রধান মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন এই সংস্থাটি বিশ্বের অগ্রণী মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলোর অন্যতম। এটি ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে এটাকে আরও ঢেলে সাজানো হয়েছে। বাংলোরে এর হেডকোয়ার্টার।
ড্রয়ার থেকে ফাইলটা বের করে মনির সাহেব বললেন, অনেক আগের প্রকল্প। এতদিনে বাজারমূল্য বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। সচিব স্যার, দেখতে বলেছেন। দেখি কী করা যায়। আমি কিন্তু পঁয়ত্রিশ কোটি টাকার প্রস্তাব দেব। এর কম হলে কাজ হবে না।
এটি পাশ হলে দেশের খুব উপকার হবে। সারা বিশ্বে বাংলাদেশের নাম ছড়িয়ে পড়বে।
ক্রিকেটে আমাদের নাম ছড়িয়ে পড়েছে। মন্দির-ফন্দির দিয়ে নাম কামানোর প্রয়োজন নেই।
কিন্তু বিস্কিট খেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছেন বলে ভাত খাবেন না, তা কি হয়?
পনেরো-বিশ দিন পর খবর দিলেন সৈয়দ আবুল হোসেন— মানমন্দিরের ফাইল পাশ হয়েছে। শুনে বুকটা আমার আকাশ। খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে জামাল নজরুল ইসলামকে কয়েকবার ফোন করলাম। পেলাম না।
ফোন রেখে ছুটে গেলাম পরিকল্পনা বিভাগে। আর রিং করব না। স্যারকে বরাদ্দপত্রটা নিজ হাতে তুলে দেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম চলে যাব। এ আমার জীবনের একটি পরমপ্রাপ্তি হবে।
পরিকল্পনা কমিশনে গিয়ে দেখলাম, মানমন্দিরের জন্য মাত্র এক কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। পয়ত্রিশ কোটি টাকার চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এক কোটি টাকা। লজ্জার তোড়ে ফাইলটি ছুুড়ে দিয়ে বের হয়ে এলাম। বুকে চেপে বসেছে জগদ্দল পাথর।
গাড়িতে উঠতে যাব, এ সময় মোবাইল সুর দিল। পর্দায় চোখ দিয়ে দেখলাম, প্রমি। জগদ্দল পাথরটার কথা মুহূর্তে ভুলে গেলাম। জগতে কার খবর কে কতক্ষণ রাখে!
স্যার, আমি আগামীকাল ঢাকা আসছি।
প্রমির রিং পেয়ে মনে পড়ল আগামী সপ্তায় আমার যুক্তরাজ্য যাওয়ার কথা। মানমন্দির প্রকল্প নিয়ে এত মগ্ন ছিলাম যে, সবকিছু ভুলেই গিয়েছিলাম। প্রমির রিং মানমন্দিরকে ভুলিয়ে দিল।
কোন হোটেলে উঠবে?
আমার পছন্দ সোনারগাঁও। উঁচু নয়, কিন্তু বিস্তৃত। বেশ খোলামেলা। নিচ তলায় সুইমিং পুল। বেশ লাগে। রোদের সঙ্গে মিতালি হয়।
ভালো হবে। আমার বাসার কাছাকাছি। প্রয়োজন হলে খবর দেওয়া মাত্র চলে আসতে পারব।
খবর দেব কেন? আমাদের সঙ্গ দিতে হবে সর্বদা। ঘুরব না?
অবশ্যই। আমি আজকে ছুটির দরখাস্ত দিয়ে দিচ্ছি।
আমার সঙ্গে মিশুও যাবে। সে তার পূর্বপুরুষের বাড়ি দেখতে যাবে।
কোথায়?
নোয়াখালী।
স্যার, আমরা দুজন কিন্তু ম্যামকে দেখতে যাব। ডিসিশন ফাইনাল।
কাকে দেখতে যাবে?
ম্যামকে।
আমি তাকে দেখতে যাব না। তোমার যেয়ো।
কেন, স্যার?
আমি তো তাকে প্রতিদিন দেখি।