Warning: Constant DISALLOW_FILE_MODS already defined in /home/draminb1/public_html/wp-config.php on line 102

Warning: Constant DISALLOW_FILE_EDIT already defined in /home/draminb1/public_html/wp-config.php on line 103
সন্মিত্রা : এক মলাটে সন্মিত্রা: সন্মিত্রা সম্পূর্ণ উপন্যাস : প্রথম থেকে শেষ পর্ব – Page 38 – Dr. Mohammed Amin

সন্মিত্রা : এক মলাটে সন্মিত্রা: সন্মিত্রা সম্পূর্ণ উপন্যাস : প্রথম থেকে শেষ পর্ব

সন্মিত্রা: অষ্টা‌ত্রিংশ (৩৮) পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন

সিঙ্গাপুর এয়ার লাইনস-এর উড়োজাহাজ যথাসময়ে হিথরোর মাটি স্পর্শ করল। আমার চোখ লন্ডনে নয়, রচনায়। রাজ-রোজি এবং আল্পনা আর কল্পনায়। রচনাময় লন্ডন আমার বুকে তুলে দিল ভালোবাসার ঢেউ। কখন দেখব মেয়েটির মুখ। আহ! কত সুখ ওই মুখে। যতবার দেখি ততবার নতুন প্রেমে অভিষিক্ত হই। ততবার উজ্জীবিত হই নতুন দিনের প্রথম সূর্যের মিষ্টি উষ্ণতায়।
বিমান ভ্রমণ আমার কাছে সর্বদা বিরক্তিকর। প্রমিতা সঙ্গী হওয়ায় এবার ভ্রমণটা বিরক্তিকর হয়নি, বরং উপভোগ্য হয়েছে। সারাপথ অস্থির করে রেখেছিল বিনিদ্র মমতার গাল্পিক নির্যাসে। মেয়েরা আনন্দের ভান্ডার নিয়ে দুনিয়াতে আসে। বিমানন্দরের নিরাপত্তা বেষ্টনী থেকে বের হয়ে আমি অবাক—নিনি ছাড়া বাসার সবাই হাজির। এ যেন তৃষ্ণাকাতর হরিণের সামনে হাজার হাজার ঝরনা।
নিনি এল না যে? রচনার কাছে জানতে চাইলাম।
সে আপনার জন্য পিঠা বানাচ্ছে। কত করে বললাম— চলো; ভাব্বা মাইন্ড করবেন। এল না। হামিদ, তুমি কিছু বলো-না ভাব্বাকে।
আধ ঘণ্টা চলে গেল কুশল আর শ্রদ্ধা-স্নেহে। তারপর সবাই হুড়মুড় করে গাড়িতে। এগারো সিটের বিশাল গাড়ি, নয় জনে তার পেট ভরেনি। ড্রাইভিং সিটে নিনির স্বামী হামিদ। তার পাশে টুটুল। কোলে দুই পিচ্চি—রাজ-রোজি।
“ভাব্বা”, গাড়ি চলতে শুরু করামাত্র কল্পনা আমার বাম হাতের তালুতে ছোটো ছোটো চিমটি কেটে বলল, আপনার প্রিয় পশু?
“কুকুর”, আমি বলার আগে আমার ডান হাত নিজের দিকে টেনে নিতে নিতে রচনা বলল,“তাই না ভাব্বা?”
হ্যাঁ। বিলু আমাকে ভালোবেসে আমার জন্য জীবন দিয়েছিল।
প্রমিতা বলল, বিলু কে?
“ড্যাডের কুকুর”, রোজি টুটুলের কোল ছেড়ে আমার কোলে চলে আসতে আসতে বলল, “আমি জানি, মাম বলেছেন। বিলু খুব ভালো কুকুর। সে ভালোবাসতে জানে। বড়ো হলে আমি বিলু হব। ড্যাডকে বিলুর মতো ভালোবাসব।”
রাজ বলল, আমিও বিলু হব। বিলু হলে ড্যাডকে ভালোবাসা যাবে। ড্যাডকে ভালোবাসালে পুরো পৃথিবী আমাদের হয়ে যাবে। ড্যাড আমাদের ঈশ্বর।
“রাজবাবু?” প্রমিতা বলল, ঈশ্বর কে?
যিনি সবসময় তার ভক্তদের কল্যাণের জন্য কাজ করেন তিনিই ঈশ্বর। মাম বলেছেন— ড্যাড সবসময় আমাদের কল্যাণের জন্য কাজ করেন। তাই তিনি আমাদের ঈশ্বর।
রাজ-রোজির কথা শুনে আমার পুরো শরীর সিক্ত অনুভূতিতে আর্দ্র হয়ে গেল। রচনা তাদের কীভাবে গড়ে তুলছে বুঝতে আমার এতটুকু কষ্ট হলো না। আমার প্রতি রচনার কৃতজ্ঞতাবোধ আমাকে অবশ করে দিল। শব্দহীন কান্নায় চোখ দুটো ভেসে গেল জলে।
কাঁদছেন কেন ড্যাড? রোজি বলল।
কান্না নয়।
তাহলে অশ্রু কেন? মুছে দিতে দিতে বলল।
এ অশ্রু নয়, তোমাদের ভালোবাসার শিশির। আমার সবুজ ঘাসে চিকচিক করছে। মুছো না।
টুটুলকে ছেড়ে রাজও চলে এল আমার কোলে, ড্যাড, আমরাও বিলুর মতো আপনার জন্য জীবন দেব। কাঁদবেন না।
মনে পড়ে গেলা আমার সন্তানদের কথা। তুলনা করার সুযোগ নেই। “তাদের তুমি লালনে বাধ্য, যেমন বাধ্য হাগতে”, ঋধিতার কথা,“ভালোবাসা চাইতে গেলে রাস্তায় গিয়ে দানছত্র খুলে বসো। সন্তানদের কাছ থেকে কীসের ভালোবাসা? কেউ কি কখনো পেয়েছে?”
হিতাহিত ভুলে শিশুর মতো ডুকরে কেঁদে দিলাম।সামানে খোলা পার্ক। পাশে রেস্টুরেন্ট। হামিদ গাড়ি থামিয়ে দিল, স্যার, আমরা এখানে নামি?
কেন?
যে অফুরন্ত ভালোবাসার অতলান্তিক মমতায় আপনি সিক্ত, তা আমাদের একটু দেবেন না?
গোল হয়ে বসে গেলাম সবাই।
“হ্যাঁ” আমি বললাম, “ বিলু আমাকে খুব ভালোবাসত। অথচ বিলুর জন্য আমাকে তেমন কিছুই করতে হয়নি। আমার জন্য বিলু যখন জীবন দেয় তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। কুকুরের মতো নিখাদ ভালোবাসা আর ভণ্ডামিহীন আনুগত্য পেতে হলে মানুষকে আগে কুকুর হয়ে যেতে হবে। খুব কম মানুষ তা পারে। মানুষ হওয়া সহজ, কিন্তু কুকুর হওয়া খুব কঠিন। কুকুর মানুষ হতে পারে না। মানুষ সহজে কুকুর হয় যেতে পারে। মানুষ, মানুষকে কুকুর গালি দেয়। একসময় আমার তিনকন্যা রচনা-আল্পনা আর কল্পনা বিলু হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করত। আজ দুজন বাড়ল। কজন পেয়েছে এমন ভালোবাসা?
আপনার প্রিয় মানুষ? টুটুল বলল।
রচনা। সে আমার বিলু। সে মানুষ, কিন্তু বিলুর মতো নিখাদ ভালোবাসা আর পরম আনুগত্যে বিভূষিত। তোমরাও আমার প্রিয় মানুষ। প্রমিতাও আমার প্রিয়। রাজ- রোজি সবার সেরা।
“আমাদের জিজ্ঞাসা করুন”, আল্পনা বলল, “আমাদের কার শ্রেষ্ঠ মানুষ কে?”
কে?
সবাই বলল, আপনি।
আমি ছাড়া। আমরা-আমাদের বাদ দিয়ে বলতে হবে।
এবার একটু ভাবনায় পড়ে গেল সবাই।
কাগজে লিখে আমাকে দাও।
তাই করল সবাই। রচনা আর রাজ-রোজির শ্রেষ্ঠ মানুষ — গৌতমবুদ্ধ; আল্পনা লিখল— সক্রেটিস; কল্পনা লিখল—হিটলার। প্রমিতা লিখল—স্ট্যালিন। টুটুল লিখল— সক্রেটিস। হামিদ লিখল— আরজ আলী মাতুব্বর। সবার লেখা প্রকাশ করে দিলাম।
“ভাব্বা”, টুটুল বলল, “আপনার মতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ কে?”
গৌতম বুদ্ধ।
আমি জানতাম আপনি আপুরটাই বলবেন।
কীভাবে জানলে?
আপনি যে আপুকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মানুষ কিন্তু সক্রেটিস। এত বড়ো দার্শনিক আর হয়নি।
রচনা বলল, সক্রেটিস এত বড়ো দার্শনিক হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব কার জানো?
কার?
সক্রেটিসের তিন সন্তানের মা জ্যান্থিপির ।
কীভাবে?
রচনা বলল, প্রত্যেক পুরুষের উত্থানের পিছনে একজন নারীর কৃতিত্ব থাকে। পুরুষের জন্ম হয় নারী থেকে। মা বা প্রেমিকা কিংবা স্ত্রী-বোন— যাই বলো পুরুষের জীবনে মেয়েদের ভূমিকাই বেশি। এজন্য সন্তান পিতার চেয়ে মায়ের প্রতি অধিক অনুরক্ত হয়। এটি নারীর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ। এ নিয়ে কোনো পুরুষ দ্বিমত করতে পারে, কিন্তু সেও যে বাবার চেয়ে মায়ের প্রতি অধিক অনুরক্ত ছিল তা—অস্বীকার করতে পারবে না।
প্রমিতা বলল, জ্যান্থিপি বয়সে সক্রেটিসের চল্লিশ বছর ছোটো ছিলেন। তারপরও সক্রেটিসের সঙ্গে প্রায় সমবয়সি স্বামী-স্ত্রীর মতো ঝগড়া করতেন। বেচারা সক্রেটিসকে সারাদিন একা থাকতে হতো।
আমি বললাম, এই একাকিত্বই সক্রেটিসের দর্শন-চিন্তাকে লালিত করছে, শানিত করেছে।
স্যার, একাকিত্ব কী? প্রমিতা প্রশ্ন করল।
একাকিত্ব হচ্ছে একাগ্রতা, অধ্যবসায় এবং সৃজনশীল চিন্তাভাবনা পুষ্টকরণ খামার। এখানে লালিত হয়— দর্শন, সাহিত্য, যুক্তি, তর্ক আর জ্ঞান-বিজ্ঞান।
ধর্ম?
সে থাকে মন্দিরে, পৈতা আর টিকিতে;
অনড় বাণীভরা একমাত্র বহিতে।
গাড়িতে উঠে বসলাম আবার।
প্রমিতা ফিসফিস করে রাজ-রোজিকে বলল, ঈশ্বর কি মারা যায়?
হ্যাঁ।
কখন?
যখন তার ভক্তরা মারা যায়। একদিন এভাবে সব ঈশ্বর মারা যাবে।
ঈশ্বরকে বানিয়েছে কে?
তাকে যারা ভালোবাসে তারা।