সন্মিত্রা: ঊনচত্বারিংশ (৩৯) পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
“স্যার, সত্যি বলতে কী”, গাড়ির গতির দিকে শ্যেন দৃষ্টি রেখে হামিদ বলল, “নিনিকে না পেলে আসলে আমি বিয়েই করতাম না। লন্ডনে রচনা ম্যামের বাসায় নিনির সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর বুঝতে পেরেছিলাম— নিনির ভেতরের সৌন্দর্য বাইরের চেয়ে আরও আকর্ষণীয়। বলতে পারেন— লোভ আর ছাড়তে পারলম না।”
সত্যি কী বিয়ে করতে না?
এজন্যই তো বিয়ে না-করেই লন্ডন চলে এসেছিলাম।
কেন গো?
বউ কাছে থাকলে কেউ একাগ্র থাকতে পারে না। মন-মগজ ঘুর্ণায়মান পাথরের মতো অযথা গড়ায় আর গড়ায়। চিন্তাভাবনা শুধু লাফায়। মগজে কিছু জমার সুযোগ হয় না। A rolling stone gathers no moss. বউয়ের ভালোবাসা সাময়িক আরাম দিতে পারে, কিন্তু সক্রেটিস হতে হলে জ্যান্থিপির মতো নির্যাতন অনিবার্য। আগুনে না পোড়ালে কোনো কিছু থেকে সার বের হয় না। হোক তরল রস কিংবা কঠিন স্বর্ণ। বউ হচ্ছে আগুন।
জ্যান্থিপি কি সক্রেটিসকে খুব কষ্ট দিতেন?
“ স্যার, সক্রেটিস খুব তর্কবাজ ছিলেন।” প্রমিতা বলল, “কথায় কথায় বউয়ের সঙ্গে তর্ক শুরু করে দিতেন। তাঁর নির্দিষ্ট কোনো কাজ ছিল না। ঘরে বসে থাকতেন। অথবা বাউন্ডেলের মতো রাস্তায় ঘুরে ঘুরে পথিকদের জ্ঞান দান করতেন। বাড়িতেও একই দশা। কেউ এলে তাকে সহজে ছাড়তেন না। জ্ঞান দিতে থাকতেন। এজন্য কেউ সহজে তাঁর বাড়িতে আসতে চাইতেন না। স্যার, এমন স্বামীকে কোন মেয়ে পছন্দ করবে?”
“আরও কারণ আছে।” আল্পনা বলল, “সক্রেটিস বন্ধুদের সঙ্গে মদ খেয়ে মাতালামি করতেন। বাড়ি এসে সন্তানদের সঙ্গেও স্বাভাবিকভাবে কথা বলতেন না। সারাক্ষণ আপন মনে একা একা থাকতেন। এটি জ্যান্থিপি পছন্দ করতেন না।”
কে বলেছে তোমাকে এসব? আমি প্রশ্ন করলাম।
পাগলা দাদু।
“সক্রেটিসকে তৎকালীন অনেক বিখ্যাত দার্শনিক ভালোবাসতেন”, প্রমিতা বলল, “সক্রেটিসও অনেক পুরুষকে ভালোবাসতেন। তাদের অনেকের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক ছিল।”
আমি বললাম, ওই সময় সমকামিতা মহাপবিত্র প্রেম বলে গণ্য করা হতো। তখন প্রেমের তিনটা ধাপ ছিল। সর্বোত্তম ছিল— পুরুষে পুরুষে প্রেম, দ্বিতীয় নারী-নারী প্রেম এবং সবচেয়ে নিকৃষ্ট ছিল বিপরীত লিঙ্গের প্রেম। নারীপুরুষের প্রেমকে জানোয়ারের দৈহিক মিলনের সঙ্গে তুলনা করা হতো। জানোয়ারের কাজ হলেও বংশবৃদ্ধির জন্য তাদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও জানোয়ার হয়ে যেতে হতো।
প্রমিতা বলল, প্লেটো সক্রেটিসের প্রতি দুর্বল ছিলেন। “প্লেটোর সিম্পোজিয়াম গ্রন্থে পড়েছি। তখনকার সব দার্শনিকের লেখায় বিষয়টি পাওয়া যায়। তবে সক্রেটিসকে বিছানায় পাওয়া খুব সহজ ছিল না। জ্যান্থিপির প্রতিও সক্রেটিস কিছুটা দুর্বল ছিলেন। তবে জ্যান্থিপি মোটেও পাত্তা দিতেন না। ”
আমি বললাম, মৃত্যুদণ্ডের আগে সক্রেটিস জ্যান্থিপিকে তালাক দিয়েছিলেন। দাম্পত্য জীবনে খুব ঝগড়া হতো দুজনের— একথা ঠিক। কিন্তু পরিবারের প্রতি ছিল অসম্ভব টান। আসলে কোনো স্ত্রী চিন্তাবিদ স্বামী পছন্দ করে না। এরূপ স্বামী সারাদিন বই নিয়ে পড়ে থাকে। কীভাবে পছন্দ করবে। জ্যান্থিপি কিছুক্ষণ গালাগাল করে চলে যেতেন। এরপর সক্রেটিস একা একা ইচ্ছেমতো জ্ঞান সাগরে ডুব দিয়ে জ্ঞানমুক্তো সংগ্রহে একাগ্র হয়ে যেতেন। পরে ওই মণিমুক্তোই জ্ঞানপিপাসুদের মাঝে বণ্টন করতেন। যার উপকারিতা এখনও আমরা পাচ্ছি।
“স্যার”, রচনা বলল,“জ্যান্থিপি অনেক ধনীর মেয়ে ছিলেন। ল্যাম্প্রোকলেস, সপ্রোনিসক্সা এবং মেনেক্সিনাস ছিলেন সক্রেটিস এবং জ্যান্থিপির সন্তান। তবে জ্যান্থিপি সক্রেটিসকে সহ্যই করতে পারতেন না। তিনি খুব অহংকারী এবং রুঢ় ছিলেন। খুব বাজে কথা বলতেন। ”
“সক্রেটিস চাইতেন তার বউ তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করুক।
রচনা বলল, কেন?
সক্রেটিস স্ত্রীর ভালোবাসার সময়টুকুকে নষ্ট সময় মনে করতেন। তাঁর মতে, প্রেমিকার সঙ্গে কাটানো সময় হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে নষ্ট সময়। জ্যান্থিপি কখন বিদায় নেবেন এই চিন্তায় ব্যস্ত থাকতেন।
প্রমিতা বলল, সক্রেটিস ইচ্ছে করে এসব করতেন।
যাতে স্ত্রীকে দূরে রাখা যায়।
রচনা বলল, তবে তাদের দুজনের মধ্যে কথা শুরু হলে তিন মিনিটের মধ্যে ঝগড়ায় পরিণত হতো। এজন্য কেউ সহজে কারও ছায়া মাড়াতেও ইচ্ছুক ছিলেন না। সক্রেটিসের কোনো কথাই জ্যান্থিপি বিশ্বাস করতেন না। সক্রেটিস ডাকতেন পাগল। তার শিক্ষাকে বলতেন— পাগলামি।
টুটুল বলল, সক্রেটিসের কয়জন স্ত্রী ছিলেন?
দুজন। ‘ম্যাইরটো’ এবং জ্যান্থিপি।
“অ্যারিস্টোটলের সঙ্গে তার স্ত্রীর সম্পর্ক খুব ভালো ছিল।”, টুটুল বলল, “ঝগড়া হতো না। দুজনের মধ্যে গভীর ভালোবাসা ছিল। তবু অ্যারিস্টোটল এত অধ্যয়ন করতেন কীভাবে? অধ্যয়ন না করলে এত বড়ো জ্ঞানী হলেন কীভাবে?”
রচনা বলল, অ্যারিস্টোটলের প্রথম স্ত্রী পিথিয়াস ছিলেন জীববিজ্ঞানী ও ভ্রূণবিদ। খুব ভালোবাসতেন সক্রেটিসকে। বেশ মিল ছিল দুজনের। দুজন দুজায়গায় কাজ করতেন। বছরে কয়কটা দিন ছাড়া সারা বছরই একা থাকতেন। এজন্য বউয়ের ভালোবাসা সত্ত্বেও অ্যারিস্টোটল এত জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
সত্যি কী বিয়ে করতে না?
এজন্যই তো বিয়ে না-করেই লন্ডন চলে এসেছিলাম।
কেন গো?
বউ কাছে থাকলে কেউ একাগ্র থাকতে পারে না। মন-মগজ ঘুর্ণায়মান পাথরের মতো অযথা গড়ায় আর গড়ায়। চিন্তাভাবনা শুধু লাফায়। মগজে কিছু জমার সুযোগ হয় না। A rolling stone gathers no moss. বউয়ের ভালোবাসা সাময়িক আরাম দিতে পারে, কিন্তু সক্রেটিস হতে হলে জ্যান্থিপির মতো নির্যাতন অনিবার্য। আগুনে না পোড়ালে কোনো কিছু থেকে সার বের হয় না। হোক তরল রস কিংবা কঠিন স্বর্ণ। বউ হচ্ছে আগুন।
জ্যান্থিপি কি সক্রেটিসকে খুব কষ্ট দিতেন?
“ স্যার, সক্রেটিস খুব তর্কবাজ ছিলেন।” প্রমিতা বলল, “কথায় কথায় বউয়ের সঙ্গে তর্ক শুরু করে দিতেন। তাঁর নির্দিষ্ট কোনো কাজ ছিল না। ঘরে বসে থাকতেন। অথবা বাউন্ডেলের মতো রাস্তায় ঘুরে ঘুরে পথিকদের জ্ঞান দান করতেন। বাড়িতেও একই দশা। কেউ এলে তাকে সহজে ছাড়তেন না। জ্ঞান দিতে থাকতেন। এজন্য কেউ সহজে তাঁর বাড়িতে আসতে চাইতেন না। স্যার, এমন স্বামীকে কোন মেয়ে পছন্দ করবে?”
“আরও কারণ আছে।” আল্পনা বলল, “সক্রেটিস বন্ধুদের সঙ্গে মদ খেয়ে মাতালামি করতেন। বাড়ি এসে সন্তানদের সঙ্গেও স্বাভাবিকভাবে কথা বলতেন না। সারাক্ষণ আপন মনে একা একা থাকতেন। এটি জ্যান্থিপি পছন্দ করতেন না।”
কে বলেছে তোমাকে এসব? আমি প্রশ্ন করলাম।
পাগলা দাদু।
“সক্রেটিসকে তৎকালীন অনেক বিখ্যাত দার্শনিক ভালোবাসতেন”, প্রমিতা বলল, “সক্রেটিসও অনেক পুরুষকে ভালোবাসতেন। তাদের অনেকের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক ছিল।”
আমি বললাম, ওই সময় সমকামিতা মহাপবিত্র প্রেম বলে গণ্য করা হতো। তখন প্রেমের তিনটা ধাপ ছিল। সর্বোত্তম ছিল— পুরুষে পুরুষে প্রেম, দ্বিতীয় নারী-নারী প্রেম এবং সবচেয়ে নিকৃষ্ট ছিল বিপরীত লিঙ্গের প্রেম। নারীপুরুষের প্রেমকে জানোয়ারের দৈহিক মিলনের সঙ্গে তুলনা করা হতো। জানোয়ারের কাজ হলেও বংশবৃদ্ধির জন্য তাদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও জানোয়ার হয়ে যেতে হতো।
প্রমিতা বলল, প্লেটো সক্রেটিসের প্রতি দুর্বল ছিলেন। “প্লেটোর সিম্পোজিয়াম গ্রন্থে পড়েছি। তখনকার সব দার্শনিকের লেখায় বিষয়টি পাওয়া যায়। তবে সক্রেটিসকে বিছানায় পাওয়া খুব সহজ ছিল না। জ্যান্থিপির প্রতিও সক্রেটিস কিছুটা দুর্বল ছিলেন। তবে জ্যান্থিপি মোটেও পাত্তা দিতেন না। ”
আমি বললাম, মৃত্যুদণ্ডের আগে সক্রেটিস জ্যান্থিপিকে তালাক দিয়েছিলেন। দাম্পত্য জীবনে খুব ঝগড়া হতো দুজনের— একথা ঠিক। কিন্তু পরিবারের প্রতি ছিল অসম্ভব টান। আসলে কোনো স্ত্রী চিন্তাবিদ স্বামী পছন্দ করে না। এরূপ স্বামী সারাদিন বই নিয়ে পড়ে থাকে। কীভাবে পছন্দ করবে। জ্যান্থিপি কিছুক্ষণ গালাগাল করে চলে যেতেন। এরপর সক্রেটিস একা একা ইচ্ছেমতো জ্ঞান সাগরে ডুব দিয়ে জ্ঞানমুক্তো সংগ্রহে একাগ্র হয়ে যেতেন। পরে ওই মণিমুক্তোই জ্ঞানপিপাসুদের মাঝে বণ্টন করতেন। যার উপকারিতা এখনও আমরা পাচ্ছি।
“স্যার”, রচনা বলল,“জ্যান্থিপি অনেক ধনীর মেয়ে ছিলেন। ল্যাম্প্রোকলেস, সপ্রোনিসক্সা এবং মেনেক্সিনাস ছিলেন সক্রেটিস এবং জ্যান্থিপির সন্তান। তবে জ্যান্থিপি সক্রেটিসকে সহ্যই করতে পারতেন না। তিনি খুব অহংকারী এবং রুঢ় ছিলেন। খুব বাজে কথা বলতেন। ”
“সক্রেটিস চাইতেন তার বউ তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করুক।
রচনা বলল, কেন?
সক্রেটিস স্ত্রীর ভালোবাসার সময়টুকুকে নষ্ট সময় মনে করতেন। তাঁর মতে, প্রেমিকার সঙ্গে কাটানো সময় হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে নষ্ট সময়। জ্যান্থিপি কখন বিদায় নেবেন এই চিন্তায় ব্যস্ত থাকতেন।
প্রমিতা বলল, সক্রেটিস ইচ্ছে করে এসব করতেন।
যাতে স্ত্রীকে দূরে রাখা যায়।
রচনা বলল, তবে তাদের দুজনের মধ্যে কথা শুরু হলে তিন মিনিটের মধ্যে ঝগড়ায় পরিণত হতো। এজন্য কেউ সহজে কারও ছায়া মাড়াতেও ইচ্ছুক ছিলেন না। সক্রেটিসের কোনো কথাই জ্যান্থিপি বিশ্বাস করতেন না। সক্রেটিস ডাকতেন পাগল। তার শিক্ষাকে বলতেন— পাগলামি।
টুটুল বলল, সক্রেটিসের কয়জন স্ত্রী ছিলেন?
দুজন। ‘ম্যাইরটো’ এবং জ্যান্থিপি।
“অ্যারিস্টোটলের সঙ্গে তার স্ত্রীর সম্পর্ক খুব ভালো ছিল।”, টুটুল বলল, “ঝগড়া হতো না। দুজনের মধ্যে গভীর ভালোবাসা ছিল। তবু অ্যারিস্টোটল এত অধ্যয়ন করতেন কীভাবে? অধ্যয়ন না করলে এত বড়ো জ্ঞানী হলেন কীভাবে?”
রচনা বলল, অ্যারিস্টোটলের প্রথম স্ত্রী পিথিয়াস ছিলেন জীববিজ্ঞানী ও ভ্রূণবিদ। খুব ভালোবাসতেন সক্রেটিসকে। বেশ মিল ছিল দুজনের। দুজন দুজায়গায় কাজ করতেন। বছরে কয়কটা দিন ছাড়া সারা বছরই একা থাকতেন। এজন্য বউয়ের ভালোবাসা সত্ত্বেও অ্যারিস্টোটল এত জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ভাব্বা, আমি এমন একটা বিয়ে করব।
এখন দ্রুতযান আবিষ্কার হয়ে গেছে। ওই সুযোগ আর নেই।
প্রমিতাও ঢাকায় ছাত্রবেলায় এমন কথা বলেছিল।