Warning: Constant DISALLOW_FILE_MODS already defined in /home/draminb1/public_html/wp-config.php on line 102

Warning: Constant DISALLOW_FILE_EDIT already defined in /home/draminb1/public_html/wp-config.php on line 103
সন্মিত্রা : এক মলাটে সন্মিত্রা: সন্মিত্রা সম্পূর্ণ উপন্যাস : প্রথম থেকে শেষ পর্ব – Page 4 – Dr. Mohammed Amin

সন্মিত্রা : এক মলাটে সন্মিত্রা: সন্মিত্রা সম্পূর্ণ উপন্যাস : প্রথম থেকে শেষ পর্ব

সন্মিত্রা: চতুর্থ পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন

কোন জিনিস বারবার ছাড়া যায়?
সংসার।
জায়া-পতি প্রতিদিন কে কতবার যে সংসার ছাড়ে তার ইয়ত্তা নেই। রাতের সংসার ছাড়ার প্রতিজ্ঞা সকাল হতে না হতে উধাও। ঝগড়ার রেশটুকু কেবল রয়ে গেছে মনের ভেতর অভিমানের খুদে কষ্ট হয়ে।
অফিসে ঢুকে ঋধিতার অ্যালবাম পোড়ানোর ঘটনাটা রচনাকে জানালাম। কষ্ট ভাগ করে নেওয়া― এ আর কী! জানি না, জানানো উচিত হয়েছে কি না। উচিত না-হলেও তাকে না জানিয়ে পারতাম না। কিছু কিছু কথা কিছু কিছু লোককে বলার জন্য ভেতরে বমির মতো প্রবল ঊর্ধ্ব চাপ সৃষ্টি হয়। যতক্ষণ না-জানানো যায় ততক্ষণ অস্বস্তি ক্রমশ বাড়তে থাকে। বমি যেমন আটকে রাখা যায় না, তেমনি আটকে রাখা যায় না এমন কথা। অনেকটা প্রকৃতির ডাকের মতো।
জানিয়ে দেওয়ার পর বুঝলাম, না বললে চলত, কিন্তু ভালো হতো না। বলে দিয়ে ভালোই করেছি। কষ্টটা হালকা হয়েছে। আমার ভূমিকাটাও পরিষ্কার হয়েছে। রচনা বিচার করতে জানে। আমার কাছে ঋধিতার চেয়ে রচনার সম্পর্ক অনেক পুরানো। অধিকন্তু নিবিড় এবং গভীর। পৃথিবীতে আমার অনুপস্থিতি সবচেয়ে বেশি যাকে কষ্ট দেবে সে হচ্ছে রচনা। দ্বিতীয় অবশ্যই ঋধিতা। তবে তাদের এই কষ্টের রূপকতায় নানা পার্থক্য আছে।
ভালোবাসার মানুষের কাছে কোনো কিছু লুকিয়ে রাখা উচিত নয়। হয়তো প্রথমে কষ্ট পাবে, কিন্তু এই কষ্ট তার মনে নতুন ধারণার জন্ম দেবে― নতুন ভাবনার উন্মেষ ঘটাবে। তবে স্বামী-স্ত্রীর কাছে সবকিছু বলে ফেলা উচিত নয়, কারণ এরা পরস্পর ভালোবাসার মানুষ নয়, এমনকি ভালোবেসে বিয়ে করলেও। বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে সব ভালোবাসা আইনি দায়িত্ব হয়ে যায়। দায়িত্ব বিবেচনাহীন সত্য প্রকাশ নিজের পায়ে কুড়োল মারার মতো বোকামি। দায়িত্ব কেবল দায়কে ঘিরে আবর্তিত হয়। তার আবেগ বা ভালোবাসা বলে কিছু থাকে না।
রচনা সব শুনে স্বাভাবিক গলায় বলল, ম্যাম খুব রাগ করেছেন।
তুমি কীভাবে জানলে?
তিনি আমাকে রিং করে জানিয়েছেন।
কী! আমি বিস্ময়ের সঙ্গে বললাম।
আগুন দেখে নাকি আপনি ভয়ে থরথর কাঁপছিলেন। তাই না কি? আপনি যা ভীতু, কাঁপবেনই তো। আসলে, দয়ালু মানুষরা ভীতুই হয়। দয়ার বৃহদংশ ভীতির দান। অন্যের কষ্ট, ভয় পেয়ে দয়ার্দ্র হয়।
আর কিছু বলেছে?
আপনার সঙ্গে যেন কোনো ছবি না তুলি এবং কোনো সম্পর্ক না রাখি।
তুমি কী বললে?
প্রথমটা রাখা সম্ভব, কিন্তু দ্বিতীয়টা সম্ভব হবে না। আমার উত্তর শুনে ম্যাম রেগে গেলেন। অনেক কথা শোনালেন। বেশ্যা, মাগি- – -। আমি চুপ করে শুনে গেলাম। অনেকক্ষণ ইচ্ছেমতো বকা দিলেন, গালি দিলেন।নতুন কিছু গালিও শুনলাম। কথার মাঝে একটা কথাও বললাম না। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে ম্যামই বলা থামিয়ে দিলেন।
তারপর! তারপর কী হলো? আমার বুক শঙ্কায় রক্তাক্ত।
আমি ম্যামকে বললাম― স্যার আমার বাবা। আপনি আমার মা। ম্যাম বললেন, “আমি তোমার চেয়ে বয়সে ছোটো, তুমিই আমার মায়ের বয়সি, তোমার মা হই কীভাবে?” আমি বললাম, “তাহলে আমি আপনার মা।”
এসব কী? ম্যাম আরও রেগে গেলেন। “ম্যাম“, আমি বলললাম, “বয়স সময়ের বিষয়, কিন্তু মা পুরোটাই মনের বিষয়। আপনি আমাদের মায়ের আসনে অধিষ্ঠিত। স্যার, আমাদের জন্মদাতা নন, কিন্তু বাবা, মানে প্রভু। তিনি আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখলেও আমাদের রাখতে হবে। তিনি আমাদের বর্তমানের সৃষ্টিকর্তা। অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যৎ তিনটি অনেক দূরের বিষয়, তবু কারও থেকে কাউকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। স্যার, আমাদের তেমনই একজন। সম্পর্ক রাখা মানে শুধু কথা বলা নয়, মনে রাখাও নয়; মনের গভীরে স্থান দিয়ে তাকে মনের মধ্যে নিবিড় আলেখ্যে লালন করা। বিপদে-আপদে পরস্পরের কাছে যাওয়া।
তোমার ম্যাম আর কী বলেছে?
তা বলা যাবে না।
কেন?
শুনলে আপনি কষ্ট পাবেন। এটুকু জেনে রাখুন, তিনি আমাদের তিন বোনকে আপনার রক্ষিতা মনে করেন।
তুমি কষ্ট পেয়েছ?
কষ্ট পাব কেন? এমন তো অনেকেই বলত, এখন বলে না। আপনি তো আমাদের রক্ষকই। রক্ষকের কাজই করে গেছেন আজীবন। এটা তো আর নতুন কিছু নয়। অনেক বার অনেকভাবে অনেকের কাছে রক্ষিতা শব্দটা শুনতে হয়েছে। এজন্য আপনাকেও তো কম কষ্ট পেতে হয়নি। দুবার বিভাগীয় মামলায় পড়তে হয়েছে, নয় কি?
কাজটা সে ভালো করেনি।
হয়তো সব মেয়েই ওরকম করত। ম্যামও করেছেন। তাঁর প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নেই। তাঁকে আমি আগের মতোই শ্রদ্ধা করি। তিনি তাঁর মনকে অকপটে খুলে দিতে পারেন। এমন কয়জনই বা পারে? আমি মনে করি, মা হিসেবেই তিনি আমাকে রক্ষিতা বলেছেন। আমার মাও আমাকে মাগি বলে গালি দিতেন। আমার এখনও মনে আছে। মাঝে মাঝে খানকি ডাকতেন।
আমি হেরে গেলাম, আর্দ্র গলায় বললাম।
রচনা বলল,
কিছু কিছু হার,
জয়ের চেয়েও চমৎকার।
কিছু কিছু পরাজয়,
আনন্দের মাল্যে সহাস্য মুগ্ধতা―
বর্ণিল বরাভয়।
আপনার কবিতা দিয়ে আপনাকে জবাব দিলাম। স্যার, আপনি হারেননি, হারই আপনার কাছে হেরে গেছে। প্রত্যেক মানুষ, সে যত প্রভাবশালী বা ধনীই হোক, কারও না কারো রক্ষক আবার কারও না কারও রক্ষিতা।
তুমি হলেও কি ঋধিতার মতো করতে?
অবস্থান আর বিবেচনা মানুষের আচরণকে প্রভাবিত করে। ওই অবস্থায় না গেলে কীভাবে বলব। মানুষ অবস্থানে না থেকে অনেক কথা বলতে পারে। আমিও তো মেয়ে না কি? বস্তির মেয়ে। সংসার নেই, আপন বলতে কেউ নেই। একটা বোন নেই, ভাই নেই, বাবা নেই, মা নেই। আপনি কী স্যার বিষয়গুলো কখনো ভেবে দেখেছেন?
হ্যাঁ।
তাহলে আমার এ অবস্থা কেন? বলেই কেঁদে উঠল রচনা।
আসলেই আমি রচনাকে বঞ্চিত করেছি, কিন্তু কেন করেছি, তা আমি জানি না। কেউ বলে ভুল করেছি আবার কেউ বলে উত্তম সিদ্ধান্ত। প্রত্যেক কিছুর ভালো-মন্দ দুটি দিক আছে। এখন এটাই আমার সান্ত্বনা। আমার সিদ্ধান্ত দেওয়ার সময় আসেনি। তবে বিবাহিত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি― ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করা মানে ভালোবাসাকে জীবন্ত আগুনে আজীবন দগ্ধ করা, দগ্ধ হতে থাকবে কিন্তু মরবে না― কী নৃশংস।
তার মানে, বলতে চাইছ তোমার ম্যাম ভুল করেনি।
তাঁর আচরণে অনেকে তাকে ভুল বুঝতে পারে, কিন্তু আমার কাছে তিনি সর্বোত্তম শ্রদ্ধার একজন অকপট মানুষ। তিনি কখনো ভুল করতে পারেন না। এ আপনার প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসার প্রভাব। তার ভয় আপনি আমাদের জন্য তাকে বঞ্চিত করতে পারেন― হোক তা কম বা বেশি, সত্য বা মিথ্যা। নারী মাত্রই নারী। দুর্বল বলে শঙ্কায় ভোগে বেশি।
তোমার এমন ধারণা কেন?
ম্যাম আপনাকে ভালোবাসেন। আমাদের প্রতি বিতৃষ্ণা আপনার প্রতি তাঁর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। ভালোবাসা মানুষকে শুধু অমায়িক করে না, হিংস্রও করে দেয়। এক্ষেত্রে মেয়েদের প্রতিক্রিয়া সকল হিংস্রতাকে অতিক্রম করে যায়। কারণ মেয়েরা দুর্বল। তাই দুর্বলের আশ্রয়ের প্রতি কারও দৃষ্টি তারা সহ্য করতে পারে না। আমি ম্যামের কথা এবং ব্যবহারে কষ্ট পাইনি। আপনিও পাবেন না। ভুলে যান; পরিবারের প্রতি যার এত মমতা, তিনি সবসময় শ্রদ্ধার। সবাইকে শেষ পর্যন্ত পরিবারেই ফিরে যেতে হয়; জীবনের জন্য যেমন মৃত্যু অনিবার্য তেমন সংসারীর জন্য অনিবার্য তার পরিবার।
তাহলে তুমি কী আর আমার সঙ্গে ছবি তুলবে না?
না।
কেন?
উত্তর দেওয়ার আগে ইন্টারকম বেজে ওঠল। মন্ত্রী মহোদয়, মানে সৈয়দ আবুল হোসেন। রচনাকে হোল্ড করার অনুরোধ জানিয়ে ইন্টারকমের রিসিভার তুলে নিলাম, স্যার?
তুমি কী লন্ডন যাবে?
কেন স্যার?
একটা সেমিনার আছে। মার্চের প্রথম সপ্তাহে।
অপ্রত্যাশিত সুসংবাদ আমার সব কষ্ট মুহূর্তে বিনাশ করে দিল। এরূপ অশেষ সুখের আকস্মিক আগমনকে ভাগ্য বলে।
যাব, স্যার।
খবরটি শুনে রচনা বিমোহিত খুশিতে অভিভূত হয়ে কেঁদে দিল,“অদ্ভুত এক আনন্দ আমাকে ঘিরে ধরেছে চারদিকে। ভাব্বা, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে খুশিতে। আমি এখন আনন্দে ভাসব। এই সংবাদ আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষে পরিণত করে দিয়েছে। মাঝে মাঝে খুব ছোটো খবরটাও কারও কারও কাছে ব্রহ্মাণ্ডের চেয়ে বড়ো হয়ে যায়।” তারপর একটু থেমে চিৎকার দিয়ে বলল, “কল্পু, ভাব্বা আসছেন।”
‘ওহ মাই গড, আনবিলিভেবল হ্যাপিনেস’ আমার কানের রিসিভার কল্পনার বিকট আনন্দ-চিৎকারে কেঁপে উঠল।
সেমিনার কখন?
মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে।
কিন্তু ভাব্বা, আগামী সপ্তাহ শেষ হলে যে ফেব্রুয়ারি।
তাই তো! তোমার বস্তিবাস তো এসেই গেল। মনে ছিল না আমার। ফেব্রুয়ারিতে করার কথা বলেছিলে।
বলেন তো ভাব্বা, এ বছর বস্তিবাসটি কোথায় পালন করার কথা? প্রস্তাবটি কিন্তু আপনি দিয়েছিলেন। আমি কেবল সম্মতি দিয়েছিলাম। এটাও ভুলে গেছেন?
কলকাতা। এত ভুলো মনে করো না।
ভাব্বা, ম্যামের কথায় আপনি কি খুব কষ্ট পেয়েছেন?
কষ্ট বেশি এবং কম―এটি কোনো বিষয় নয়, কিন্তু প্রতিক্রিয়া একই। মানুষ শুধু অন্যের সঙ্গে নিজের তুলনায় নিজের হতাশাটাকে প্রকট করে তুলতে চায়। তাই মানুষ প্রকৃত অর্থে সুখী না। সে কেবল সুখী হওয়ার চেষ্টা করে মাত্র। আচ্ছা, তুমি বলো তো― তোমার ম্যাম যদি একা তার বন্ধুর বাসায় যায় আমি কী করব?
আপনাকে আমি যতটুকু জানি, স্বাভাবিকভাবে নেবেন। ম্যামের প্রতি আপনার আস্থা অপরিসীম।
কিন্তু সে নিতে পারছে না, এটাই আমার কষ্ট।
সব মানুষের প্রকাশ একরকম নয়।
তাহলে পরিত্রাণ?
মহাজ্ঞানী গৌতম বুদ্ধ নির্বাণ লাভকে পরিত্রাণ লাভের একমাত্র উপায় বলেছেন। দুমিনিট আগেও আমার শরীর ব্যথায় কাতর ছিল এখন আনন্দে ডাগর। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। জীবন প্রকৃতির মতো অনিশ্চিত। ভাব্বা?
বলো।
আই লাভ ইউ, লাভ ইউ ভেরি মাচ।
“আই লাভ ইউ টু” বলে রিসিভার রেখে দিলাম। আমার মনপ্রাণ প্রশান্তিতে ভরে গেল। গত রাতের সব ভুল ফুলে ফুলে বাগান।
আহ সংসার!
কত মোহ তোমার।