সন্মিত্রা: চত্বারিংশ (৪০) পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
কল্পনার জন্য আমাকে যত কষ্ট করতে হয়েছে, যত কষ্ট পেতে হয়েছে এবং যত আবদার রাখতে হয়েছে— ইচ্ছা-অনিচ্ছায় বাকি তিন জনের জন্য তার এক শতাংশও করতে হয়নি। তবু কখনো বিরক্ত হইনি। বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেলে— কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে শাসন করার চেষ্টা করেছি। কল্পনা অন্যরকম। প্রতিভা আর প্রতিবাদের এক অপূর্ব সংযোজন। ফিঙের মতো সর্বদা সতর্ক থাকে।
হঠাৎ মন চলে গেল অতীতে।
সিলেট যাচ্ছিলাম বাসে করে। আমি আর রচনার পিছনের সিটে আল্পু-কল্পু। সামনে টুটুল আর দীপন। দীপন মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক সাহেবের ছেলে। তিনি আমার প্রকাশকদের একজন। হঠাৎ শোরগোল শুনে পিছনে তাকাই। কল্পনা এক লোকের গালে চড় মেরে দিয়েছে। ভদ্রলোক বয়স্ক— মাথায় টুপি, মুখে দাড়ি।
চড় খেয়ে তিনি থ।
“ভাব্বা ভাব্বা” করে চিৎকার করছে কল্পনা।
কী হয়েছে? আমি উদগ্রীব।
লোকটা আমার গায়ে হাত দিয়েছে। একবার নয়, কয়েকবার। নিচে পা দিয়ে গুঁতোও দিয়েছে। অনিচ্ছাকৃত ভেবে প্রথমে চুপ করে ছিলাম।
তাই বলে চড় দেবে?
কেন দেবে না? একশ বার দেব। এসব ক্ষেত্রে ধৈর্য দুর্বলতার নামান্তর।
লোকটি লজ্জায় ভীষণ কাতর।
আমতা আমতা করে বলল, অসাবধানতায় লেগে গেছে।
“কয়বার লাগে”, বলে কল্পনা লোকটির গালে আকস্মিক আর একটা চড় বসিয়ে দিয়েছিল। আমি হতভম্ব। কিন্তু বাসের লোকজন কল্পনার পক্ষ নিয়ে নিল মুহূর্তে। ভদ্রলোকের পাশে এক মহিলা। সম্ভবত তার স্ত্রী। তিনি বোরকা-ঢাকা হাত দিয়ে লোকটাকে টেনে বসিয়ে দিলেন। বাধ্য হয়ে সিট বদল করে নিয়েছিলাম।
চলাফেরার সময় ঢাকায় মেয়েরা রাস্তাঘাটে আর যানবাহনে কত ইভটিজিঙের শিকার হয় এবং তা কত অপমানজনক হতে পারে তা আমি না জানলেও বিয়ের আগে তিন যুবতি মেয়ের বাবা হওয়ার কারণে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। কল্পনাকেও ইভটিজিঙের শিকার হতে হয়েছিল। সে ঘটনাও মনে পড়ে গেল।
কল্পনা স্কুল থেকে বাসায় ফিরছিল। একটা ছেলে পেছন থেকে এসে তার ওড়না ধরে টান দিয়ে অশ্লীল ইঙ্গিত করল। কল্পনার সঙ্গে ছিল তার দুই বান্ধবী। তারা ভয় পেয়ে গেল। কল্পনা রাস্তা হতে কোয়ার্টার সাইজের একটা ইট নিয়ে ছেলেটার মাথায় ছুড়ে দিল। ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে ঢলে পড়ল রাস্তায়। মুখ লাল হয়ে গেল রক্তে।
দৌড়ে এসেছিল লোকজন।
কে মেরেছে?
“আমি”, কল্পনা বলেছিল, “ আরও মারব। একদম মেরে ফেলব।”
কেন মারলে?
সে আমার ওড়না ধরে টান দিয়েছে। আপনাদের মধ্যে কি কেউ এই অসভ্য ছেলেটির মা-বাবা, ভাইবোন বা আত্মীয়স্বজন? বলুন, তাকেও মারব।
কয়েকজন বললেন, এই ছেলেটা প্রায় সময় এখানে দাঁড়িয়ে মেয়েদের বিরক্ত করে। বহুদিন পর উচিত শাস্তি পেয়েছে হারামজাদা।
একজন বলল, সেদিন আমার মেয়ের ওড়না ধরেও টান দিয়েছিল। ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারিনি। এই মেয়েটি প্রতিবাদ করেছে। আমাদের উচিত তাকে সাহস দেওয়া। এসো, সবাই তাকে উৎসাহিত করি। ছেলেটিকে থানায় নিয়ে যায়।
“থানায় পড়ে যান”, কল্পনা বলেছিল, “আগে ছেলেটাকে হাসপাতাল নিয়ে যান। নইলে মরে যাবে।” লোকজনকে হাসপাতালে বা থানা কোথাও যেতে হয়নি। পুলিশ এসে নিয়ে গিয়েছিল।
এরপর থেকে ঢাকার মতো রাস্তায় চলতে গিয়ে তাকে আর ইভটিজিঙের শিকার হতে হয়নি। একদিনের মধ্যে ভয়ংকরী হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গিয়েছিল। বাসায় এলে ঘটনা জানতে পেরে বলেছিলাম, এত রাগ তোমার? ভদ্র হয়ে চলতে পার না?
ভাব্বা, ভদ্র মানে কি বোরকা পরে চলা?
সরি।
ভদ্রদের সবাই টিজ করে। ওড়না ধরে টানে। ওড়নার প্রতি কেন পুরুষের এত লোভ? অভদ্রদের সবাই সমীহ করে। এজন্য আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যত পারি অভদ্র হব। এবার বইয়ের ব্যাগে ছুরি রাখব। আর একটু বড়ো হলে পিস্তল নেব। ভাব্বা, আপনি আমাকে পিস্তলের একটা লাইসেন্স করে দেবেন। দেবেন তো?
দেব।
সুন্দর এবং মেধাবী বলে ভেতরে ভেতরে একটা অহংকার কাজ করত কল্পনার। কিন্তু আমার কাছে এলে গলে পড়ত আগুন লাগা মোমের মতো। আমি মনে করতাম বিনয়। আসলে বিনয় নয়, শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতার সজ্জায় গড়ে ওঠা ভালোবাসা, আনুগত্য এবং কৃতজ্ঞতা। ভালোবাসা সকল অহংকারকে গলিয়ে বিনয় করে দেয়। যেমন তাপ গলিয়ে দেয় বরফকে। এজন্য ভালোবাসাকে মানুষের শ্রেষ্ঠ মনোবৃত্তিক সম্পদ বলা যায়।
অনেক সময় অনেকে কল্পনার আচরণে কষ্ট পেয়েছে। একবার গৃহশিক্ষক মনোজ ধরের মুখেও চড় মেরে দিয়েছিল। মনোজ কোনো অভিযোগ করেনি। টুটুলই বলেছিল আমাকে। আমি কিছু জানতে চাইনি। মনোজকেও কিছু বলিনি। যদি প্রয়োজন হয় সেই বলবে। কিছু কিছু বিষয় দেখেও না- দেখার ভান করা উত্তম। যদি সমস্যাটা ওখানেই থেমে যাওয়ার মতো হয়।
মনোজকে চড় মেরেছিল কেন? কয়েকদিন পর আল্পনার কাছে জানতে চেয়েছিলাম।
ভাব্বা, যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। মনোজ স্যার উচিত শিক্ষা পেয়েছেন।
বুঝে গিয়েছিলাম কী হয়েছিল। কয়েকদিন পর মনোজকে বিদায় করে দিয়েছিলাম। মনোজ মাথা নিচু করে মাসের বেতনটা নিয়ে চলে গিয়েছিল।
একদিন কাছে ডেকে আদুরে গলায় বলেছিলাম, কল্পু সোনা, তোমার অনেক অহংকার।
অহংকার নয় ভাব্বা। ব্যক্তিত্ব রক্ষার হাতিয়ার। আমার নিজকীয়তা রক্ষার জন্য যতটুকু প্রয়োজন আমি ততটুকু অহংকারী হব। ভাব্বা, আমি কি আপনার কাছে অহংকারী?
না।
তাহলে আমি অহংকারী নই। পৃথিবী শুদ্ধ বললেও।
কিন্তু সবাই যে বলে?
আমার অ্যাটিচিউট যারা সহ্য করতে পারবে না তারা আমাকে অহংকারীই তো বলবে। ওরা আমার কাছে দূরে থাকুক। আমি কাউকে ডেকে তো অহংকার দেখাই না!
“পেকে গেছ দেখি?” বলে মাথায় খোঁচাদর দিয়েছিলাম। ব্যথা পাওয়ার ভান করে ভোঁ দৌড় দিয়েছিল কল্পনা। এখনও সেরকম রয়ে গেছে সে, যদিও গতরে আগের সেই ছোটোটি নেই।
সামান্য অসংগতিও সহ্য করার ধৈর্য কল্পনার ছিল না। আমি তার ভয়ংকরে ভীষণ সৌন্দর্য দেখতে পেতাম। তাই সব কিছু নীরবে দেখতাম। একদম অভিন্ন চরিত্র দেখা যায় প্রমিতায়। চেহারাটাও একই রকম। এমন ভয়ংকরী কল্পনা বিয়ের পর স্বামীর একান্ত অনুগত স্বৈম হয়ে গেছে। এই আনুগত্যের মর্যাদা কি তাহসিন দিতে পারবে?