সন্মিত্রা: একচত্বারিংশ (৪১) পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
লন্ডনে এখন বসন্ত।
রচনা বাসায় নেই, কল্পনাও। পিচ্চিরা স্কুলে। টুটুল আপাতত রান্না ঘরে নিনিকে সাহায্য করছে। তারা আমার বিদায় দিনে নতুন খাবার বানাবে। অনেককে নেমন্তন্ন করা হয়েছে। আসবে চিকুচি, সুসানা, মাসাহিতো এবং আরও অনেকে।
আল্পনা আমার পাশে বসে জামাল নজরুল ইসলামের দি আল্টিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স পড়ছে। কীভাবে যে এত জটিল বইয়ে সময় দিতে পারে— অবাক লাগে ভাবতে। সে চোখেমনে পড়ছে। আর মাঝে মাঝে অবাক বিষয়গুলো আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। না-বুঝতে পারলে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের মতো বকা দিয়ে চিমটি কাটছে। আমার প্রতি এদের এমন আগ্রহ আর যত্ন আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো পাওয়া বলে মনে করি।
ঢাকায় আমার এক বন্ধু বলেছিল— “তোমার অ্যাডপ্টেট মেয়েগুলো তোমাকে যে ভালোবাসা দিচ্ছে তার লাখ ভাগের একভাগও যদি ঔরসজাত সন্তান-সন্ততির কাছ থেকে পাওয়া যেতে, তাহলে অভিধানে অসুখী শব্দটির প্রয়োজন হতো বলে মনে হয় না। তখন পৃথিবীর কোনো মানুষই নিজেকে অসুখী বলার কারণ খুঁজে পেত না। মৃত্যু যন্ত্রণাও সুখে সুখে গল্প হয়ে যেত।
আল্পনা ঢাকার মতো লন্ডনেও চুপচাপ, নীরব। সে সব কষ্ট ভেতরে রেখে দিতে পারে। অভিযোগটাও করে আদরের চেয়েও নিরীহ গলায়। দূর থেকে নীরবে আমার সব যত্ন করে যেত। এখনও তেমন। কল্পনার ভালোবাসায় জোয়ার আছে। জোয়ার আছে বলে স্রোতও আছে, কিন্তু জোয়ারের স্রোত বিরামহীন ধীরস্থির। তাই সাধারণত দৃশ্যমান নয়। তবে টুইটম্বুর। তার জোয়ার ফুলে ওঠে নীরব মমতায়, সমস্ত স্নেহরাশি ফল্গুধারার মতো অদৃশ্য থেকে যায় ভেতরে। আমার যে প্রয়োজন ভুলে বা ব্যস্ততার কারণে সবার নজর এড়িয়ে যেত, সে প্রয়োজনটি পূরণে আল্পনা এগিয়ে আসত। এমন ভুলের জন্য সে অপেক্ষায় থাকত। হয়তো প্রার্থনা করত যাতে সবার এমন ভুল বেশি বেশি হয়। সবার দৃষ্টি যেন আমার কিছু প্রয়োজনকে এড়িয়ে যায়, যাতে সে তা পূরণ করে দিতে পারে।
ঘুম আমার খুব প্রিয়, সে যখনই হোক। রচনা আর আল্পনা বিষয়টা খুব কড়াভাবে নজর রাখত। যেন কেউ আমার ঘুমে ব্যাঘাত করতে না পারে। তবে কল্পনা সুযোগ পেলেই আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিতে কসুর করত না। বিরক্ত লাগলেও তার উচ্ছ্বাস আর আনন্দে আমার বিরক্তটাই রিক্ত হয়ে সিক্ত হয়ে উঠত মমতায়। আসলে আমার সঙ্গ পেতে ইচ্ছে করলে সে কিছুই মানত না।
এখন তারা বড়ো হয়েছে, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিক্ষালয়ে অধ্যাপনা করে। তবু আমার কাছে তারা সেই প্রথম পরিচয়-দিনের মতো অতীত হয়েও বর্তমান। তারা জানে কীভাবে ছোটো থাকতে হয়। যারা এটি জানে তারা বড়ো না হয়ে কে বড়ো হবে?
এটাই কী তাহলে আশীর্বাদ?
হঠাৎ দরজায় পায়ের মিষ্টি শব্দ। এমন মিষ্টি পদচারণা কেবল কল্পনাই দিতে পারে। নিশ্চয় কলেজ থেকে ফিরে এসেছে। মিষ্টি পদশব্দের সঙ্গে ভেসে এল মিষ্টি গলা, ভাব্বা— আমি এসে গেছি।
সঙ্গে সঙ্গে আল্পনার ফিসফিস প্রতিবাদ, তোমার কী সাহস।
মনটা আবার চলে যায় ঢাকা। নভেম্বর শেষ দিকের ঘটনা। অনেক বছর আগের কথা। কল্পনা তখন নবম শ্রেণিতে। আল্পনা এক ক্লাস ওপরে। এখনো স্পষ্ট মনে আছে। সেদিনও ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় এভাবে চোখ বন্ধ করে ভাবছিলাম। পাশে বই পড়ছিল আল্পনা।
ঝড়ের বেগে দৌড়ে এসে বলেছিল, ভাব্বা— আমি এসে গেছি।
কল্পনা বলেছিল, চুপ, একদম কোনো কথা নেই।
আমি কী করলাম?
ভাব্বা রেস্ট করছেন। কথা বলবা না।
তোমার কী? ইচ্ছে হলে তুমিও বলো। ভা ব্ বা- – -।
কিন্তু ভাব্বা যে ঘুমাচ্ছেন। তাঁর পাতলা ঘুম। যদি ভেঙে যায়? ঘুম ভাঙলে যদি মাথা ব্যথা করে? বড়ো হচ্ছ, কিন্তু বুদ্ধি বাড়ছে না, বুদ্ধ কোথাকার।
দেখি?
কল্পনা জোর গলায়, কিন্তু নিচুকণ্ঠে বলল।
ডাকবে না। ভাব্বার ঘুম ভেঙে যাবে।
আমি ডাক দিলাম, কল্পু?
শব্দের চেয়ে দ্রুতবেগে রুমে ঢুকে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়াল।
বোসো।
বসল না। আল্পনার দিকে তাকিয়ে বলল, আপু, তুমি আমার জায়গায় বসলে কেন?
তোমার জায়গা হবে কেন?
ভাব্বার ওপাশে তো সবসময় আমিই বসি, তাই না আপু?
আমি বললাম, কল্পু, তুমি কিন্তু ভালো মেয়ে।
ভালো মেয়ে কী করে?
যারা ভালো মেয়ে তারা বড়োদের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করে। সুন্দরভাবে কথা বলে। যারা ভালো ব্যবহার করে তারাই ভালো মেয়ে।
ভালো কীভাবে হতে হয়?
কথা আর আচরণ দিয়ে ভালো হতে হয়। যার মুখের কথা ভালো নয়, তার অন্তর কীভাবে ভালো হয়? ভালোরা উদার হয়। বেড়োদের শ্রদ্ধা করে। ছোটোদের স্নেহ করে।
“আমি কিন্তু ভালো হব।”, কল্পনা বলল, “তবে আমার জায়গা কাউকে ছেড়ে দেব না। বিচার মানি, কিন্তু জায়গাটা আমার।”
তা তো হবে না গো মা। আল্পু যে তোমার বড়ো।
আমার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে দিয়ছিল কল্পু। শিশুর মতো বিগলিত কান্নাকে জমাট করে দিয়ে বলেছিল, আমাকে কেউ পছন্দ করে না। ছোটো বলে সবাই ঘৃণা করে। আমি আর কোনোদিন কারও কাছে কিছু চাইব না, খাব না। ভাব্বা, আমাকে এত অপছন্দ করেন কেন?
তার কান্নায় ছুটে এলো টুটুল। আল্পনা হতভম্ব হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে বলল, তাহলে আমি যাই?
না, বসো। আমার মাথাব্যথা করছে।
আল্পনা মাথা টিপতে শুরু করতেই বাধা দিল কল্পনা, আমি টিপব।
নিনি চা নিয়ে এলো সবার জন্য। তাদের আগমন আমার মনকে অতীত থেকে বর্তমানে নিয়ে এল। ভালো লাগছে না। আজিই রওনা দেব ঢাকার উদ্দেশে। মনটা কেমন জানি করছে। চা-নাশতা শেষ করার আগে ফিরে এল রচনা। সঙ্গে প্রমিতা। তারা দুজন আগামী মাসে বাংলাদেশ যাচ্ছে। সব কর্মসূচি ফাইনাল। টিকিটও হয়ে গেছে। এখন কেবল যাওয়াটাই বাকি।
“স্যার”, রচনা বলল, “আপনার ফ্লাইট কয়টায় মনে আছে?”
হ্যাঁ।
হ্যান্ডব্যাগ ছাড়া বাকি দুটো লাগেজ গাড়িতে তুলে রেখেছি।
তোমার কাজ অতুলনীয়। তুমি- – -।
মোবাইলের শব্দে আমার কথা থেমে গেল। মোবাইলের পর্দায় ঋধিতা।
কখন রওনা দিচ্ছ?
রাত এগারোটায় ফ্লাইট।
খেয়েছ?
হ্যাঁ।
আপনের চেয়ে পর ভালো।
একথা হঠাৎ?
এর কারণ আছে।
কী কারণ?
আপন আপনাকে দেখতে পায় না। মেয়েগুলো তোমাকে কত যত্নখাতির করে। লন্ডনের মতো জায়গায় দিনের পর দিন পিতৃ আদরে রাখে। একজন মানুষের শরীর অন্য মানুষ যেভাবে দেখতে পায় নিজে সেভাবে দেখতে পায় না। আয়নার সাহায্য নিতে হয়। তারপরও পুরো দেখা যায় না। আপনও ঠিক তেমন। এজন্য সক্রেটিস নিজেকে জানার জন্য উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। বউটাকে হারামজাদা একটা দিনের জন্যও শান্তি দেননি।
হঠাৎ এ কথা?
অমুয়া এসেছে।
অমুয়া মানে আমার শালিকা। খুব খাতির। কবির ভাষায়, “শালি আমার কুচকুচে কালো/ তবু শালি বউয়ের চেয়ে হাজারটা গুণ ভালো।”
অমুয়াকে দাও।
এখন তো দরদ উথলে উঠবে। বুঝি না মনে করো, সব বুঝি। নাও কথা বলো সাধের শালির সঙ্গে। যত্তোসব!
অমুয়া বলল, কেমন আছ তুমি?
ভালো নেই।
কেন?
কতদিন দেখি না ওই সুন্দর মুখ,
মায়াবি কথা, রুপোলি হাসি—
স্নিগ্ধ মমতার অবারিত সুখ।