সন্মিত্রা: ত্রিচত্বারিংশ (৪৩) পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
রচনা আর প্রমিতা বাংলাদেশে। তাদের আগমনে আমার আনন্দ উল্লাস-বিলাসে বাংলাদেশ। লম্বা ছুটি রচনার। প্রমিতা বেড়ানোর ফাঁকে গবেষণার কাজ করবে। বাংলাদেশে তার গবেষণার উপযুক্ত স্থান কক্সবাজার। এখানে দেশের প্রায় সব প্রধান ধর্মাবলম্বীর আনাগোনা। বান্দরবান কাছে। তাই উপজাতীয়দেরও পাওয়া যাবে।
ঢাকা আসার পরদিনই রওয়ানা দিলাম কক্সবাজার। কয়েকদিন থাকব। ঋধিতাকে বলেছি সরকারি কাজে কক্সবাজার যাচ্ছি। বিশ্বাস করেছে কি না জানি না। এসব দাম্পত্যিক কথা বিশ্বাস করা আর না-করা সমান। তাই না করে কোনো লাভ নেই। করলেও কোনো ক্ষতি নেই। দাম্পত্য জীবনে মিথ্যা এবং সত্যা দুটো এত অঙ্গাঙ্গি যে, কোনটি সত্য এবং কোনটি মিথ্যা তা নির্ধারণ করার কোনো উপায় থাকে না। গিয়াস কামাল চৌধুরী আমাকে শিখিয়ে দিয়েছেন দাম্পত্য জীবনে মিথ্যা বলার মতো লাভ এবং পুণ্য আর নেই।
মুহরি নদী পার হয়ে মাইল সাতেক যাবার পর বাজার। সবজি দেখে রচনা গাড়ি থামাতে বলল। সে সবজি বাজরে যাবে।
ম্যাম জায়গাটির নাম কী? গাড়ি একদম থেমে যাওয়ার পার প্রমিতা বলল।
মীরসরাই।
এমন নাম কেন?
মোগল আমলে এখানে একটি সামরিক ঘাঁটি ছিল। ঘাঁটির ভেতর ছিল একটি সরাইখানা। সেখানে মীর সাহেব নামের এক দরবেশ থাকতেন। এলাকাবাসারী কাছে তিনি ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র। একদিন মীর সাহেবে মারা যান। সরাইখানার ভেতরে তাকে কবর দেওয়া হয়। এরপর থেকে জায়গাটির নাম মীরসরাই।
আমি আর রচনা গাড়ি থেকে নামলাম। প্রমিতা গাড়িতে বসে। সবজি কেনা রচনার একটি সখ। প্রয়োজন নেই তবু সে অনেকগুলো সবজি নিল। ঠিক করলাম, সবিজগুলো চন্দনাইশ আমাদের গ্রামের বাড়ি দিয়ে যাব। দুজন লোক সবজিগুলো আমাদের গাড়ির পিছনে তুলে দিল।
প্রমিতা গোমড়া মুখে বসে আছে।
কী হয়েছে? জানতে চাইলাম।
একজন হুজুর লোক আমার কাছে একটি রশিদ বই এগিয়ে দিয়ে আল্লাহর ঘর মসজিদ বানানোর জন্য সাহায্য চাইলেন।
নিশ্চয় তুমি তিক্ত কথা বলেছ?
হ্যাঁ।
কী বলেছ?
বলেছি— “আল্লাহ সারা ব্রহ্মাণ্ড বানিয়েছেন। মানুষকেও বানিয়েছেন। তার আবার নিজের ঘর বানানোর জন্য মানুুষের সাহায্য লাগবে কেন?”
তারপর কী হলো?
আমার কথা শুনে লোকটি মন খারাপ করে চলে গেলেন।
প্রমিতার কথা শুনে রচনা বলল, মুক্ত বিশ্বের উচ্চশিক্ষিত লোক হয়েও তুমি নিজের জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারনি। তোমার জিহ্বা ধর্মান্ধের মতো বিষাক্ত হয়ে গেছে। ইউ কলড দিস জেন্টলম্যান অ্যান্ড বেগ পারডন টু হিম। আদারওয়াইজ ইউ উইল বি রিপোর্টেড।
অক্সফোর্ডে একবার রিপোর্টেড হওয়া মানে সার্টিফিকেট হতে বঞ্চিত হওয়া। ততক্ষণে অনেক লোক জমে গেছে। পথঘটনা কিংবা সুন্দরী মেয়ে দেখলে বাঙালিরা কবর থেকে উঠে মহাসমাবেশ বসিয়ে দেয়। এখানে তো আর বেকারের অভাব নেই। লোকটাকে দেখা যাচ্ছে। প্রমিতা দৌড়ে গিয়ে ডেকে নিয়ে এল। সবার সামনে লোকটাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বিনয়ের সঙ্গে তার বক্তব্যের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করল।
প্রমিতার ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গি দেখে লোকটি খুশি হলেন। এরূপ কথা তাকে অনবরত শুনতে হয়। কিন্তু এমন ক্ষমা চাওয়ার ঘটনা জীবনে এ প্রথম।
“চাচা”, রচনা বলল, “আপনি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন তো?”
বাইচ্চা মাইয়া, খমা ন গরি উপায় কী মা?
“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ”, প্রমিতা বলল, “নেন, আল্লাহর ঘর মসজিদের জন্য আমি পাঁচ হাজার টাকা দিলাম।
এত টাকা দেখে লোকটি অবিশ্বাসের চোখে প্রমিতার দিকে তাকিয়ে বলল, মজা করছেন না তো মা?
না। কাউকে উপহাস করা মজা নয়, সাজা।
টাকাগুলো নিয়ে লোকটি কথা দিয়ে আমাদের সবাইকে অশেষ কৃতজ্ঞতায় মোহিত করে দিলেন। গড়ি আবার ছুটল কক্সবাজারের দিকে। কিছুদূর যাওয়ার পর প্রমিতা সাইনবোর্ড পড়ে বলল, এটা নিজামপুর। মনে হয় আর একটি উপজেলা।
“না”, রচনা বলল, “মীরসরাই উপজেলার একটা ইউনিয়ন। জায়গাটা ছিল আরাকান বুড্ডিস্ট শাসকদের এলাকা। ১৩৪০ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান ‘ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ’ চট্টগ্রাম অধিকার করে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। রাজধানী ছিল সোনারগাঁও। প্রথমে তিনি কুমিল্লা ও নোয়াখালী জয় করেন। এরপর উত্তরে সিলেট ও দক্ষিণে চট্টগ্রাম জয় করেন।
প্রমিতা বলল, তাঁর শাসনামলেই তো মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলাদেশে এসেছিলেন।
“ঠিক বলেছ”, আমি বললাম, “মোবারক শাহের পর গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ’ এবং তাঁর পুত্র নুসরাত শাহ এর আমলে পরাগল খান ও ছুটি খান এই অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন। শেরশাহ সুরি নাম শুনেছ?
শুনেছি, স্যার।
শের শাহ সুরি একজন আফগান। তিনি সাধারণ সেনাকর্মচারী থেকে মোগল সম্রাট বাবরের সেনাবাহিনীর সেনানায়ক হয়েছিলেন। তাঁকে বিহারের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়। ১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট হুমায়ুন অভিযানে ব্যস্ত। এ সুযোগে শের শাহ বাংলা জয় করে সুরি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেন। শের শাহের শাসনামলে তাঁর ভাই নিজাম শাহ শাসনকর্তা হন। তাঁর নামানুসারে এই এলাকাটির নাম হয় নিজামপুর।
সীতাকুণ্ড কোথায়? প্রমিতা জানতে চাইল।
এটি আর একটি উপজেলা।
চন্দ্রনাথ পাহাড়?
সীতাকুণ্ড উপজেলায়।
“আমি দেখব”, প্রমিতার কথায় শিশুর আবদার, এই এলাকায় সীতার শরীরের একটি টুকরো পড়েছিল। যদিও মাংসটি এখন নেই। তবু দেখতে খুব ইচ্ছে কোথায় পড়েছিল। ম্যাম, দেখতে দেবেন?
“না”, রচনা আধ্যাপিক গলায় বলল, “অত সময় নেই।”
প্রমিতা সমর্থনের আশায় আমার দিকে মায়াভরা চোখে তাকাল। আমি বললাম, দেখতে পারবে।
থ্যাংক ইউ স্যার।
“তবে দূর থেকে”, গাড়ি করে যেতে যেতে। “সীতাকুণ্ড শহরের পূর্বে চন্দ্রনাথ শৃঙ্গ। এগারোশ বাহান্ন ফুট উঁচু। এটি চট্টগ্রামের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।
তাহলে কি দেখতে পাব না?
আসার পথে দেখো, রচনা বলল।