সন্মিত্রা: পঞ্চচত্বারিংশ (৪৫) পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
মাটিতে শীতল পাটির বিছানায় শুয়ে নিরীহ রাতটাকে সকাল করে দিলাম। বড়ো শান্তিতে গেল। ঘুমে বিভোর ছিল মন, তাই স্বপ্ন ছিল না মোটেও। শান্তির পাখায় চড়ে স্বপ্নশত্রু নিদ্রার গভীর আবির্ভাব ঘটে। স্বপ্ন হচ্ছে অনিদ্রা রোগে আক্রান্ত হতভাগাদের দারুণ উপসর্গ। এমন উপসর্গ যাদের দেখা যায় তাদের অধিকাংশই লোভ আর উচ্চাশার যাতাকলে পড়ে অর্ধেক মানব এবং অর্ধেক জানোয়ারের মন দিয়ে তৈরি উদ্ভট জীবে পরিণত হয়। অধিকাংশ মানুষই এই উদ্ভট জীবের কাতারে। কারণ, মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী স্বপ্ন দেখে না। স্বপ্ন হচ্ছে লোভ আর উচ্চাশার মিশ্রণ। এই মিশ্রণ মনের শান্তি কেড়ে নেয়। তাই স্বপ্ন তাদের ঘুমোতে পর্যন্ত দেয় না।
প্রমিতার কথা জানি না। আমার খুব ভালো ঘুম হয়েছে। পাখির কিচিরমিচির আর মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙল। হোসেন আর তার বউ বালতিতে করে পানি এনে রেখেছে হাত-মুখ ধোয়ার জন্য।
প্রমিতা কোথায়?
হোসেন বলল, আমার ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে বাইরে ঘুরছেন।
ডাক দিলাম। কাছেই ছিল। চলে এল সহসা।
কিছু বলবেন, স্যার?
হাত-মুখ ধুয়ে নাও। বালতিতে জল আছে।
আমি পুকুরে ধোবো।
পইড়া যাবেন যে দিদি, হোসেনের বউ বললেন।
পড়লে তো ভালোই হয়, সাঁতার কাটার সুযোগ পাব।
সত্যি সত্যি পুকুরে চলে গেল প্রমিতা। হোসেনের বউ এবং মেয়েরা চারদিকে ঘিরে। আমার সঙ্গে শুধু হোসেন। পেছনে পেছনে আমিও গেলাম। পুকুরের ঘাট পাকা নয়। একটা বড়ো খেজুর গাছ কাত করে বানানো। অভিজ্ঞ না হলে পড়ে যেতে পারে। প্রমিতার বাবা সহস্র কোটি টাকার মালিক; বিশাল ধনীর একমাত্র কন্যা সে। এমন ঘাটে নামা দূরে থাক, চোখেও দেখেনি কখনো। যদি পড়ে যায়? সমস্যা নেই। সে অ্যাথলেট, ভালো সাঁতার জানে।
নেমো না।
প্রমিতা আমার কথা শুনতে পেল না, কিংবা শুনতে পেয়েও পাত্তা দিল না। সে নামতে শুরু করল এবং কিছুদূর নামার পর কলকাতার বিখ্যাত শিল্পপতির মেয়ে প্রমিতা ধপাস করে পড়ে গেল পুকুরের টলটল কৃষ্ণকালো জলে। আমি ভালোভাবে খেয়াল করে দেখলাম— সে না পড়লেও পারত। ইচ্ছে করে পড়ে গেছে। অসুবিধা নেই, কাপড় এনেছে। হোসেনের মেয়েরাও লাফ দিল পুকুরে। আমারও ভালো লাগছিল তাদের সাঁতার।
ত্রিশটা মিনিট অযথা নষ্ট করে দিল জলে। কিছু করার নেই। মাঝে মাঝে এমন নষ্ট সময়গুলো শ্রেষ্ঠ সময়ের চেয়েও কেষ্ট হয়ে উঠে।
রচনার ফোনে অতিষ্ঠ হয়ে নির্দেশ দিলাম, পুকুর ছাড়ার। ব্রেকফাস্টে এল হোসেনের বাগানের — কলা, পেয়ারা, পেঁপে, সবজি আর ঘরে লালিত মুরগির মাংস। সঙ্গে চালের রুটি।
প্রমিত, কেমন লাগছে তোমার?
সুইজারল্যান্ড, প্যারিস, মোনাকো প্রভৃতি দেশে সেভেন স্টার হোটেলে থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় নিম্নমধ্যবিত্ত ড্রাইভারের অতি সাধারণ ঘরে কখনো ছিলাম না। কখনো খাইনি এমন ঘরে। আমি স্যার তৃপ্তির মহানন্দে অভিভূত। এত শান্তি, এত তৃপ্তি এত ঐশ্বর্য, ওহ মাই গড! স্যার, কী অভাবিত প্রাপ্তি।
সত্যি বলছ?
স্যার, আমার অতীতের সমস্ত সুখানন্দ হোসেন-দাদার এক লোকমা ভাতের কাছে কী অবলীলায় তুচ্ছ হয়ে গেল! আমরা আসলে কত দরিদ্র, হোসেনরা আসলে কত ধনী! প্রাচুর্যে ডুবে থাকলে অমৃতও পানসে জল হয়ে যায়।
তাড়াতাড়ি করো, ড্রাইভার রেডি হয়ে আছেন।
আরেকটা দিন থাকি?