Warning: Constant DISALLOW_FILE_MODS already defined in /home/draminb1/public_html/wp-config.php on line 102

Warning: Constant DISALLOW_FILE_EDIT already defined in /home/draminb1/public_html/wp-config.php on line 103
সন্মিত্রা : এক মলাটে সন্মিত্রা: সন্মিত্রা সম্পূর্ণ উপন্যাস : প্রথম থেকে শেষ পর্ব – Page 46 – Dr. Mohammed Amin

সন্মিত্রা : এক মলাটে সন্মিত্রা: সন্মিত্রা সম্পূর্ণ উপন্যাস : প্রথম থেকে শেষ পর্ব

সন্মিত্রা: ষট্‌চত্বারিংশ (৪৬) পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন

বিমানবন্দরে জামাল নজরুল ইসলামকে দেখে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠার কথা, কিন্তু পারলাম না।  দেখামাত্র মনে পড়ে গেল মানমন্দির প্রকল্পের কথা। লজ্জায় বুকটা কাঁপছে। কিছুই করতে পারিনি।“স্যারকে কী বলব?”, ফিসফিস করে রচনাকে বললাম। ইচ্ছে করছিল এড়িয়ে যেতে, কিন্তু তা মোটেও শোভনীয় হবে না। লজ্জা ঢাকার জন্য সম্মানবোধকে  অপমানের কালিমায় লিপ্ত করা হবে ভণ্ডামির নামান্তর। সামানে গিয়ে সালাম দিলাম।

কুশল বিনিময়ের পর রচনাকে দেখিয়ে বললাম,  আমার মেয়ে রচনা। অক্সফোর্ডের শিক্ষক।

খুব ভালো।

পাশের জন প্রমিতা, ভারতীয় বাঙালি। পিএইচডি করছে অক্সফোর্ডে। দুজনেই বাংলাদেশে এসেছিল বেড়াতে। আজ চলে যাচ্ছে। বিদায় দিতে এলাম।
তুমি যাচ্ছ না?
না।
রচনার দিকে তাকিয়ে জামাল নজরুল ইসলাম বললেন, বাংলাদেশে চলে এসো।
চলে আসতে চেয়েছিলাম। স্যার নিষেধ করলেন। তাই আসা হয়নি। এখন আর সে সুযোগ নেই। আমি বাংলাদেশি পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে পুরোদমে ইংরেজ হয়ে গেছি।
স্যার কে?
সরি, স্যার নয় বাবা। বাবা  নিষেধ করেছেন।
কেন? আমার দিকে তাকিয়ে জামাল নজরুল ইসলাম জানতে চাইলেন।
এই দেশে সে ছাত্র পাবে না। মর্যাদা পাবে না। আপনার মতো ধনী নয় সে। মৌলিক চাহিদা মেটানোর অর্থ পাবে না। দেশের জন্য কিছু করতে চাইলে আমার মতো মামলা খেতে হবে। অপাঙ্ক্তেয় হয়ে থাকবে। কথা বলার জন্য মনুষও পাবে না।  ওখানে চিকুচি আছ, মাসাহিতো আছে, সসুনা আছে, স্টিভেন হকিং আছে, ফারহিদা আছে। বাংলাদেশে এলে তাকে আপনার মতো পদে পদে অপমানিত হতে হবে।
“স্যার”, রচনা বলল, “আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে গর্ববোধ করছি। অক্সব্রিজে আপনার অনেক প্রশংসা শুনি।”
আমার মান মন্দির প্রকল্পের কী হলো?
এই প্রশ্নটার জন্য ভয়ে ছিলাম। লজ্জানত মাথাটাকে আরও নত করে বললাম, মান মন্দিরের জন্য সরকার এক কোটি টাকা দিতে রাজি হয়েছে। এর বেশি চলতি অর্থবছরে দিতে পারবে না। আস্তে আস্তে দেবে। এভাবে চলতে থাকলে বিশ বছরেও হবে না।
আমিও তেমন শুনেছি। তাই প্রকল্প বাতিল করে দিতে বলেছি। ওই টাকা দিয়ে একটা লেন্সও কেনা যাবে না। কিছুই করতে পারব না। বিশ্ববিদ্যালয় অন্য কাজে ব্যয় করে ফেলবে।
পারবে না, ওভাবে নির্দেশনা দেওয়া হবে।
“বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান।”, জামাল নজরুল ইসলাম বললেন, “এরা জলে ভাসমান রুই মাছকে মানুষের লাশ এবং লাশকে রুই মাছ বানিয়ে দিতে পারে। উপাচার্য ভবন যা ইচ্ছে তাই করে। ভৌত বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালকের অনুকূলে বরাদ্দ-করা গাড়িটা পর্যন্ত নিয়ে গেছে। আমি কী করতে পেরেছি? ”
ভৌত বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের জন্য একটা গাড়ি কেনা হয়েছিল। কেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে গাড়িটি মাসখানেক জামাল নজরুল ইসলামের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তারপর কী একটা কাজের অজুহাত দিয়ে উপচার্য সাহেবের দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। কথা ছিল, দুদিন পর ফেরত দেবে। দুই দিন করে করে অনেক বছর চলে গেল। গাড়িটা আর ফেরত আসেনি।
মান মন্দিরের জন্য মঞ্জুরি কমিশন থেকে কিছু নেওয়া যায় না?
 মঞ্জুরি কমিশন আমাকে এক লাখ ছয় হাজার টাকার টেলিফোন বিল দিতে পারেনি।  ওই এক কোটি টাকা এলে হরিলুট হয়ে যাবে। আমি যত টাকা চেয়েছি তার সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতি যুক্ত করে যত টাকা প্রয়োজন তা পেলে কাজ শুরু করব। এর কম হলে হবে না। জানিয়ে দিয়েছি।
আপনার কষ্ট লাগে না স্যার?
অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
আপনার দেশে আসা উচিত হয়নি। এটি দেশ নয়, দ্বেষ।
অনেকে বলেন— আসা উচিত হয়নি, কিন্তু কেন উচিত হয়নি?
দেশ আপনাকে কিছুই দিতে পারল না।
আমি দিতে এসেছি, নিতে আসিনি।
কোথায় দেবেন? উপযুক্ত পাত্র না হলে কি দেওয়া যায়? ধান্যপাত্রে কি মধু রাখা যায়? অপাত্রে কিছু দেওয়া অপরাধ। তাছাড়া দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাওয়াটাও অনিবার্য শর্ত হয়ে যায়। আপনি না পেলে দেবেন কীভাবে? নদীতে প্রবাহ থাকে তখনই, যখন পানি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আসার সুযোগও থাকে।
চেষ্টা করতে হবে।
প্রতিভা খুব স্পর্শকাতর বিষয়। উর্বর ক্ষেত্রও উষর হয়ে যায় যদি পর্যাপ্ত পরিচর্যা না পায়।
রচনা বলল, ভাব্বা এ কথাটা প্রায় সময় বলেন।
ভাব্বা কে?
বাবাকে আদর করে ভাব্বা ডাকি।
আমি বললাম, আপনি স্যার মান মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘ এক দশক দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। আপনার প্রতিভা কী মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে? প্রবহমানতা নদীর প্রাণ। জলধারাকে প্রবহমান রাখার জন্য যে স্রোত প্রয়োজন তা যদি না থাকে অনেক বড়ো নদীও মরে যায়।
জামাল স্যার বললেন,  তিন হাজার ছেলেকে বিজ্ঞানী বানাতে পারলে দেশের অবস্থা পালটে যাবে। আমি এটাই করতে এসেছিলাম।
“তিনশ জনও পারবেন না।”, রচনা বলল, “ত্রিশ হাজার ডক্টরেট ডিগ্রি দিতে পারবেন, কিন্তু তিন জন বিজ্ঞানীও বানাতে পারবেন না। বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা বিজ্ঞানী হওয়ার চেয়ে অভিনেতা হতে বেশি আগ্রহী। তারা উদ্যোক্ত হওয়ার চেয়ে উদ্যোক্তার গোলামি করাকে সম্মানজনক মনে করে। তারা চিকিৎসাশাস্ত্রের গবেষক হবে না, পাঁচশ টাকা ফি-নেওয়া চিকিৎসক হবে।”

“অভিনেতা হলেই তো সুবিধা।”, জামাল স্যার বললেন “সচিবালয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না। বাদ দাও এসব। যেমন লোক  তেমন দেশ— তেমন নেতা এবং তেমন নেতৃত্ব্। ছাগলের নেতা তো আর মানুষ হয় না। তোমার বিমান আর কতক্ষণ?
রচনা বলল, সময় আছে।
আমি যাই। ল্যাগেজগুলো নিয়ে আসি।
আপনি কোথা হতে আসছেন? আমি প্রশ্ন করলাম।
যুক্তরাজ্য।
টিকিটটা দিন। আমার লোক আছে। সে আপনার লাগেজগুলো নিয়ে আসবে। আমরা ততক্ষণ ভিআইপি রুমে গিয়ে বসি।
আমি কী ভিআইপি?
ভিআইপি অর্থ যদি ভেরি ইমপোটেন্ট পারসন হয়, তাহলে আপনি অবশ্যই ভিআইপি নন।
জামাল স্যার ম্লান হেসে বললেন, বাঙালিদের কেউ মূল্যায়ন করতে চায় না। করবেই বা কেন, তারা তো নিজেরাই  নিজেদের মূল্যায়ন করে না। এদের সাজাত্যবোধ নেই, বিজ্ঞানমনস্কতা নেই। আত্মপ্রেম এত বেশি যে, নিজের আত্মা থেকে বের হয়ে দেশের আত্মায় ঢুকতে পারে না। আমি এগুলো দেওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য এসেছিলাম। পারিনি।
রচনা বলল, মৌলিক বিজ্ঞানে অন্তত পাঁচ জন বাঙালির নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল। কেউ পায়নি। বাঙালি বিজ্ঞানীর তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করে অনেকে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, কিন্তু মূল বিজ্ঞানীকে বঞ্চিত করা হয়েছে। কারণ বাঙালিরা পরস্পরের বিরুদ্ধে লেগে থাকে।
আমি বললাম, অধিকার আদায় করে নেওয়ার সামর্থ্য থাকতে হয়।
আমার অফিস সহায়ক সোহরাব, জামাল স্যারের লাগেজ নিয়ে চলে এসেছেন। কথায় কথায় রচনার বিমানে ওঠার সময়ও প্রয়ে হয়ে আসছে।
স্যারকে বললাম,  একটু অপেক্ষা করলে একসঙ্গে যেতে পারব।
না, বরং তুমি তোমার লোকটিকে বলো, আমার জন্য একটা ট্যাক্সি ঠিক করে দিতে।
তাই করা হলো। জামাল স্যার চলে গেলেন। আরও কিছুক্ষণ পর রচনা আর প্রমিতাকে বিমানে তুলে দিলাম। আমার ভালোবাসা এখন বিমানে চড়ে উড়ছে।  দুপাশে তাকালাম। চারদিকে হাজার হাজার লোক। কিন্তু তারা কেউ সঙ্গী নয়।  কথা বলার কেউ নেই।  আমি একা হয়ে গেলাম। মনে পড়ে গেল ফ্রান্সিস বেকনকে: For a crowd is not company; and faces are but a gallery of pictures; and talk but a tinkling cymbal, where there is no love.