Warning: Constant DISALLOW_FILE_MODS already defined in /home/draminb1/public_html/wp-config.php on line 102

Warning: Constant DISALLOW_FILE_EDIT already defined in /home/draminb1/public_html/wp-config.php on line 103
সন্মিত্রা : এক মলাটে সন্মিত্রা: সন্মিত্রা সম্পূর্ণ উপন্যাস : প্রথম থেকে শেষ পর্ব – Page 47 – Dr. Mohammed Amin

সন্মিত্রা : এক মলাটে সন্মিত্রা: সন্মিত্রা সম্পূর্ণ উপন্যাস : প্রথম থেকে শেষ পর্ব

সন্মিত্রা: সপ্তচত্বারিংশ (৪৭) পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন

কল্পনাকে ঢাকা থেকে অক্সফোর্ডে রেখে আসার মাস ছয়েক পরের কথা। একা বসে আগামী দিনের কাজ নিয়ে ভাবছিলাম। এসময় আসে রচনার ফোন। গলায় কিছুটা উৎকণ্ঠা। অন্য কেউ হলো বুঝত না। আমি তার সামান্য বিঘ্নও বুঝতে পারি, কী হয়েছে? দ্বিগুণ উৎকণ্ঠায় জানতে চাইলাম।
কল্পনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
কল্পনা যত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় মন তত সৃজনশীল হয়। মানুষ কল্পনার মাধ্যমে বিজ্ঞানী হয়ে ওঠে। সব সৃষ্টি কল্পনায় কল্পনায় মনগড়া। পা দিয়ে কেউ কি কোনো কিছু গড়েছে?
এই কল্পনা সেই কল্পনা নয়। আমাদের কল্পনা, মানে কল্পু।
কী হয়েছে তার? স্বাভাবিক গলায় বললাম।
সে লন্ডন মেনে নিতে পারছে না। আসলে লন্ডন নয়, আপনার দূরত্ব। লন্ডনের জৌলুশে দিন দিন যেখানে বাংলাদেশের স্মৃতি ম্লান হয়ে যাওয়ার কথা সেখানে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার মনে বাংলাদেশ আরও জীবন্ত হয়ে উঠছে। ইনফ্যাক্ট, বাংলাদেশ নয়, আপনি। আপনার সঙ্গ পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে।
তোমার চেয়ে বেশি? প্রশ্ন করলাম।
জানি না, কিন্তু তার প্রকাশটা বেশ স্পষ্ট।
এদের কারও ভালোবাসার তুলনা হয় না। রচনার ভালোবাসা রাতের মেঘে-ঢাকা আকাশ। বৃষ্টি হয়ে ঝরার পূর্ব পর্যন্ত আন্দাজই করা যায় না। কল্পনার ভালোবাসা গর্জন। রাত হোক, দিন হোক তার প্রকাশ খুবই স্পষ্ট। মরাকেও জীবিত করে দিতে পারে। আল্পনার ভালোবাসাও মেঘের মতো। তবে এই মেঘ যতই প্রবল হোক, বৃষ্টি হয়ে ঝরে না, রংটাও চেনা যায় না। হিমালয়া রূপ নিয়ে জমে থাকে বুকে অ্যান্টার্কটিকার বরফের মতো।
কী করতে চায় সে?
আপনার সঙ্গে দেখা করবে, আপনার সঙ্গে থাকবে। এ নিয়ে সহিংসতা প্রকাশ করতেও দ্বিধা করছে না। আপনি তো জানেন, তার অভিমান জোয়ার পেলে কিছুই মানে না। ঢাকায় কী করত, মনে পড়ছে না স্যার? লন্ডনে ঢাকার চেয়ে বেশি করছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হিংস্র হয়ে উঠছে। বুঝতে পারছি না কী করব?
তাকে বোঝাও।
বুঝতে চাইছে না। মারাত্মক স্পর্শকাতর হয়ে গেছে। কারণে-অকারণে রেগে যাচ্ছে। জিনিসপত্র ভাঙচুর করছে। নিজের শরীরের ক্ষতি করার হুমকি দিচ্ছে। মুখ নাকি ঝলসে দেবে। দাবি একটাই বাংলাদেশ, বাংলাদেশে যাব, ভাব্বার সঙ্গে থাকব।
কল্পনাকে দাও।
রিসিভারে কল্পনা আসার পর বললাম, কল্পু সোনা, কী হয়েছে তোমার?
আমি বাংলাদেশে চলে যাব। লন্ডন আমার ভালো লাগছে না।
কেন?
এখানে আপনি নেই। মনে হচ্ছে কেউ নেই। সব অপরিচিত মুখ। অপরিচিত মুখ ছবির মতো। দেখা যায় কেবল।
আস্তে আস্তে পরিচিত হয়ে যাবে। মানুষের কাজ পরকে আপন করা। ছবির মুখে কথা দেওয়া।
ভাব্বা, আমি কী করব? আমাকে নিয়ে যান-না! আমার এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না। আমার নিয়ন্ত্রণ আমার বাইরে চলে যাচ্ছে। 
কেন ভালো লাগে না?
আপনি চলে আসুন অথবা আমাকে নিয়ে যান।
রচনার মতোই উত্তর। রচনার কাহিনির পুনরাবৃত্তি হলো। যেমন পুনরাবৃত্তি হয় ইতিহাসের। ইতিহাস মনুষ্য জীবনের স্মৃতিচারণ। রচনাও এভাবে বলত।
তুমি যা চাও তা তো নাও পেতে পার?
আমি এমন কিছু চাই না, যা মানুষ পেতে পারে না। ইচ্ছা যদি একাগ্রতাকে আগলে রাখে তাহলে মানুষ আকাশে ভবন বানাতে পারে। আপনি দেখবেন ভাব্বা, যা মানুষের পাওয়ার সাধ্যাতীত নয়, তা আমারও সাধ্যাতীত নয়।
কীভাবে?
যেভাবে মানুষ গুহা থেকে স্যাটেলাইটে। আমরা বস্তি থেকে অক্সফোর্ড। আপনি কখন আসবেন?
লন্ডন অনেক দূর।
চট্টগ্রাম যেতে যত সময় লাগে তার চেয়ে কম সময়ে লন্ডন আসা যায়।
কল্পনার কথা ঠিক। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে দশ-বারো ঘণ্টাও লেগে যায়। কিন্তু লন্ডন আরও কম সময়ে পৌঁছানো যায়। পথের দখলও কম। সমস্যা হচ্ছে চাকরি। বৈদেশিক ছুটি সহজে পাওয়া যায় না। নানা প্রশ্ন করে।
কখন আসবেন ভাব্বা?
খুব তাড়াতাড়ি। তুমি রচনাকে রিসিভারটা দাও।
রিসিভার নিয়ে রচনা বলেছিল, বাংলাদেশে না নিয়ে গেলে সে হয়তো আত্মহত্যাই করে ফেলবে।
রচনার কথায়, আমার মনে পড়ে গেল হিথরোর কথা। কী অবলীলায় নিজের কবজির রগ কেটে ফেলেছিল মেয়েটি। আমি সাবধান হওয়ার তাগিদ অনুভব করলাম। হঠাৎ ভারী কিছু পতনের শব্দ এলো।
কী হয়েছে? চমকে উঠে প্রশ্ন করলাম।
রচনা খুব স্বাভাবিক গলায় হাসি দিয়ে বলল, আছাড় দিয়ে বড়ো ফুলদানিটা ভেঙে ফেলেছে । ওটি দেখলে নাকি শুধু আপনার কথা মনে পড়ে। আর তাকে না কি উপহাস করে।
মনটা খারাপ হয়ে গেল আমার, কিন্তু রচনা হাসছে।
তুমি হাসছ? দুটি চড় দাও।
ভালো হয়ে যাবে একদিন। আপনার আশীর্বাদ আছে না, স্যার।
আমি রচনার দৃঢ়তা আর ধৈর্য দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। সমস্যাকে  পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে অবাঞ্ছিত ঘটনার রোধ করার ক্ষমতা তার অসীম। ইস, আমি যদি তার মতো হতে পারতাম! সম্ভব নয়। সবার পক্ষে সবকিছু হওয়া সম্ভব হয় না। তাহলে পৃথিবীর সব নদীই মহাসাগর হয়ে যেত। তখন কী হতো পৃথিবীর? শিউরে উঠি আমি। কল্পনাকে থামাতে হবে।
সপ্তাহখানেক আর কোনো সমস্যা হলো না। একদিন রাত তিনটায় ফোন করে রচনা। এত রাতে সে কখনো ফোন করেনি। আমি শঙ্কায় শিউরে উঠি। নিশ্চয় অমঙ্গলের কিছু। শঙ্কাকে শঙ্কার মাঝে চেপে রেখে বললাম, এত রাতে?
কল্পনা নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ওষুধও নিচ্ছে না। শুধু ভাব্বা ভাব্বা করে কাঁদছে। চোখ-মুখ ফুলে গেছে। অনেক জ্বর। আমাদের কাউকে মনে হয় ভালোভাবে চিনতেও পারছে না। কলেজেও যাচ্ছে না।
এমন হলো কেন?
সে বাংলাদেশে যেতে চায়। খুব তাড়াতাড়ি নিয়ে যেতে হবে। নইলে এমন কাজ করে বসবে, যাতে আমরা কষ্ট পাব।
রচনার কথার ভঙ্গিমায় আমি শঙ্কিত হয়ে পড়ি। সে অনেক কষ্টেও এমন কণ্ঠে বলে না। অবস্থা নিশ্চয় গুরুতর। নিশ্চয় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
আপনি নাকি বলেছেন, বাংলাদেশে নিয়ে যাবেন।
বলেছি।
নিয়ে যান।
রাখব কোথায়? অল্প দিনের জন্য হলে সমস্যা ছিল না। সে এলে কখন যাবে ঠিক নেই। আমি বিবাহিত। তার ওপর ঋধিতা তাকে একদম সহ্য করতে পারে না। সে ঢাকায় এসেছে শুনলে, বলবে আমি নিয়ে এসেছি। দুর্বিষহ হয়ে উঠবে জীবন। দাম্পত্য জীবন এমন পরাধীন যে, মনের গতিকেও শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়। হাসিকেও হাঁচিতে নিয়ে যেতে হয়।
স্যার, আমি জানি আপনি ভালো কিছু করতে পারবেন। তবে বুঝতে পারছি না কীভাবে করবেন। পরামর্শ দেওয়ার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। এমন অস্থিরতা জীবনে আমার এই প্রথম।
দেখো সোনা, কল্পনাকে বাংলাদেশে রাখা সম্ভব নয়। আমি কোথায় রাখব তাকে? এখানে এসে সে করবেটাই বা কী!
জানি না, রচনা অসহায়ের মতো বলল।
সব কি আমি জানি? আমার গলায় অভিমান না রাগ আমি নিজেই বুঝতে পারলাম। তবে এটি বুঝতে পারলাম, এমনভাবে বলা উচিত হয়নি। অবাক হয়ে দেখলাম, রচনা আমার এমন থূর্ত কথাতে কিছু মনে করেনি।
স্বাভাবিক গলায় আবার বলল, জানি না।
কী জানো?
আবার আমার গলায় বিরক্তি।
এটুক জানি বাংলাদেশে না নিলে সে বাঁচবে না। আপনি বলেছিলেন, এই মাসে তাকে বাংলাদেশে নিয়ে যাবেন। কয় তারিখ এবং কখন বলেছিলেন, তাও ডায়ারিতে লিখে রেখেছে। কয় শব্দে বলেছেন তাও ডায়ারিতে অবিকল।
কল্পনাকে দাও।
কল্পনা রিসিভার মুখে দিয়ে শুধু ভাব্বা শব্দটাই উচ্চারণ করতে পারল। তারপর বাংলাদেশি বালিকার মতো অক্সফোর্ডের টিচার্স কোয়ার্টারের অভিজাত বাংলোয় ডুকরে কেঁদে দিল। এমন জোরে কাঁদছে, আমার রিসিভার যেন বজ্র হয়ে গেল। কানের পর্দায় প্রবল গর্জন। বাংলাদেশের আকাশে নয়, অক্সফোর্ডের মাটি থেকে আসছে। আমিও না কেঁদে পারলাম না। কল্পনার মতো হু হু করে কেঁদে দিলাম। আমার কান্না পেয়ে কল্পনা স্তব্ধ হয়ে গেল। বুঝতে পারল, সে খুব বড়ো ভুল করেছে। ভাব্বাকে কাঁদিয়েছে। মানুষ তখনই কাঁদে, যখন কষ্ট পায়।
কান্না থামিয়ে বলল, ভাব্বা, আই’ম সরি। কিন্তু আমি বাংলাদেশ যাব। কাঁদব না। কোনো দুষ্টামি করব না। যা বলবেন, তাই করব। যত ঘণ্টা বলেন তত ঘণ্টা পড়ব। যেখানে যেমনভাবে থাকতে বলেন সেভাবে থাকব। আমাকে নিয়ে যাবেন তো?
নিয়ে যাব।
আপুকে বলেন আমাকে বিমানে তুলে দিতে। আপনি ঢাকা বিমানবন্দর থেকে আমাকে নিয়ে যাবেন আপনার বাসায়।
আমি চাই না, তুমি একা একা এত লম্বা পথ পাড়ি দাও। আমি নিজেই তোমাকে নিতে আসব। ততদিন পর্যন্ত ভালো হয়ে থাকতে হবে।
কখন আসবেন?
খুব তাড়াতাড়ি।
আমার কান্না আরও গাঢ় হয়ে এল। রিসিভার রেখে  আবার কেঁদে দিলাম। ভাগ্যিস রুমে কেউ নেই। রাতে আমার স্টাডি রুমে আমি আর আমার বই ছাড়া কেউ থাকে না। আমার বই আমার বউয়ের সতিন। আমি আমার বউয়ের সতিনদের মাঝে মাথা গুঁজে দিলাম বেদনায়।