সন্মিত্রা: অষ্টচত্বারিংশ (৪৮) পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
চিন্তায় পড়ে গেলাম ভীষণ। সমস্যাটা রচনা যত সহজে দেখছে, আসলে তত সহজ নয়। আমার জন্য অনেক জটিল। বাংলাদেশ লন্ডন নয়। বাঙালিরা অন্যের ভালোটা দেখতে অভ্যস্ত নয়। অধিকন্তু, আমি বিবাহিত। তিল পেলে তাল বানিয়ে ফুটবল খেলবে আমাকে নিয়ে। বাঙালি বলে আমি বাঙালিকে ভয় না-করে পারি না। ভয় থেকে এসেছে ঘৃণা।
বাঙালি নামটা আমি লিখি, বারবার লিখি;
লিখে ঢেকে দিই ঘৃণার থুথু দিয়ে
ছি!
সাইদুর স্যারের কাছে গেলাম। শরীরটা তাঁর আরো ভেঙে গেছে। আমার মতো তারও পৃথিবীর মেয়াদ কমে আসছে। অনেকদিন পর কেন গেলাম, এতদিন কেন যাইনি, ঘাট পার হলে মাঝি পাজি হয়ে যায়, বাঙালিদের কৃতজ্ঞতাবোধ নেই ইত্যাদি-ভরা নানা অম্লমধুর গালিতে আমাকে ভীষণ স্নেহাদরে ভূষিত অভিযোগে অভিষিক্ত করে বলেছিলেন, “আমিও এমন গালি খেয়েছি। আমার দোষটা তোমার ওপর দিয়ে ক্ষালন করার চেষ্টা করলাম। আসলে বাঙালি বাঙালিই। এজন্য রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী
রেখেছ বাঙাল করে মানুষ করোনি।”
আমি হাসলাম। সাইদুর স্যার একটু থেমে ভেতরের ঘরের দরজার গোড়ায় গিয়ে ডাক দিলেন, তোমরা দেখে যাও কে এসেছে। নাশতা নিয়ে এসো। ছোলা আর পিঁয়াজু, সঙ্গে গোটা আষ্টেক কাঁচামরিচ।
কে এসেছে, চাচির আদুরে গলায় জানতে চেয়েছিলেন।
তোমার চাঁটগাইয়া ছেলে। শুঁটকি খাইয়ে যে তোমার দিলের পিলে চমকে দিয়েছিল। মনে পড়ে না, খাওয়ার সময় তো ঠিক মনে ছিল।
বাঙালির স্বভাব, যায় না কখনো অভাব।
যতক্ষণ দিতে পারে, ততক্ষণ মমতা পাড়ে
তারপর নীরবতা অকৃতজ্ঞ চুপচাপ।
আমি লজ্জায় মোহিত হয়ে গেলাম। কী ভালো লোক, কত উদার, কত অমায়িক আর প্রগলভ সয়লাব। অথচ এতদিন একবারও আসিনি। আনন্দে চোখ দুটো মেঝে ছড়িয়ে গেল লজ্জায়। বলতে পারছিলাম না কিছু। এমন আন্তরিকতা আর নিবিড় উদরতা দেখে কার ভাষাই বা থাকে!
ক্ষমার্হ মমতায় আদর ঢেলে সাইদুর স্যার বলেছিলেন, আমি কিছু মনে করি না, কিন্তু মন তো অনেক কিছু করে বসে। মনের ওপর কেউ জোর খাটাতে পারে না। তাই মানুষের প্রতি মানুষের অভিযোগ নিরন্তর লেগেই থাকে। ভালো থাকার চেষ্টা ছাড়া আর কী আমরা করি? এটাই জীবন, প্রার্থনাও ওই একটা। তবে তোমার মেয়ে রচনা বহুবার রিং করেছে। আমার জন্য হাভানা চুরুট পাঠিয়েছে। ফিদেল ক্যাস্ট্রো ওগুলোই খায়। সে নিশ্চয় ভালো আছ।
জি।
এবার বলো, কী জন্য এসেছ?
আমি কল্পনার কথা সবিস্তার বললাম।
শুনে সাইদুর স্যার বললেন, এখন বাংলাদেশে এলে সে কখন যায় ঠিক নেই। বছর হতে পারে কিংবা তারও বেশি, নয়তো বা কখনো না। এই মেয়ে সব করতে পারে। আমাদের বাসায় রাখতে পার। কিন্তু তা মোটেও উচিত হবে না। যা ব্যক্তিত্ব তোমার মেয়ের। সেও থাকবে বলে মনে হয় না। হয় নতুন বাসা নিতে হবে নতুবা তোমার বাসায় রাখতে হবে।
নতুন বাসা নিলেও আমাকে তার সঙ্গে থাকতে হবে। ঋধিতার সঙ্গে রাখা সম্ভব নয়। কল্পনার মতো সপ্তদশী যদি আমাকে গলা জড়িয়ে ধরে চুমো খেয়ে বলে—ভাব্বা, অনেক রাত হয়েছ। এসো ঘুমিয়ে পড়ি। স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাবে। আমাকে কিন্তু এক সেকেন্ডের জন্যও ছাড়তে পারবেন না। জড়িয়ে ধরে রাখতে হবে সারা রাত। কী হবে!
ভাবতেই শরীর শিউরে উঠে। অতএব, সাইদুর স্যারের দুই প্রস্তাবের কোনোটি রাখা সম্ভব নয়, কোনোভাবে। তবে, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। প্রত্যেক সমস্যার সমাধান আছে। ভাবতে হবে আরও।
বললাম, বাংলাদেশে না এনে সমাধান করা যায় না?
না। তাকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি।
সাইদুর স্যার ও তার পরিবারের উপস্থিত সদস্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ি চড়লাম। ড্রাইভারকে বললাম গেন্ডারিয়া।
গেন্ডারিয়ায় হায়াৎ মামুদের বাসা। তিনি বয়সে আমার চেয়ে প্রবীণ, কিন্তু মননে দুজন কাছাকাছি। তাই আমরা বন্ধু। গেন্ডারিয়া এক সময়ের অভিজাত এলাকা ছিল। অনেকে বলেন, এখানে খুব আঁখ হতো। আখের স্থানীয় নাম ছিল গেন্ডারিয়া, এজন্য স্থানটির নাম গেন্ডারিয়া। আসলেই তা নয়। ব্রিটিশ অফিসারদের বসবাসারে জন্য এলাকাটি অধিগ্রহণ করে নাম দেওয়া হয়েছিল গ্র্যান্ড এরিয়া। তা থেকে গেন্ডারিয়া।
যেতে যেতে আর্মানিটোলা।
আর্মানিটোলা দেখে আমার হঠাৎ আমের্নিয়ার কথা মনে পড়ে গেল। আর্মেনিয়া ইউরোপীয় রাষ্ট্র। জর্জিয়া ও আজারবাইজানের সঙ্গে দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে কৃষ্ণসাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের স্থলযোজকের ওপর এর অবস্থান। নব্বই ভাগ লোক হায় জাতির। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে দেশটি সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়। আবার ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে আর্মেনিয়ার প্রথম সোভিয়েত-পরবর্তী সংবিধান পাশ হয়। বেশ ঐতিহ্যমণ্ডিত দেশ।
আর্মেনিয়ার প্রায় পঁচানব্বই ভাগ অধিবাসী খ্রিষ্টান এবং আর্মেনীয় অ্যাপলস গির্জার অনুসারী। যিশুর দুই শিষ্য বার্থেলেমিউ ও থাদেউস প্রথম শতকেই এখানে খ্রিষ্টধর্ম প্রচার করেছিলেন। তৃতীয় শতকে আর্মেনিয়ার রাজা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। স্বল্পসংখ্যক ইহুদি, ইয়াজিদি ও মুসলিম আছে। পৃথিবীর সব দেশের মতো এই দেশেও মুসলমানদের প্রভাব এবং সম্মান খুব কম। সবদেশে মুসলমানদের অন্য ধর্মাবলম্বীরা হেয় চোখে দেখে।
আর্মানিটোলা পার হওয়ার আগে মনে পড়ে গেল আর একটি নাম— বাংলাদেশে। এই বাংলাদেশ এশিয়ার বাংলাদেশ নয়। আর্মেনিয়ার বাংলাদেশ। এটি স্বাধীন বাংলাদেশে নয়। আর্মেনিয়ার একটা জেলা। কাগজে-কলমে নাম মালাতিয়া সেবাস্তিয়া। কিন্তু সাধারণ জনগণের কাছে জেলাটির নাম বাংলাদেশ। কথাটি মনে পড়তেই একটি সমাধান খুঁজে পাই।
কল্পনাকে বাংলাদেশেই নিয়ে যাব। তবে উপমহাদেশের বাংলাদেশ নয়, ইউরোপের বাংলাদেশ। উভয়ের ইচ্ছা পূরণ হবে। কল্পনার বাংলদেশ যাওয়া আর আমার তাকে বাংলাদেশ না আনা— দুটোই পূরণ হবে।
সাত দিন পর হিথরো।
কল্পনা আমাকে দেখে এমনভাবে জড়িয়ে ধরল— রচনা কাছে আসার সুযোগই পেল না।
খুশিতে রচনা বোবা।
কল্পনা মুখর।
টুটুলের হাসি বর্ণিল সলজতায় আমার আগমনের আনন্দ ঝরে ঝরে পড়ছে শিউলির মতো সাদা-সোদা শ্রদ্ধায়।
আল্পনা আসেনি। সে বাসায় আমার আগমন উপলক্ষ্যে গৃহসজ্জা কেমন হবে তা নিয়ে ব্যস্ত। হিথরো থেকে রচনার পাউন্ডে কেনা আমার নামে উৎসর্গকৃত গাড়ি চড়ে সোজা অক্সফোর্ড। গাড়ির আওয়াজ শুনে কাজ রেখে বের হয়ে এল কল্পনা।
তার হাসি আর বুলেটে বেগে এসে আমার জড়িয়ে ধরা দেখে নির্বাক হয়ে গেলাম। বরফ থাকলে প্রকৃতির সঙ্গে মিলে যেত সব। এই মাসে লন্ডনে বরফ জমে না। তাই বরফ হওয়ার জমে থাকার পরিবর্তে ভেসে ভেসে ছেয়ে দিল অক্সফোর্ডের আকাশ।
আমি চুমো খেলাম প্রতিমা মমতায়।