সন্মিত্রা: পঞ্চম পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
“আগে আজিজ সুপার মার্কেট যাব।” ঢাকায় নেমে স্বভাবসুলভ শ্রদ্ধা-প্রণতি আর শুভেচ্ছাদি বিনিময়ের পর রচনা আবদারের ঢঙে বলল। বাংলাদেশি পাসপোর্ট সমর্পণ করার পর এই প্রথম বাংলাদেশ এল বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী রচনা, ইউকে-এর পাসপোর্টে বাংলাদেশের ভিসা লাগিয়ে।
যাবে, আমি তার আবদারের জবাবে বললাম।
রচনা তার বাহু দিয়ে আমার বাহু আঁকড়ে কাঁচি বানিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বিমানবন্দরের বাইরে এসে চারদিক তাকিয়ে বলল, “দেশটা পাঁচ বছরের মধ্যে বস্তির হাভাতে মহিলার মতো যেন পঞ্চাশ বছর বুড়িয়ে গেছে। খুব পাশুটে মনে হচ্ছে।”
মেয়ে, ভালো দেখতে দেখতে চোখ তোমার উচ্চদর্শী হয়ে গেছে। পাঁচ তারকা হোটেলের খাদকদের জিহ্বায় তিন তারকার হোটেলের খাদ্যও নিম্ন মানের। আমাদের জিহ্বায় চাঁদ-তারা আর গোষ্পদ সব একাকার। তবে এটি ঠিক যে, তুলনামূলক বিচারে বাংলাদেশ দিন দিন বুড়িয়ে যাচ্ছে মানে পিছিয়ে যাচ্ছে।
আমার জন্মভূমি বুড়িয়ে যাচ্ছে, অথচ পৃথবীর প্রতিটি দেশ সজীব হচ্ছে। তবু নিজের জন্মভূমির মাটিতে পা পড়ামাত্র শরীরটা শিউরে উঠেছে। মনে হলো― মায়ের কোল। যদিও আমি এখন আর বাংলাদেশের নাগরিক নই।
জনগণই দেশের নির্মাতা।
তাই বাংলাদেশের জনগণের মতোই দেশটি দিন দিন নিকৃষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
প্রথমে কথা ছিল, সে অক্সফোর্ড থেকে এবং আমি ঢাকা থেকে সোজা কলকাতা যাব। তার অভিমত, কলকাতা যাওয়ার আগে নিজের জন্মভূমিতে যাওয়া উচিত। তাই পূর্বের সিদ্ধান্ত কিছুটা পরিবর্তন করে বাংলাদেশ চলে এসেছে। সে দুদিন ঢাকা থাকলে আমার দেশ আমার কাছে দুদিনের জন্য বিশ্ব হয়ে উঠবে। কারো কারো উপস্থিতি প্রচণ্ড খরাতেও বাসন্তিক মুগ্ধতা বিলিয়ে দিতে পারে। রচনা আমার সন্মিত্রা। তার মতো অকপট বন্ধু কে আছে আমার?
ঋধিতা?
নিজেকে প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর দিই মনে মনে, সে তো স্ত্রী। “স্ত্রী যদি বন্ধু হয় সংসার হয়ে যায় রেলওয়ে জংশন কিংবা ক্লাবঘর।” আমার কথা নয় ঋধিতার কথা― “স্ত্রী হবে স্ত্রী এবং স্বামী হবে তার মালিকানাধীন সংসার নামের খেত কর্ষণের জন্য রাতদিন বিরামহীন ধেয়ে চলা হালের বলদ।”
আসলে, সংসারে স্বামী-স্ত্রী দুজনের একজন নিত্য শোষক আর একজন নিত্য শোষিত। যেটাই ঘটুক, প্রকৃতপক্ষে দুজনের প্রত্যেকে নিজেকে বঞ্চিত ও শোষিত মনে করে। একজন মনে করে― শোষিত হচ্ছি আর একজন মনে করে শোষণ করে সুবিধা করতে পারছি না। এটি দাম্পত্য জীবনের সবচেয়ে কঠিন, কিন্তু অনিবার্য বিষয়। বিমানবন্দর পেরিয়ে মহাসড়কে উঠার আগে পুলিশ আমাদের গাড়ি আটকে দিল। ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড আছে গাড়িতে। আটকানোর কথা নয়। নিশ্চয় ভয়াবহ কিছু।
জানালার কাচ নামিয়ে পুলিশকে বললাম, কী ব্যাপার?
বাইরে কিছু সন্ত্রাসী গাড়ি ভাঙচুর করছে। একটু অপেক্ষা করতে হবে।
সামনে তাকালাম। যারা গাড়ি ভাঙচুর করছে তাদের সংখ্যা আট-দশ জনের বেশি হবে না। গাড়িতে এবং রাস্তার পাশে শতশত লোক দাঁড়িয়ে-বসে কিংবা হেঁটে-হুঁটে তা মজা করে দেখছে। কেউ প্রতিবাদ করছে না, থামানোর জন্য এগিয়ে আসছে না। পুলিশ কেবল বাঁশি বাজিয়ে সন্ত্রাসীদের থামানোর চেষ্টা করছে।
কী অদ্ভুত দেশ!
আপন মনে অনুচ্চকণ্ঠে বললাম, কেবল বাঁশি বাজিয়ে যদি সন্ত্রাসী দমন করা যেত তাহলে বিশ্ব, অস্ত্র বানানোর জন্য ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় না করে কয়েক লাখ ডলার খরচ করে বাঁশি বানিয়ে আর্মি-পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিত।
কিন্তু পুলিশ থেমে আছে কেন? রচনা প্রশ্ন করল।
পুলিশ থেমে আছে এটা পৌলিশিক সীমাবদ্ধতা। হয়তো, অমন নির্দেশ আছে। নতুবা, সংখ্যায় কম বলে ভয়ে যাচ্ছে না। নিজেদের সন্ত্রাসীদের চেয়ে দুর্বল মনে করছে।
কিন্তু হাজার হাজার মানুষ, যাদের অধিকাংশই যুবক; দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সন্ত্রাসীদের ভয়ে কাঁপছে। প্রত্যেকে একসঙ্গে ফুঁ দিলেই তো এই কয়েকজন সন্ত্রাসী খড়কুটোর মতো উড়ে যায়। এরা থেমে আছে কেন?
এটি জনান্তিক সীমাবদ্ধতা, আমি বললাম।
“ভাব্বা”, রচনা বলল, “সীমাবদ্ধতা, উন্নয়ন আর মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশের জন্য অত্যাবশ্যক একটি বিষয়। তবে যে মানুষগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কয়েকজন সন্ত্রাসীর অপকর্ম উপভোগ করছে, এটি সীমাবদ্ধতা নয়, নিষ্ক্রিয়তা। এমন নিষ্ক্রিয় জাতি কখনো উন্নত হতে পারে না।”
সরকার বলে― আমাদের দেশ আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে।
কিন্তু ভাব্বা, উন্নতি এমন একটি ধারণা যা সর্বদা আপেক্ষিকতার নিরিখে বিচার্য। আমি যেখানে ছিলাম সেখান থেকে একশ গজ এগিয়েছি, কিন্তু আমার দুশ গজ আগে বা একশ গজ পেছনে যে ছিল, সে এখন দুহাজার গজ এগিয়ে― উন্নতিটা হলো কীভাবে? অগ্রজনকে ধরার সম্ভাবনা আরও সংকুচিত হয়ে গেল, অ্যাকচুয়ালি আমি তো আগের চেয়ে পিছিয়ে গেলাম।
এমন ভাবলে আমরা দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছি।
এ যে ছেলেগুলো এমন নির্বিচার গাড়ি ভাঙচুর করছে, যদি পারত বিমানবন্দরটাই দখল করে নিত, কিন্তু পারছে না। এটা এদের নিষ্ক্রিয়তা নয়, সীমাবদ্ধতা। তাই সীমাবদ্ধতা কখনো কখনো মানবিক উৎকর্ষের গভীর নিয়ামক।
বুঝিয়ে বলো, আমি তোমার মতো ক্রাইস্ট চার্চ কলেজের অধ্যাপক নই।
আমার প্রচুর সম্পদ আছে। ভোগ করার ইচ্ছে এবং আর্থিক সামর্থ্য দুটোই অফুরন্ত, কিন্তু পারছি না। আমার ইচ্ছে, শারীরিক সামর্থ্যকে অতিক্রম করতে দিচ্ছে না। সামর্থ্য এবং ইচ্ছে থাকার পরও ভোগের যে সীমাবদ্ধতা আমার লাগাম টেনে ধরে― সেটাই মানুষের পাশব উগ্রতার প্রতিবন্ধক। এটি না থাকলে মনুষ্য জাতি বহু আগে ধ্বংস হয়ে যেত। প্রত্যেকটা মানব হয়ে যেত ভয়ংকর এক একটা পৌরাণিক দানব। এত সীমাবদ্ধতার মাঝেও যে মানুষের এত অহংবোধ, সীমাবদ্ধতা না থাকলে কী হতো!
পুলিশ হাত নাড়ল।
ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিল। মহাসড়ক প্রায় ফাঁকা। কোনো বাস নেই। থাকার কথা নয়। দুদিন যাবৎ পরিবহণ ধর্মঘট চলছে।
ভাব্বা, ঢাকার রাস্তা এত ফাঁকা কেন?
পরিবহণ ধর্মঘট চলছে।
কোথায় যাব, স্যার? ড্রাইভারের প্রশ্ন।
শাহবাগ, আজিজ সুপার মার্কেট, রচনা বলল।
কিন্তু আজিজ সুপার মার্কেট কেন? রচনাকে বললাম।
বই দেখব, বই কিনব। বাংলা বইয়ের বিশাল জগৎ থেকে অনেক দিন অনেক দূরে। আজ সাধ মিটিয়ে নেব ইচ্ছেমতো।
আগের আজিজ সুপার মার্কেট আর নেই। ওখানে বই পাবে না, কাপড় পেতে পার। কাপড়, বইকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
কী হয়েছে? সাঈদ ভাইয়ের সেই বড়ো বুকস্টলটা আছে না?
নেই।
কোথায়?
তিনি বইয়ের ব্যাবসা ছেড়ে গার্মেন্টস ব্যবসায় নিয়োজিত হয়েছেন। শুনে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। কষ্টকর কথা দিয়ে প্রতিবাদ করেছিলাম। ভেবেছিলাম মাইন্ড করবেন, করেননি। এখনো দেখা হলে উপহাস করি। তিনি প্রতিবাদ করেন না― কেবল হাসেন। হেসে হেসে বলেন―, শামীম ভাই, আজিজ সুপার মার্কেটে আশি ভাগই ছিল বইয়ের দোকান। এখন দশ ভাগও নেই। আগের নব্বই ভাগ বইয়ের দোকানে এখন কাপড় বিক্রি হয়। আগামী কয়েক বছরে চার-পাঁচটির বেশি বুকস্টল আজিজ সুপার মার্কেটে পাবেন না।
কিন্তু ফেসবুকে বইয়ের স্ট্যাটাসে দেখি, লাইকের ছড়াছড়ি?
লাইক দিতে টাকা লাগে না, বই কিনতে লাগে।
তাই তো! রচনার স্বগোতক্তি।
সাঈদ ভাইকে বলেছিলাম, কেন বইয়ের দোকানটা ছেড়ে দিলেন? তিনি কী বলেছিলেন জানো?
কী বলেছিলেন?
সাধে কী আর ছেড়েছি! বিস্বাদে বিস্বাদে ত্যক্ত হয়ে ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। বইসম্পর্কিত স্ট্যাটাসে বন্ধুদের যত লাইক পড়ে, বইয়ের স্ট্যাটাস যত বন্ধু পড়ে, বইয়ের দোকানে যত বন্ধু আড্ডা দিতে আসে― তার এক ভাগ বন্ধুও যদি বই কিনত তাহলে বাংলাদেশের অধিকাংশ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী তৈরি-পোশাকের দোকান ছেড়ে বইয়ের দোকান দিত। আমি শিউরে উঠে বলেছিলাম, থাক, যা হচ্ছে ভালোই হচ্ছে। নইলে দেশে থাকা দায় হয়ে যেত।
কেন? রচনা জানতে চাইল।
গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা বইয়ের ব্যবসায় নেমে পড়লে বাংলাদেশের এত মানুষ কাপড় পেত কোত্থেকে? বই না পড়ে থাকা যায়, কিন্তু কাপড় না পরে থাকা যায় না। জ্ঞানোলঙ্গতা মনের বিষয়, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ জ্ঞানোলঙ্গ। তাই পরস্পরকে মেনে নেয়।জ্ঞানোলঙ্গতা বাইরের চোখে দেখা যায় না। কিন্ত বস্ত্রোলঙ্গতা দেখা যায়।
কথায় কথায় চলে এলাম শাহবাগ। ফাঁকা রাস্তায় থামতে হলো না কোথাও। ড্রাইভার গাড়ি থামাল আজিজ সুপার মার্কেটের সামনে।
মার্কেটে ঢুকে রচনা অস্ফুট গলায় বলল, এ কী!
কী?
সব তো কাপড়ের দোকান; ভাব্বা, বইয়ের দোকানগুলো কোথায়?
পড়ার চেয়ে পরা অনেক বেশি জরুরি। আগে পরা তারপর পড়া। সভ্যতার প্রথম নিদর্শন কাপড়, বই নয়। সভ্যতার প্রথম চাহিদা কাপড়, বই নয়। ইকরা এসেছে পোশাকের অনেক সহস্র বছর পর। বই ছাড়া কলেজে যাওয়া যায়, কাপড় ছাড়া যায় না।