সন্মিত্রা: পঞ্চাশত্তম (৫০) পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
ঘণ্টাখানেক বাংলাদেশ ঘুরলাম।
ক্লান্তিতে কল্পনার শরীর ভেঙে আসছিল। বিমানের চেয়ে কষ্টকর ভ্রমণ আর হয় না। ট্যাক্সিতেই সে আমার শরীরে নুইয়ে পড়ছিল বারবার। এখন বিশ্রমা প্রয়োজন। উঠে পড়লাম গাড়িতে।
ড্রাইভারকে বললাম, গ্র্যান্ড হোটেল ইয়ারেভেন। রচনা লন্ডন থেকে বুকড করেছে। পেমেন্টও সে করবে। এটি পৃথিবীর কয়েকটি বিলাসবহুল হোটেলের একটি। আমার অত ব্যয়বহুল হোটেলে থাকার সামর্থ্য নেই। তিন দিন থাকলে পরবর্তী এক মাস স্রেফ না খেয়ে থাকতে হবে। এসব ক্ষেত্রে রচনাই আমার ভরসা।
গাড়ি আবার ইয়ারেভেনের দিকে ছুটল। বাংলাদেশ দেখে কল্পনা অনেকটা শান্ত। তবে ভিতরে ভিতরে অভিমানে ফুঁসছে। মুখ দেখলে বোঝা যায়। তাকে শান্ত করার ওষুধ আমার আছে। নতুন কিছু শিখতে পারলে সে খুশি হয়ে যায়। তার মধ্যে জানার ইচ্ছাটা প্রবল। আবার শুরু করলাম জানানো আর জানা।
বলেছিলাম, ইয়ারেভেন ১৯১৮ থেকে আর্মেনিয়ার রাজধানী। এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম কয়েকটি শহরের একটি। যিশুর জন্মের সাতশ বিরাশি বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত। রাজা প্রথম অরগিস্তি এটির পত্তন করেছেন।
ইয়ারেভেন নাম কেন? আমার কোলে মাথাটাকে দুটো চক্কর খাইয়ে কল্পনা জানতে চাইল।
আর্মেনিয়ান কিং চতুর্থ ইয়ারেভ্যান্ড সাহেবের নামানুসারে শরহটির নাম হয়েছে ইয়ারেভেন। তিনি অর্নটিড রাজবংশের শেষ রাজা ছিলেন।
এখানে নাকি মুসলিমরা অভিযান চালিয়েছিল?
ছয়শ আটান্ন খ্রিষ্টাব্দে।
নিশ্চয় উমাইয়া বংশের আমলে?
হ্যাঁ। তখন এর নাম রাখা হয় আমিরাত অব আর্মেনিয়া। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে সোভিয়েত লাল আর্মি এটি দখল করে নেয়। আসলে মুসলিমরা কোথাও বেশিদিন টিকতে পারে না। তারা প্রচণ্ড শক্তিতে দৌড় শুরু করে, কিন্তু কিছুদূর গিয়ে দম হারিয়ে ফেলে। পথের মাঝে পড়ে যায়। তখন দুকূলই হারিয়ে ফেলে। তাদের গভীরতা ও বিস্তৃতি দুটোই সংকীর্ণ এবং চিন্তারাশি পশ্চাৎপদতায় ভর্তি।
ভাব্বা, আমরা কী কী দেখব?
প্রথমে যাব মাছের বাজার – – -।
কল্পনা বলল, তারপর বইয়ের বাজার, তারপর হকার্স মার্কেট। কিন্তু তারপর? বলে কল্পনা হাসল।
সে জানে নতুন কোথাও গেলে আমি এই তিনটি দেখবই। এই তিনটি জায়গা দেখলে একটি দেশ সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যায়। অল্প কয়েকদিন কোনো দেশে অবস্থান করে ভালো ধারণা পাওয়ার আর কোনো কৌশল আমার জানা নেই।
বললাম, ইয়ারেভেন জাদুঘর দেখতেই হবে।
কল্পনা বলল, যিশুখ্রিষ্টের অনেক স্মৃতি রয়েছে এখানে। প্রথম চার্চটা তো দেখতেই হবে। তারপর ইয়ারেভেন জু। চিড়িয়াখানা না দেখলে মানুষ আর পশুর সম্পর্ক জানা যায় না। যে দেশের মানুষ আর পশুতে সম্পর্ক ভালো নেই, সে দেশ মানুষগুলো পশুকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে। আমাদের দেশের চিড়িয়াখানার পশুর শরীর দেখলে দেশের মানুষের দুস্যবৃত্তিক সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। সবগুলো পশু বাঙালির মতো হাড়কঙ্কাল।
হবে না! বাঙালিরা যে পশুর দুই-তৃতীয়াংশ খাবার খেয়ে ফেলে।
ভাব্বা, বাইবেলের আরারাত পাহাড় দেখার ইচ্ছা কিন্তু এটা তো অন্য দেশে। কীভাবে দেখব?
তুরস্ক যাব। বেশি দূরে নয়।
রিপাবলিক স্কোয়ার আন্ডার গ্রাউন্ড স্টেশন দেখব।
তুমি কীভাবে জানো?
রচনা আপু বলেছেন।
তোমার আপুর জন্য একটা হাতে তৈরি কার্পেট নিয়ে যাব।
খুব খুশি হবে। এটি আপুর প্রিয়। গার্নি টেম্পল এবং জার্নাটাস ক্যাথিড্রাল দেখার ইচ্ছে আছে। সবার শেষে যাব ব্লু মস্ক। উমাইয়াদের অনেক স্মৃতি ওখানে। আপু বলেছেন, খুব নীরস এখন।
আর্মেনিয়া বেশ অদ্ভুত দেশ। মোট বাসিন্দার অর্ধেকের বেশি বাস করে বিদেশে। অধিকাংশই যুক্তরাজ্য, রাশিয়া এবং ফ্রান্স।
পৌঁছে গেছি স্যার।
ড্রাইভারের কথায় সংবিৎ এলো দুজনের।
সামনে হোটেল, হোটেল নয় যেন মহারাজার প্রাসাদ। হাসান সাঈফ হোটেল লবিতে দাঁড়িয়ে। সে আমার বন্ধু। বিমানবন্দরেও যেতে চেয়েছিল। আমি নিষেধ করেছিলাম। আমাদের নামতে দেখে দৌড়ে আসে সে। দৌড়ে আসে হোটেলের লোকজন। রিসেপশন রুমে এক নজরকাড়া মহিলা মনকাড়া ভাষায় আমাদের স্বাগত জানালেন, ওয়েলকাম স্যার অ্যান্ড ম্যাডাম।
খিদে আর ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়ছিল। রুমে ওঠার আগেই খেয়ে নিলাম। তিনজনে একসঙ্গে। খাওয়ার পর বন্ধু হাসান সাইফকে বিদায় করে সোজা রুমে।
রুমে ঢোকার কয়েক মিনিট পর রিং করল রচনা, স্যার, মনে আছে?
কী?
আজ নববর্ষের প্রথম দিন।
আমি মোবাইলটা কান থেকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য নামিয়ে কল্পনাকে বললাম, শুভ নববর্ষ।
কল্পনা বলল, সরি, ভাব্বা। আপনি এলে আপনি ছাড়া আর কোনো কোনো কিছুই মনে থাকে না। আমাদের সব শুভ আপনাতে হারিয়ে যায়। শুভ নববর্ষ।
রচনা বলল, স্যার মেইলটা দেখুন।
খোলাই ছিল ল্যাপটপ।
বাটনে চাপ দিয়ে ই-মেইলে গেলাম। রচনা নববর্ষের শুভেচ্ছা দিয়েছে অপূর্ব ভাষায়, কবিতায় কবিতায়—
পান্তাভাতের পানি, তাতে পদ্মা নদীর ইলিশ
কাঁটাগুলো সরিয়ে দাও— হে নবদিনের আশিষ।
এটাই আমার প্রর্থনা গো লবণমাখা হাতে
প্রতিবছর এসো তুমি আলু ভর্তার সাথে।
ডালের বড়া, মাটির থালা হলেই চলে বেশ
এতেই হেসে গড়াগড়ি সোনার বাংলাদেশ।
আমার জামা খুলে ওয়ারড্রোবে রাখতে রাখতে কল্পনা বলল, ভাব্বা, আমাকে কেন এখানে নিয়ে এসেছেন?
এখানে বাংলাদেশ আছে। বাংলাদেশের বাইরে বাংলাদেশ, দেশের চেয়ে কম নয়। ইয়ারেভেনে পৃথিবীর বিশটি প্রাচীন রাজধানীর একটি।
আমি বাংলাদেশে যাব।
আগামীকাল আর্মেনিয়ান রুটি খাব। এই রুটি ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। মুখে দিলে মুখ তোমার বাংলাদেশের কথাই বলবে।
আমি বাংলাদেশ যাব।
তুমি বাংলাদেশে গেলে কয়দিন থাকতে?
যতদিন ইচ্ছে।
কোথায় থাকতে?
আপনার সঙ্গে।
আমার সঙ্গে তো আমার স্ত্রী থাকে।
আমিও থাকব। কাউকে বিরক্ত করব না।
তুমি বিরক্ত করবে না ঠিক আছে, কিন্তু অন্য কেউ যদি তোমাকে বিরক্ত করে? কিংবা তোমার উপস্থিতি বিরক্তকর মনে করে?
আমি না করলে অন্যে আমাকে বিরক্ত করবে কেন?
রাস্তায় হাঁটার সময় অনেকে তোমাকে বিরক্ত করত না?
করত। কিন্তু ম্যাম তো অমন নন।
তোমার ম্যাম যদি নিষেধ করে?
কেন করবে?
তোমার স্বামী যদি কোনো মেয়েকে তোমার বাড়ি নিয়ে আসে তুমি কী করবে?
দুজনে খুব মজা করব। খাব, গল্প করব। একত্রে ঘুমাব। আমার চোখের সামনে থাকবে। তারপর আপনার সেবা করব দুজনে। খুব মজা হবে না?
হবে।
তাহলে ম্যাম কেন করবে না।
বললাম, ঘুমাও।
ম্যামকে রিং করেন। এখন বাংলাদেশে দিন। আমি কথা বলব।
শরীর আমার কাঁপতে শুরু করে তার কথা শুনে। আমি আর্মেনিয়া এটি ঋধিতা জানে না। জানে আমি লন্ডন। যদি বুঝতে পারে কল্পনাকে নিয়ে আর্মেনিয়া আছি, তাহলে ভাগ্য আমার কী হয় জানি না, কপাল নির্ঘাৎ পুড়ে যাবে।
ঘুমাতে বলছি ঘুমাও।
ঘুম আসে না।
আমি কল্পনার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, চুপ করে শুয়ে থাকো। অনেক ধকল গেছে।
কল্পনা আমার হাত দুটি জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল।