সন্মিত্রা: একপঞ্চাশত্তম (৫১) পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
ইন্টারকমের শব্দে ঘুম ভাঙল। কল্পনার বাম হাতটা বুক থেকে আস্তে করে সরিয়ে দিয়ে রিসিভার কানে দিলাম। লেনভেল ভ্যালেসিয়ান এবং ব্যাবকেন হারুটিউনিয়ানের সঙ্গে হাসান সাইফও লবিতে অপেক্ষা করছেন। হাসান সাইফ আমার ব্যাচমেট। সে আর্মেনিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি। ‘লেনভেল ভ্যালেসিয়ান’ ইয়েরেভ্যান ‘স্টেট ইউনিভার্সিটি’ র আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক। ব্যাবকেন হারুটিউনিয়ান ইতিহাসের শিক্ষক। ভ্যালেসিয়ান সুসানার বন্ধু, হারুটিউনিয়ান রচনার। দুজনেই অক্সফোর্ডে লেখাপড়া করেছেন। অক্সফোর্ডে লেখাপড়া করার মজাই আলাদা। পুরো পৃথিবী শ্রেষ্ঠ সব বন্ধুতে ভরে যায়।
হোটেলে কেন? সকালের নাশতার টেবিলে হারুটিউনিয়ান প্রশ্নটি করে আমার দিকে তাকালেন, “আপনাদের জন্য আমাদের ইউনিভার্সিটি গেস্ট হাউজে বিশাল একটা রুম ঠিক করে রেখেছিলাম। এমনই তো কথা ছিল রচনার সঙ্গে।”
হারুটিউনিয়ান রিং করলেন রচনাকে। কয়েক মিনিট কথা বলার পর মোবাইল রেখে বললেন, রচনা আপনার হোটেলে থাকাকে প্রিফার করছে। তবে একটা কথা বলেছে। আমাদের গাড়ি ছাড়া অন্য গাড়িতে চড়া যাবে না।
তাই হবে, আমি বললাম।
ব্রেকফাস্ট শেষ করে কল্পনা রুমে চলে গেল। আমার রুমে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি গোসলবিমুখ মানুষ। রাতে ঘুমানোর আগে গোসল সেরে নিয়েছিলাম।
হারুটিউনিয়ান তার ব্যাগ থেকে আর্মেনিয়ান ওয়াইনের খুব সুন্দর একটা বোতল বের করে টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন, চলবে?
এখন না।
আর্মেনিয়ায় সত্তর ভাগ টুরিস্ট ওয়াইন খাওয়ার জন্য আসে। আর্মেনিয়া এলে আড়াই মাসের শিশুও দুধ পান করে না, ওয়াইন পান করে। পৃথিবীতে প্রথম এই দেশেই ওয়াইন তৈরি হয়। ঈশ্বর আর্মেনিয়া থেকে স্বর্গে ওয়াইন নিয়ে যান। আর্মেনিয়রা ওয়াইন তৈরি না করলে পৃথিবী এবং স্বর্গ দুটোই এমন মধুর জিনিস হতে বঞ্চিত থেকে যেত।
ভ্যালেসিয়ান ততক্ষণে আনকোরা বোতলটা খুলে ফেলেছে। গ্লাসে ঢালতে ঢালতে বললেন, চার্চিল কিন্তু স্টালিনকে মোটেও পছন্দ করতেন না।
সাঈফ বলল, কিন্তু তারা বন্ধু ছিলেন।
“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন নৃশংসভাবে জমে উঠছে।”, হারুটিউনিয়ান বললেন, “স্টালিন দেখলেন, এ সময় চার্চিলকে বড়ো প্রয়োজন। কীভাবে তাঁর কাছে যাওয়া যায়? বুদ্ধিতে স্টালিন চার্চিলের গুরু। তিনি কয়েক বোতল হুইস্কি পাঠিয়ে দিলেন চার্চিলের কাছে। মুখে দিয়েই চার্চিল স্টালিনের প্রেমে পড়ে গেলেন। ওই হুইস্কিই আপনার জন্য এনেছি। এক প্যাগ খেয়ে দেখুন। প্রেমে পড়ে যাবেন আমার দেশের। আর্মেনিয়ার হুইস্কি খেয়ে চার্চিল, তাঁর এককালের প্রতিপক্ষ ও শত্রু স্টালিনের এত ভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন যে, রাতে কেবল ফোনের পর ফোন করে বলতেন, পাঠান, পাঠান, পাঠান। ফোনের পর ফোন। বিরক্ত হয়ে স্টালিন চার্চিলের জন্য এক বগি আর্মেনিয় অ্যালকোহল পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তখন চার্চিলের বয়স ছিল সেভেন্টি ওয়ান। আর্মিনিয়ান হুইস্কি খাওয়ার পর তার শরীর সেভেন্টিনের মতো পরন্তপ হয়ে গিয়েছিল।
কথার মাঝে কল্পনা চলে এল। আমরা তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তাকে দেখে টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লাম। হারুটিউনিয়ান একটা মাইক্রোর দিকে আমাদের নিয়ে যেতে যেতে বললেন, এই আমার পারিবারিক গাড়ি।
“ নামটা কীভাবে বাংলাদেশ হয়ে গেল?”
কল্পনার প্রশ্নের উত্তরে ভ্যালেসিয়ান বলল, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে,…
বঙ্গভবনে, কল্পনা বলল।
ইয়েস, বঙ্গভবনে আমাদের দেশের এক ভদ্রলোকের নামে রাখা একটা ভবন আছে। ওখানে দুজন গভর্নরও বাস করেছেন। আজম খান এবং মোনায়েম খান। এখন সেখানে রাষ্ট্রীয় উপহার রাখা হয়। কী জানি বলে…
আমি বললাম, তোশাখানা।
জানেন, ওই ভবনটার নাম কী?
আমি বললাম, মানুক হাউজ।
হারুটিউনিয়ান বললেন, মানুক ছিলেন আর্মেনীয়। আপনাদের বঙ্গভবনে যদি আমাদের একজন ব্যক্তির নামে ভবন থাকে, তো আমরা কেন একটা জেলার নাম রাখতে পারব না। আমাদের চেয়ে আপনারা আরও মহৎ। বাংলাদেশে আর্মেনিয়া নামের অনেক স্থান আছে। গির্জাও আছে, শিক্ষালয়ও আছে। আপনাদের তুলনায় আর্মেনিয়ায় আপনাদের কিছুই নেই।
কল্পনা বলল, মানুক এত বড়ো ভবনের মালিক হলেন কীভাবে?
ভ্যালেসিয়ান বললেন, উনবিংশ শতকে ঢাকার অর্ধেক জমির মালিক ছিল আর্মেনিয়ান। ইংরেজরা বাংলার শাসন ক্ষমতা দখলের আগে ঢাকার ব্যবসার সত্তর ভাগ নিয়ন্ত্রণ করত তারা। বিশ ভাগ ফ্রেঞ্চ, পাঁচ ভাগ ইংরেজ।
নবাবরা কী করতেন? কল্পনা জানতে চাইল।
আমি বললাম, তারা আর্মেনীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ট্যাক্স, জমি আর নানা মহালের খাজনা আদায় করে ফুর্তি করতেন।
হারুটিউনিয়ন বলেন, ওয়াজেদ ছিল মানুকের পূর্বপুরুষ। তার কত টাকা ছিল জানেন? ওই টাকা দিয়ে সে নবাব আলীবর্দীকে বিরাশি বার কিনতে পারতেন। আমাদের আর্মেনীয় পূর্বপুরুষ পোগোজ, আরাতুন, পানিয়অতি, কোজা মাইকেল, মানুক, হার্নি এবং সার্কিস পরিবার ঢাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল। নবাবগণ তাদের কাছে ছিল নস্যি। তাদের কথায় চাকরের মতো উঠ-বস করতেন। আপনাদের বুলবুল ললিতকলা একাডেমি ভবন, আর্মেনীয় মানুক সাহেবের নাতির ভবন ছিল। তার মানে, আপনাদের সংস্কৃতি ভবন আমাদের সৃষ্টি।
হারুটিউনিয়ান বললেন, মানুক ধনী হিসেবে ছিলেন চার নম্বর, কিন্তু প্রভাবশালী হিসেবে এক নম্বর। তিনি সবসময় ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে থাকতেন। তবে বাগানবাড়ি বিক্রি করে অর্থের দিক দিয়েও সেরা হয়ে যান।
কল্পনা বলল, কীভাবে?
হারুটিউনিয়ান বললেন, বঙ্গভবনের অভ্যন্তরে অবস্থিত মানুক হাউজটি মানুক পরিবারের বাগানবাড়ি ছিল। আর্মেনীয় জমিদার মানুকের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়। ঢাকার নবাব খাজা আবদুল গনি মানুকের কাছ থেকে বাড়িটি কিনে এখানে একটি বাংলো তৈরি করেন। নাম দেওয়া হয় দেলখুশা বা দিলখুশা। দেলখোশা ভবন বানানোর পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে মানুক এর চারপাশের জমিগুলো কিনতে শুরু করে। বাগানবাড়ি বর্ধিত করার জন্য নবাবের মানুকের জমি অপরিহার্য হয়ে পড়ে। মানুক প্রচলিত দামের নব্বই গুণ বেশি দামে ওই জমি বিক্রি করেছিলেন। রাশিয়ান ‘অ্যারা আব্রামাইন’ ডায়মন্ড ডিলার মানুক হার্নির উত্তরপুরুষ।
তাই! কল্পনার গলায় বিস্ময়।
ভ্যালেসিয়ান বললেন, ইয়ারেভেন প্রদেশের বারোটি জেলার একটি হচ্ছে মালাতিয়া সেবাস্তিয়া। মালাতিয়া এবং সিভাস নামের দুই মেজরের নামানুসুরে জেলাটির নাম। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে ওয়েস্টার্ন আর্মেনিয়ান গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন ইয়ারেভেন শহরতলীর পশ্চিমে মালাতিয়া নামের জনপদটি গড়ে তোলে। এর দুই বছর পর গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া সেবাস্তিয়ার লোকেরা সেবাস্তিয়া জনপদ গঠন করে। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ভিক্টোরিয়া ব্রিজের মাধ্যমে দুটি জনপদকে এক করে নাম রাখা হয় মালাতিয়া সেবাস্তিয়া। এই জেলা শহরে মানুক, প্যাগোজ ও পানিয়াতির আদি নিবাস। তাদের কর্মচারী হয়ে হাজার হাজার আর্মেনিয়ান ঢাকা গিয়েছিল। তারা যেই গ্রামে বাস করত, সেটি বাংলাদেশ নামে পরিচিত ছিল। তাদের বংশবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এলাকাও প্রসারিত হয় এবং আরও বড়ো এলাকা বাংলাদেশ নামে পরিচিতি পায়।
কল্পনা বলল, অনেকে বলেন এটি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ নাম পেয়েছে।
হারুটিউনিয়ান বললেন, এটি ঠিক নয়।
মালাতিয়া সেবাস্তিয়ার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত হলি ট্রিনিটি সেন্টারের পাশে গাড়ি থামাল।
ভ্যালেসিয়ান বলল, কফি খাব।
এখানে কেন? আমি জানতে চাইলাম।
এখানে খুব ভালো কফি পাওয়া যায়।
কফিতে চুমুক দেওয়ার আগে, আমার মোবাইল ডেকে উঠল। রচনা।
আপনার কোথায় ?
ট্রিনিটি সেন্টারে।
নিশ্চয় সামনের কফি হাউজে।
কীভাবে বুঝলে?
আপনি কফি মুখে দিলে কেমন আওয়াজ করেন তা আমি জানি।