সন্মিত্রা: ত্রিপঞ্চাশত্তম (৫৩) পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
কলিংবেল শুনে দরজা খুলে দিল ঋধিতা। ঢুকতে গেলাম। দরজায় দুহাত প্রসারিত করে এমনভাবে দাঁড়াল যেন ঢুকতে না পারি। অবহেলাকে উপেক্ষা করে আদুরে গলায় বললাম, কেমন আছ?
প্রশ্নের উত্তর পেলাম না। মুখে প্রচণ্ড বিরক্তি। আড়ালে দেখলাম ঘৃণার তির। দুটোই আমার দিকে ছুটে আসছে। তাও উপেক্ষা করলাম খুব কষ্টে, কি গো কেমন আছ? কথায় আরো মিষ্টি ভাব।
চুপ সে।
রাগ করেছ?
তোমার শরীর থেকে দুর্গন্ধ আসছে।
কীসের?
পাপের। লন্ডন থেকে পাপ নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছ ঠিক আছে, কিন্তু আমার ঘরে অপবিত্র অবস্থায় ঢুকতে পারবে না। গোসল করে ঢোকো।
কোথায় গোসল করব?
নিচে। দারোয়ানদের বাথরুমে।
লুঙ্গিটা দাও।
আচ্ছা ঠিক আছে, ভেতরে ঢোকো, তবে কোনো জিনিসে হাত দেবে না। সোজা বাথরুমে চলে যাও।
অনেকদিন বিদেশে কাটিয়ে আসার পর যে সংবর্ধনা পাচ্ছি তাতে বেশি কথা বললে সংবর্ধনার ধরন আরও মারাত্মক হয়ে যেতে পারে। সোজা বাথরুমে ঢুকে ওখানেই কাপড়চোপড় বদলিয়ে নিলাম। লাগেজ গাড়িতে। ড্রাইভার আনবে। তাড়াতাড়ি অফিসে যেতে হবে। বাথরুম থেকে বের হওয়ার পর ঋধিতা বলল, কথা আছে।
বলো।
আমার দিকে তাকিয়ে ছেলেমেয়েদের ডাক দিল। দৌঁড়ে এল দুই ছেলে আর এক মেয়ে। সবাই তার ভক্ত। আমাকে দুপয়সা পাত্তা দেয় না। ওভাবে গড়ে তুলছে তাদের। এসব নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আমি বাসায় ঢোকার আগে জিহ্বা আর কানে নৈঃশব্দ্যের চাবি লাগিয়ে দিই। হা-হু ছাড়া পারতপক্ষে কারো সঙ্গে বেশি কিছু বলি না। বলতে গেলে তিন মিনিটের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটে যায়। ঋধিতার ধারণা পৃথিবীতে আমার মতো খারাপ পুরুষ আর নেই। মেয়ের ধারণা— আমার কোনো বেইল নেই। আমি একটা ওয়ার্থলেস।
কীজন্য ডাকছ? বড়ো ছেলে বলল।
তোমার বাবা আগে আর একটা বিয়ে করেছিল।
মায়ের কথা শুনে সে হাসল। তার সঙ্গে হাসল অন্যরাও। সন্তানরা বেশি কিছু বলে না। মা যা বলে শুনে যায় আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিনা প্রতিবাদে হা-হু করে। প্রতিবাদ করলে তাদের ওপর ঝড় বয়ে যায়। যা প্রতিকার করা যায় না, তাতে প্রতিবাদ করা মানে নিজের মাথা নিজে কেটে ফেলা।
হাসছ কেন? জানতে চাইল ঋধিতা।
তারা এবার আরও বেশি করে হাসল।
সত্যি বলছি বাবা। বিশ্বাস না করলে জিজ্ঞাসা করো।
আমি কিছু বলছি না, বলবও না। কয়েক বছর আগের কথা। বিয়ের দাওয়াত খেতে যাওয়ার সময় লিপস্টিকের রং, পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে যা হয়েছে তা ভোলা যায় না। ঋধিতা জানতে চেয়েছিল, রংটা কেমন হয়েছে? আমি বলেছিলাম ঠোঁটে স্কিন কালারই আমার পছন্দ।
ঋধিতা বলেছিল, নিশ্চয় তোমার আগের বউ ঠোঁটে স্কিন কালার লাগাত। যদি বাপের মেয়ে হই আমি আর কখনো ওই কালার ব্যবহার করব না। আমি জাস্ট আমার মতো দিয়েছি। তুমি নিষেধ করার কে? তোমার আগের বউয়ের সঙ্গেও কি তুমি লিপস্টিক নিয়ে এমন করতে? এজন্য বুঝি তাড়িয়ে দিয়েছ?
আজকের মতো ওই দিনও চুপ করে ছিলাম। বিয়ে খেয়ে এলাম দুজন। সারা পথ একটা কথাও হয়নি। তড়িঘড়ি বিছানায় শুয়ে পড়েছিল ঋধিতা। জার্নি একদম সহ্য করতে পারে না সে। মোলায়েম শরীর মাত্রই এমন। আমিও শুয়ে পড়েছিলাম।
কপালে হাত রেখে বলেছিলাম, বউ?
“বলো।” তুমি কি আসলেই বিশ্বাস কর, আমি তোমার আগে আর একটা বিয়ে করেছি? খিলখিল হাসিতে ডিম লাইটের আলোকে আরও মায়াময় করে দিয়ে ঋধিতা বলেছিল, কক্ষনো না। এমন কথা কেউ বললে গলা কেটে ডাস্টবিনে ফেলে দেব।
তাহলে তুমি যে, আমাকে এ নিয়ে শুধু খোঁচা দাও?
আর দেব না।
প্রমিজ?
প্রমিজ। তুমি আগে আর একটা বিয়ে করেছ— এটি আমি কখনো বিশ্বাস করি না।
সত্যি সত্যি ঋধিতা কয়েকদিন এই নিয়ে আর কোনো খোঁচা দেয়নি। কিছুদিন পর রচনা আমাকে ফোন করেছে জানার পর আবার খোঁচ দিতে শুরু করে। মেয়েদের মন, স্টিভেন হকিং-এর ভাষায়, ব্রহ্মাণ্ডের চেয়ে রহস্যময়।
কিছু বলছ না কেন?
অফিসে যাবার জন্য জামাকাপড় পরতে পরতে বলেছিলাম, সেদিন বলেছিলে একথা তুমি বিশ্বাস করো না। আজ আবার বলছ, তাও সন্তানের সামনে। এসব কী?
ঋধিতা বলল, সেদিন মানে সেদিন। প্রতিদিন অন্য একটা নতুন দিন। নতুন দিন মানে নতুন জীবন। বেঁচে থাকা অবধি এই খোঁচা খেয়ে যেতে হবে তোমাকে। যদি পার আমাকে রাখ, নইলে বিদায় করে দাও।
খোঁচা খেয়েছি। খেতে খেতে অনেকগুলো বছর চলে গেছে। এখনও খোঁচার শেষ নেই। অস্কারওয়াইল্ড ঠিকই বলেছেন, “মেয়েরা হাতির মতো, মানে আয়তনে নয়, কোনো কিছু ভোলে না। যথাসময়ে দুর্বল স্থানে আঘাত করে।” ছেলেরা আসলেই বুদ্ধ, আজকের কথা কাল হওয়ার আগে ভুলে যায়। এজন্য বৌদ্ধ হওয়ার জন্য বাড়িঘর ছেড়ে জঙ্গলে বৃক্ষের নিচে বসে যুগ যুগ সাধনা করতে হয়।
আমার বস মোজাম্মেল স্যারের বউ তাঁকে কথায় কথায় ডাকেন শুয়োরের বাচ্চা। আমাদের সামনেও। তিনি আফসোস করে বলেন, শামীম, আমি ভাই শুয়োরের বাচ্চা হয়ে গেলাম।
আপনার লজ্জা করে না? জানতে চেয়েছিলাম।
করে। তো আমি শুয়োরের বাচ্চা সেজন্য নয়।
কেন?
আমার বউ একটা শুয়োরের বাচ্চার স্বামী তাই।
অফিসে ঢুকে দেখি, নতুন জিও। ইতিহাস ও ভাষা সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য আগামী মাসে আদ্দিস আবাবা যেতে হবে। তবে সরাসরি নয়, কেপটাউন হয়ে। ফোন করে জানিয়ে দিলাম রচনাকে। আদ্দিসআবাবা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে ক্লাস নিতে যায়। বললাম, এবার গেলে যেন, আমার তারিখের সঙ্গে সমন্বয় করে।
সমন্বয় করতে হবে না।ওই সম্মেলনে রচনা এবং অনি বিশেষ ভক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত। তাদের সব খরচ কর্তৃপক্ষ বহন করবে। সম্মানিও পাবে। আমি যাচ্ছি বলে রচনাও কেপটাউন যাবে। অনির বহুদিনের ইচ্ছাও পূরণ করা হবে। খুব খুশি হবেন অনি। অনেক বার উপেক্ষিত হয়েছে অনির দাওয়াত।