সন্মিত্রা: চতুঃপঞ্চাশত্তম (৫৪) পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
ক্যাপটাউন থেকে আদ্দিস আবাবা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার। বিমান কাঁটায় কাঁটায় আদ্দিস আবাবা বোলে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পৌঁছল। চারদিক ছিমছাম, গোছানো এবং সাজানো। লোকজন তেমন নেই। চাঁদের আলো আর শহরের বাতির আলোয় চোখ জুড়িয়ে গেল।
বিমানবন্দরের শীতাতপ এলাকা হতে বের হওয়া মাত্র পৃথিবীর সব ঠান্ডা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল। উষ্ণ মহাদেশ আফ্রিকা, এমন ঠান্ডা অকল্পনীয়। আমি কাঁপতে শুরু করি। রচনা স্বাভাবিক। লন্ডনের মানুষের জন্য এই ঠান্ডা বাংলাদেশের বসন্ত। অনি হাতের শালটা গায়ে জড়িয়ে নিতে নিতে বলল, তাপমাত্রা বিশের কম।
আমি ক্যাপটাউনের গরমে সন্ত্রস্ত ছিলাম। গায়ে একটা টি-শার্ট। তাও আবার পাতলা। জামাকাপড় সব ল্যাগেজে। রচনা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা সোয়েটার বের করে আমার গায়ে পরিয়ে দিতে দিতে বলল, জানতাম এখানে ঠান্ডা, কিন্তু যা ভেবেছি তার চেয়ে বেশি। প্রকৃতি ক্রমশ রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে।
সোয়েটার গায়ে দেওয়ার পর ঠান্ডা লাগছে না। আমার জন্য চিন্তা করার কেউ আছে ভেবে মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠল। রচনা আমাকে তার শাল দিয়ে জড়িয়ে ধরে হাঁটছে। আমাকে আরও একটু উষ্ণতা দেওয়ার চেষ্টা নিজের ঘনিষ্টে নিয়ে গিয়ে বেশ ভালোভাবে করছে। শরীরে শরীরের উষ্ণতা তুলনাহীন।
আফ্রিকায় এমন সময়ে এত ঠান্ডা? আমি বললাম।
অনি বললেন, আদ্দিস আবাবা পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম রাজধানী। সমুদ্র সমতল থেকে দুই হাজার তিনশ পঞ্চান্ন মিটার ওপরে। এজন্য ইথিওপিয়াকে পৃথিবীর ছাদও বলা হয়। উচ্চতার জন্য আদ্দিস আবাবা আফ্রিকার অন্যান্য শহরের চেয়ে ঠান্ডা।
বিমান থেকে মনে হয়েছে, পাহাড়ের রাজ্যে নামছি। শুধু পাহাড় আর পাহাড়। এত পাহাড় নেপালেও নেই।
রচনা বলল, আফ্রিকার সত্তর ভাগ পাহাড় ইথিওপিয়ায়। পাহাড়ের জন্য দেশের অধিকাংশ এলাকায় গাড়ি চলাচল করতে পারে না। তাই ইথিওপিয়ানরা পাহাড়ে দৌড়ে দৌড়ে চলাফেরা করে। এজন্য তারা দৌড়ে বেশ ভালো। অলিম্পিকে স্বর্ণপদক পায়। সারা বিশ্বে দৌড়ে তারা খ্যাত।
নিরাপত্তা এলাকা পার হওয়ার পরপরই এক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা এগিয়ে এসে অনিকে বললেন, ম্যাম, ইথিওপিয়ায় স্বাগত।
কেমন আছ তুমি, অনি হেসে জানতে চাইল।
মেয়েটি বলল, পথে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
অনি মেয়েটিকে দেখিয়ে আমাকে বললেন, বৎশিবা। আকসুম-এর মেয়ে। আফ্রিকা-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ। ক্যাপটাউন ইউনিভার্সিটি থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে মাস্টার্স করার পর আফ্রিকান ইতিহাসের ওপর পিএইচডি করেছে। এখন আদ্দিস আবাবা ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক। আমার ডাইরেক্ট ছাত্রী ছিল। খুব ভালো ইংরেজি জানে।
বিদ্যুতের আলোয় মেয়েটিকে দেখলাম। দেখে বুঝলাম মানুষ কেন কালো চুলের জন্য এত পাগল। কালোর মতো সুন্দর আর কিছু নেই। সে সব অসুন্দরকে গিলে ফেলতে পারে নিমিষে। বৎশিবার সাদা দাঁতের ঝিলিক তার কালো জোছনাকেও উপহাস করছে।
আদ্দিস আবাবা অর্থ কী? জানতে চাইলাম।
বৎশিবা বললেন, আমহারিক ভাষায় আদ্দিস আবাবা অর্থ নিউ ফ্লাওয়ার, মানে নতুন ফুল। আদ্দিসআবাবা সারাবছর নতুন ফুলের মতো সজীব থাকে।
আপনার নাম যে শব্দ দিয়ে রচিত তার অর্থ?
শপথকন্যা।
বাহ, দারুণ তো!
আবিসিনিয়ার শাসক রানি শেবার নাম অনুসারে মা-বাবা আমার এই নাম রেখেছেন।
শপথকন্যাই বটে, অনি বললেন, “যা ধরে তা শেষ করেই ছাড়ে। অসাধারণ মেধা, অসাধারণ ধীশক্তি এবং উদারতা।”
এখন আমাদের গন্তব্য?
বৎশিবা বললেন, হোটেল গোল্ডেন টিউলিপ আদ্দিস আবাবা।
বেশিক্ষণ লাগল না হোটেলে পৌঁছতে। ভোরে রাস্তা কিছুটা ফাঁকা থাকে।
কফি আর ফুল দিয়ে স্বাগত জানাল গোল্ডেন টিউলিপ আদ্দিস আবাবা।
কফি কেন?
বৎশিবা বললেন, কফি আমাদের ঐতিহ্য। ইথিওপিয়ার খালদি নামের এক মেষপালক কফির আবিষ্কারক।
তাই নাকি?
খালদি, কাফা এলাকার এক মাঠে ছাগল চরাচ্ছিল, বৎশিবা বললেন, “একদিন দেখল, তার কয়েকটি ছাগল অস্থির হয়ে নাচানাচি করছে। কারণ অনুসন্ধানে নেমে পড়ল খালদি। দেখল, এরা একটা গাছের ফল খেয়েছে। খালিদও ওই গাছের ফল খেল। তার ভালো লাগল। এরপর আস্তে আস্তে ফলটি জনপ্রিয় হয়ে গেল। কাফা অঞ্চলের ঘটনা। তাই নাম রাখা হয় কফি।”
একজন লোক আমাদের মালামাল নিয়ে রুমে চলে গেলেন। লোকটার মুখ এমন ভয়ংকর মনে হলো, যেন কেউ পুড়িয়ে দিয়েছে। অবশ্য ইথিওপিয়ায় অনেকের মুখ দেখতে এমন।
আমি বললাম, মুখটা যেন দগ্ধ করে দিয়েছে কেউ।
বৎশিবা বললেন, এরা ইথিওপিয়ার প্রাচীন অধিবাসী। আমাদের দেশে আশিটির বেশি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী রয়েছে। আঞ্চলিক ভাষার সংখ্যা দুশোর অধিক।
ইথিওপিয়া অর্থ কী?
গ্রিক aitho এবং ops শব্দের মিলনে ইথিওপিয়া। aitho শব্দের অর্থ I burn এবং ops শব্দের অর্থ face । সুতরাং Ethiopia শব্দের অর্থ দগ্ধ মুখ।
এমন নাম কেন?
আমাদের দেশের পূর্বনাম ছিল আবিসিনিয়া। দেশটি ছিল বেশ সমৃদ্ধ, নিরাপদ এবং আসমানের খুব কাছাকাছি। অনেকদিন থেকে পৃথিবীর নানা গোষ্ঠীর লোক দেশটি দখল করতে চাইছিল। বাইরের কেউ দখল করতে পারেনি। তবে গোষ্ঠী বিরোধ ছিল প্রবল। এক গোত্রের সঙ্গে অন্য গোত্রের মারামারি লেগেই থাকত। একদিন গভীর রাতে এক গোত্রের লোকজন অন্য গোত্রের নিদ্রিত লোকের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিল। অনেকের মুখ পুড়ে যায়। তাই নাম হয় ইথিওপিয়া।
অনি বললেন, ইথিওপিয়া অনেক ঐতিহ্যবাহী দেশ। পৃথিবীর প্রাচীনতম বসতির একটি। খ্রিষ্টপূর্ব ৯৮০ অব্দে ইথিওপিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর দুটি দেশকে বাইরের কেউ কখনো দখলে রাখতে পারেনি। এর একটি হচ্ছে রাশিয়া এবং অন্যটি ইথিওপিয়া। ইতালি দুই বার ইথিওপিয়া আক্রমণ করেছিল। দুই বারই পরাজিত হয়েছে। এজন্য ইথিওপিয়াকে ‘আফ্রিকার শিং’ বলা হয়। আরব ছাড়া ইথিওপিয়াই আফ্রিকার একমাত্র দেশ যাদের নিজস্ব লিপি রয়েছে।
রচনা বলল, ইথিওপিয়ায় বহু খ্রিষ্টান ঐতিহ্য রয়েছে। যিশুখ্রিষ্টকে যে ক্রুশে বিদ্ধ করা হয়েছিল তার একাংশ ইথিওপিয়ায় এখনও আছে। টেন কমান্ডমেন্ডস যে সিন্দুকে রাখা হয়েছে, সেই সিন্দুকটাও ইথিওপিয়ার একটি গির্জায় রক্ষিত আছে।
অনি বললেন, মুসলিম ঐতিহ্যের দিক থেকেও ইথিওপিয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আগামীকাল কোনো প্রোগ্রাম আছে?
বৎশিবা বললেন, নেই।
তাহলে কোথায় যাওয়া যায়, কী বলো রাকু? আমি রচনাকে বললাম।
বৎশিবা বললেন, আমার শহর আকসুম দেখতে যাব। এটিই ইথিওপিয়ার সবচেয়ে সুন্দর এবং ঐতিহ্যবাহী শহর। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দ থেকে অবিচ্ছিন্ন শহর। আমাদের কাল গণনাও শুরু হয়েছে আকসুম থেকে।
কাল গণনা মানে?
অনি বললেন, ইথিওপিয়ায় তেরো মাসে বছর। এমন আর কোথাও নেই।
বৎশিবা বললেন, মুসলিমদের প্রথম হিজরত আকুসমেই। ইসলামের ইতিহাসে এটাকে আবিসিনিয়ায় হিজরত বলা হয়। মদিনায় হিজরতের আগে কুরাইশদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ মুহম্মদ এবং তাঁর অনুসারী মুহাজিরগণ হিজরতের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কোনো দেশ মুহাজিরদের আশ্রয় দিচ্ছিল না। অবশেষে তারা আকসুম রাজ্যে আশ্রয় নেন। তখন এর নাম ছিল আবিসিনিয়া।
বৎশিবা বললেন, আবিসিনিয়ার খ্রিষ্টান রাজা মুসলিমদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মক্কা থেকে কুরাইশরা প্রতিনিধি পাঠালে রাজা তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। মুহম্মদ এর মদিনায় হিজরত করার পরও মুসলিমরা আবিসিনিয়ায় থেকে যান। তারা হিজরি সপ্তম সালে মদিনায় ফিরে আসেন।
রচনা বলল, আকসুম দেখার পর তানা হ্রদ দেখতে যাব ।
তারপর?
গ্রেট রিফট উপত্যকা। যতই দূরেই হোক।
বৎশিবা বললেন, ইথিওপিয়ার তানা হ্রদ নীল নদের উৎস। বৃহত্তর নীল নদের পঁচাশি ভাগ জল এই হ্রদ থেকে যায়। আমাদের দা গ্র্যাট রিফট উপতাকা পৃথিবীর একমাত্র স্থান, যা মহাশূন্য থেকে দেখা যায়।
বৎশিবার কথা শেষ হওয়ার আগে অনির হাসব্যান্ড রাহান খান চলে এলেন। আমরা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ভদ্রলোক পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত আমেরিকান। তিনিও আদ্দিস আবাবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস ও ভাষা সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছেন।
রাহান খান আসায় আমরা রিসেপশন থেকে রুমের দিকে রওনা দিলাম।