সন্মিত্রা: অষ্টপঞ্চাশত্তম (৫৮) পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
ভাব্বা, কল্পনা ইদানীং আমাকে একদম সহ্য করতে পারছে না। কী করব?
তাহসিনের কথা শেষ হওয়ার পর বললাম, অথচ, বছর আগে তুমি আহ্লাদে আটখান হয়ে বলেছিলে, “রচনা আমার ভালোবাসার দাস হয়ে গেছে।” আমার পরিচিত যত লোক আছে, তার মধ্যে তুমিই কথায় অমায়িক। কখনো রাগ দেখিনি। তোমার একটা কথা বারবার মনে পড়ে। একবার প্রশ্ন করেছিলাম, স্বর্গ কী? তুমি কি বলেছিলে মনে আছে?
হ্যাঁ।
কী বলেছিলে?
কথা যখন মধুর হয়, জীবন তখন ফুলের বাগান হয়ে ওঠে। জীবন যখন ফুলের বাগান হয়, সংসার তখন শান্তির পারাবার হয়ে যায়। পৃথিবী তখন যে রূপটি ধারণ করে আমার সামনে এসে দাঁড়ায় সেটিই হচ্ছে স্বর্গ।
এমন কথা যে বলতে পারে, তার মুখ দিয়ে মন্দ কথা কীভাবে আসে? যে মুখ দিয়ে মল বের হয় সে মুখ কীভাবে অন্যের চুমো আশা করে? কল্পনা, কিন্তু কল্পনার চেয়েও বিশাল। তাকে ধারণ করতে হলে তোমাকে আরও বিশাল হতে হবে। পাত্রকে সবসময় ধারণীয় জিনিসের চেয়ে বড়ো হতে হয়। বিয়ের আগে আমার আর তার সম্পর্ক বিষয়ে তোমাকে পরিষ্কার ধারণা দিয়েছিলাম।
“ভাব্বা, আমার ভুল হয়ে গেছে। আমাকে ক্ষমা করে দিন।” বলে তাহসিন আমার পা দুটো জড়িয়ে ধরতে গেল।
আমি বাধা দিয়ে বললাম, বুঝতে পারছি, কল্পনা সবসময় আমার কথা বলে। তাই তোমার কষ্ট হয়। কিন্তু দশজনের কথা বললে কেমন লাগত? তুমি তো লন্ডনে থাক, তোমার পরিচিতদের দাম্পত্য জীবনের দিকে খেয়াল দিয়েছ কোনো দিন? তুমি নিশ্চয় জান, আমি তাদের জীবনে কতটুকু স্থান অধিকার করে আছি। এ আমার প্রাপ্য, কিন্তু দাবি ছিল না কখনো। তারা তা সীমাহীন কৃতজ্ঞতায় দিয়ে যাচ্ছে অবিরত। যা সহজে কেউ পারে না এবং পায় না। আমার পিতৃহীন দুই বোনের জন্যও আমি অনেক করেছি। তারা তো একটা ফোন পর্যন্ত করে না!
আপনি স্যার, একটু বলুন, সে যেন এটি ভুলে যায়। নইলে আমি বাঁচব না।
আমি আবার রিং করলাম কল্পনাকে।
কল্পনা বলল, তাহসিন একটা খারাপ মানুষ। খারাপ মানুষের সঙ্গে থাকলে আমিও খারাপ হয়ে যাব। আমার সন্তানও খারাপ হয়ে যাবে।
তাহসিন খারাপ মানুষ নয়। রাগই মানুষকে খারাপ করে দেয়। রাগের ফাঁদে পড়ে সে অনৈতিক কাজ করেছে।
অনৈতিক কাজ কী?
যে কাজ করলে ভালো মনে হয়, মনে আনন্দ এবং প্রশান্তি আসে সেটি নৈতিক কাজ কিন্তু যে কাজ করলে খারাপ কাজ করা হয়েছে মনে হয় এবং মনে অনুতাপ এসে ভিড় করে সেটি অনৈতিক কাজ। তাহসিন তার কাজের জন্য অনুতপ্ত।
মোবাইলের কথা শেষ হওয়ার পর তাহসিন আমার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি খুব নিন্দনীয় কাজ করেছি।
এটি এখন আর নিন্দা নেই। অনেকে যেটি বলে সেটি নিন্দা থাকে না। বাণী হয়ে যায়, যদিও প্রত্যেক বাণী সত্য এবং প্রত্যেক সত্যের বিপরীত সত্য আছে। তাই প্রত্যেক বাণী মিথ্যা এবং প্রত্যেক বাণী সত্য। তোমার ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই। তুমি এসব বলোনি। রাগই তোমাকে বলিয়েছে। তবে একটা উপদেশ দিই, বউয়ের সামনে মুখ খুলবে না। তোমার সামনে দিয়ে মধুর নহর বয়ে গেলেও। বউয়ের বাক্যবাণ এবং বিচ্ছেদাশঙ্কা সহ্য করতে না পারলে, মরে যাওয়া উত্তম।
আমাকে উপদেশ দেবেন না। আদেশ দিন।
বউ এবং বস—এ দুজনের সামনে মিউট থাকাই কিউট ।
এবার থেকে তাই হবে।
তুমি জানে না রচনা, আল্পু-কল্পু আর টুটুলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক এখনও কেন প্রথম দিনের মতো? কারণ তারা জল, আমি নুড়ি হয়ে ডুবেছিলাম সেই জলে। নুড়ি হাজার বছর সমুদ্রে ডুবে থাকলেও রস টেনে নেয় না। যেমন ছিল তেমন থেকে যায় অবিকল। কিন্তু শোলা? মুহূর্তে জলে টেনে নিজের বক্ষকে ভরাট করে ফেলে। তাই সহজে পচে যায়। জলের খাদক হতে গিয়ে শোলা নিজেই জলের খাদ্যে পরিণত হয়।
কল্পনা মাঝে মাঝে উগ্র হয়ে যায়। খুব স্পর্শকাতর হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।
তার পেটে বাচ্চা। এ অবস্থায় মানুষ খুব স্পর্শকাতর হয়ে পড়ে। আমার স্ত্রী এর চেয়ে বেশি স্পর্শকাতর হয়ে পড়েছিল। সে আমাকে অনেক কড়া কথা বলে, আমি প্রত্যুত্তরে কোনো মন্দ কথা বলি না। আপনজনের কাছে বিনয়ী এবং পরাজিত হওয়ার আনন্দ পেতে শেখো। তুমি কী কল্পনাকে ভালোবাস?
অবশ্যই।
তাহলে তার কথায় প্রতিক্রিয়া দেখাবে কেন?
কষ্ট পায় যে?
তা তো মনের মাঝে থেকে যাবে।
শোনো, আমি ছাড়া তাদের আপন বলতে কেউ নেই। অন্যকে প্রচণ্ডভাবে ভালোবাসার মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার একটি বিষয় আছে। এটিই পরাজয়, আসলে পরাজয় নয়, জয়। এমন হারিয়ে যাওয়ার আনন্দ অসীম। যারা এই হারিয়ে যাওয়াকে পরাজয় মনে করে, বুঝতে হবে তারা কখনো ভালোবাসা পায়নি।
তাহসিন আসার সময় আমার জন্যও টিকিট নিয়ে এসেছে। টিকিট বড়ো কথা নয়, বড়ো কথা হচ্ছে জিও। আমার যে পাসপোর্ট তাতে জিও ছাড়া যাওয়া যায় না। সরকারের সঙ্গে আমার অবস্থা ভালো না। জনপ্রশাসন সচিব আমার নাম শুনলে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন। আমি যখন সৈয়দ আবুূল হোসেনের পিএস তখন তিনি ওই মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন।
কী করা যায়?
যদি তাকে রিং করি তাহলে অপমান করতে ছাড়বেন না। বৈদেশিক ছুটি অবশ্যই দেবেন না। এমন একটি সুযোগের জন্য তিনি বহুদিন অপেক্ষা করছেন। কিন্তু প্রয়োজনে অপমান হজম করার শক্তিই হচ্ছে আসল অভিযোজন ক্ষমতা। এটি আমার কোনো কালে ছিল না। অনেক চেষ্টা করেও আয়ত্তে আনতে পারিনি। সুসময়ে অপমান খুব স্পর্শকাতর থাকে। সামান্য অবহেলাতেও তা লাফিয়ে ওঠে। যতদিন ক্ষমতা, অর্থ আর প্রভাববিস্তারক বিষয়গুলো সক্রিয় থাকে ততদিন অপমান বোধের লক্ষ দরজা খোলা থাকে, কিন্তু ঢোকার কোনো সুযোগ পায় না। ওইগুলো চলে যাওয়ার পর যারা অপমানকে হজম করতে পারে তারা আবার সুসময়ের আশা করতে পারে। দুঃসময়ে যারা অপমানিত হওয়ার জন্য প্রতিবাদ করে তাদের সুসময় কখনো আসে না।
সৈয়দ আবুল হোসেন আমাকে পুত্রের মতো স্নেহ করেন। তাকে বিষয়টা বললাম। তিনি সচিবের সঙ্গে আলাপ করে রিং করলেন।
তোমার বিমান কয়টায়?
রাত দুইটায়।
দুপুর তিনটায় জিও পেয়ে যাবে।
সৈয়দ আবুল হোসেন কিছু বলা মানে হয়ে যাওয়া। যদি আগামীকাল সচিব না মারা যান তাহলে আমার জিও পাচ্ছি। সোনারগাঁও হোটেল থেকে বের হয়ে সোজা সচিবালয়। দরখাস্ত দিয়ে চলে এলাম বাসায়।
ঋধিতাকে বললাম, আামি লন্ডন যাচ্ছি।
কোনো কারণ জানতে না চেয়ে ঋধিতা বলল, যেতে পারবে না।
খুব জরুরি। না গেলে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।
কার?
আমার।
তোমার ক্ষতি আমার প্রার্থনা। হোক ক্ষতি তবু যেতে দেব না। মরলে সামনে মর।
সত্যি বলছি, খুব জরুরি।
রাখো, তোমার জরুরি। যদি আমার অবাধ্য হয়ে লন্ডন যাও আর আসবে না। তোমাকে আমি ত্যাগ করে বোঝামুক্ত হব। তুমি আমার জীবনের একটি দুঃসহ বোঝা। অসভ্য, লন্ডন কেন যাচ্ছ আমি জানি না?
কেন?
শরীর গরম হয়েছে, ঠান্ডা করতে যাচ্ছ।
যাই বলি, পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হবে। চুপ করে পোশাক পাল্টে নিজের রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়লাম। সারাদিন আর কোনো কথা হলো না। রাতে পাসপোর্ট এবং অতি প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস হাতব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে রাতটা কাটিয়ে দিলাম।
সকাল বেলা অফিসে যাওয়ার সময় বললাম, আমি অফিস থেকে লন্ডন যাব। কয়েকদিন পর ফিরব।
জাহান্নমে যাও, যেখানে খুশি সেখানে যাও। যতদিন খুশি ততদিন থাকো। আমাকে বলো না। তবে তুমি আর ফিরো না—এ আমার মিনতি। যে উড়োজাহাজে যাচ্ছ সেটি যেন ধ্বংস হয়ে যায় আকাশে। তোমার মতো পাপীকে মাটি ধারণ করতে পারবে না।
চুপচাপ অফিসের উদ্দেশে বের হয়ে এলাম। বাসা থেকে বের হওয়ার পর শরীরটা হঠাৎ হালকা হয়ে গেল। এতক্ষণ মনে হয়েছিল যেন, অক্সিজেনহীন কোনো পৃথিবীকে কার্বন ডাই অক্সাইডের ভেতর ডুবেছিলাম। মনে মনে শঙ্কিত হয়ে উঠলাম। বাসা সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। প্রিয় জায়গা কখন এমন খারাপ হয়ে যায়! তিনটার আগে জিও পেয়ে যাই। আর বাসায় যাব না। বাসায় যাওয়া মানে আরেক সংকটে পড়া।
ঋধিতাকে রিং করলাম।
আমি লন্ডন যাচ্ছি।
যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাও। আমাকে রিং করো না। ছেলেমেয়েরা পড়ছে। তুমি না ফিরলে আমি খুশি হব। বাসা ভাড়া লাগবে না। মাসিক খরচ ইচ্ছে হলে দিও। নইলে দিও না। আমার যা আছে তা দিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে পারব।
এসব কী বলো?
তুমি একটা স্বার্থপর। আমাদের নিয়ে তুমি কখনো ভেবেছ? শুধু নিজেকে নিয়েই ভাব। তোমার তিন লন্ডন রক্ষিতাকে নিয়ে ভাব। তুমি একটা গোরু। গোরুর পিছনে লেজ থাকে, চাঁদ-তারা নয়, মল থেকে গন্ধ আসে গোলাপের সুবাস নয়। আমি যেমন, আমার প্রাপ্তিটাও হবে তেমন।
তোমার মনটা ভালো, কিন্তু কথাগুলো খুব মারাত্মক। সহজে রেগে যাও। নইলে তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রমণী।
রাখো তোমার তেল মারা কথা। যে নিজেকে নিয়ে ভাবে তার আবার দর্শন!
তুমি কি আমাকে নিয়ে কখনো ভেবেছ?
আমি শুধু আমাকে নিয়ে ভাবব, অন্যদের অবহেলা করব, অন্যরা আমাকে নিয়ে ভাববে কেন?
তা ঠিক নয়।
ঠিক হোক বা না হোক, আমার জীবনে তোমার প্রয়োজনীয়তা শূন্য হয়ে গেছে। বিষয়টি মনে রাখলে আর অপমানিত হতে হবে না। আমি যেন আর তোমাকে না দেখি। এটিই আমার প্রার্থনা।