সন্মিত্রা: ঊনষষ্টিমত (৫৯) পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
অক্সফোর্ড বিমানবন্দরে রচনা, আল্পনা, টুটুল ও রাজ-রোজিকে দেখলাম। সবার মুখে কিছু উৎকণ্ঠা। কল্পনাকে দেখলাম না।
সবাই এমন উৎকণ্ঠিত কেন? কী হয়েছে?
কিছু না, রচনা বলল।
সবাই ভালো?
ভালো।
কল্পনা?
সে গাড়িতে বসে আছে।
গাড়িতে কেন?
হাসপাতাল থেকে চলে এসেছে। না করেছিলাম, কিন্তু রোখা গেল না। হাঁটতে পারছে না। ডাক্তারের মতে আজই তার ডেলিভারি ডেট। তবু চলে এসেছে।
ডাক্তার আসতে দিল?
দিতে চায়নি। কিন্তু ডাক্তার বুঝেছিল আসতে দিলে যা ক্ষতি হবে, না দিলে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হবে। ভাব্বা, শরীর-মন আর ভালো-মন্দ সব মানসিক ব্যাপার।
রচনার কথা শুনে আমি গাড়ির দিকে দৌড় দিলাম। তাহসিনও দৌড় দিতে চাইল। রচনা বাধা দিল তাহসিনকে, তুমি এখন কল্পনার কাছে যেও না। লাগেজগুলো নিয়ে সোজা বাসায় চলে যাও। আমরা হাসপাতাল যাচ্ছি।
শিশুকে দেখব না? কল্পনাকে দেখব না?
তোমাকে দেখলে কল্পনা উত্তেজিত হয়ে পড়বে। দেখার সময় বহু আছে।
তাহসিন চলে গেল লাগেজ নিতে। গাড়িতে গিয়ে দেখলাম সিটে শোয়ার মতো করে বসে আছে কল্পনা। আমাকে দেখে হাঁউমাউ করে কেঁদে উঠল, ভাব্বা, শিশুটা আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। আমার পেটে একটু হাত বুলিয়ে দিন।
আমি হাত বুলিয়ে দিলাম। কল্পনা হাসি দিয়ে বসা অবস্থায় আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, সে শান্ত হয়ে গেছে। আমার চেয়ে বেশি ভয় পায় আপনাকে। এমন সন্তানই চাইছিলাম।
তুমি হাসপাতাল ছেড়ে এখানে কেন এলে?
কষ্ট থামাতে। এই যে এখন আমি ভালো হয়ে গেলাম। কোনো চিকিৎসাই আমাকে এমন ভালো করতে পারত না। ভাব্বা, আমাকে আগের মতো জড়িয়ে ধরেন।
ততক্ষণে গাড়ি অনেকদূর এগিয়ে। বুঝতে পারছিলাম, সন্তান জন্মদানের সময় ঘনিয়ে আসছে। তবে সমস্যা হবে না। বিমানবন্দর থেকে রচনার বাসায় যেতে পনেরো মিনিট লাগে। হাসপাতাল আরও কাছে।
কয়েক মিনিটের মধ্যে হাসপাতাল পৌঁছে গেলাম। কল্পনা নামতে পারল না। তার সিট রক্তে ভিজে গেছে। স্ট্রেচারে তোলা হলো। সে আমার হাত ছাড়ছে না। হাত ছাড়িয়ে নিতে গেলে কেঁদে উঠছে। স্ট্রেচারের সঙ্গে আমাকেও যেতে হলো। অস্ত্রোপচার রুমে ঢোকানোর পাঁচ মিনিট পর ডাক্তার লিন্ডা একগাল হাসি নিয়ে বের হয়ে বলল, ভাব্বা কে?
আমি।
আপনি কাছাকাছি থাকবেন। আপনার কোলেই প্রথম শিশুকে দিতে বলেছে।
মায়ের অবস্থা কেমন?
আপনি কাকে চান, মা না শিশু?
আঁতকে উঠে বললাম, দুজনকে।
একজনকে যদি হারাতে হয়, তখন কাকে?
বাচ্চাকে।
নার্স হাসি দিয়ে বললেন, এজন্যই তো ভাব্বা। আপনি ভাগ্যবান। কারো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। আপনার কল্পনার কোনো অসুবিধা হবে না।
দশ মিনিট পর আবার আমার ডাক পড়ল। ওটি রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। কল্পনা সুস্থ। সে হাসছে। তার পাশে একটা শিশু, নাদুসনুদুস। বাংলাদেশের সাধারণ তিন জন শিশুর সমান। সিজার নয়, স্বাভাবিক প্রসব।
ভাব্বা কোলে নেন, আপনাকে।
আমাকে মানে?
আপনার যা নাম আমার খোকারও সেই নাম হবে।
তাহসিনকে ডাকি?
কল্পনা আমার কোলে খোকাকে দিতে দিতে বলল, তাকে দেখলে আমার মেজাজ ভালো থাকবে না। সে একটা অভদ্র। খারাপ মানুষ। আপনাকে নিয়ে খারাপ কথা বলেছে। তার চোখ পড়লে আমার খোকাও খারাপ হয়ে যাবে। প্লিজ ডাকবেন না, ডাকবেন না তো?
এখন জোর করা উচিত হবে না। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। তাকে আমি জানি। জোর করলে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে।
শেষ রাতের দিকে কল্পনার ঘুম আসার পর রচনা একপ্রকার জোর করে আমাকে বাসায় পাঠিয়ে দিল। জামাকাপড় বদলাতে হবে। পরদিন আবার হাসপাতাল। কল্পনা আমাকে দেখে বলল, আপনি যখন চলে যান, তখন খোকাকে আমার ভয়ানক মনে হয়।
কেন?
সে আপনার মতো হবে না। আপনি তো কিছুদিন পর চলে যাবেন, যতদিন পারেন তাকে সঙ্গ দিন। তাহলে সে আপনার মতো হয়ে যাবে। থাকবেন তো?
থাকব।
রাতেও থাকতে হবে। প্রতিদিন থাকতে হবে। আপনি না থাকলে রাতে নানা উদ্ভট কিছু দেখি। ভয় লাগে। গভীর রাতকে মনে হয় ভরদুপুর, সকালে উঠে দেখি, ভোরটা সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
তারপর?
মুখ ধুয়ে ফলের ঝুড়ির দিকে তাকালে দেখতে পাই, সব আপেল টম্যাটো হয়ে গেছে। আপনি বলতেন, টম্যাটো আপেলের চেয়ে পুষ্টিকর। এখন আমাকে পুষ্টিকর খাদ্য খেতে হবে তো, তাই আমার আপেল নয়, টম্যাটো চাই। বাংলাদেশে আপেলের দাম, টম্যাটোর চেয়ে বেশি। বিপরীত কেন?
আমি খোকার গালে একটা চুমো দিয়ে বললাম, ধনীর বিপরীত গরিব, তাই ব্রিটেনের আপেল আমাদের টম্যাটোর চেয়ে দামি।
ভাব্বা, আপনি এর মধ্যে খোকার গালে ছয়টা চুমো দিয়েছেন। আমাকে কিন্তু একটাও দেননি। আপনাকে সারাক্ষণ আমার সঙ্গে থাকতে হবে।
থাকব। আজ সবাই আসবে।
থ্যাংক ইউ।
আমাদের সবাইকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য তোমার প্রিয় লোকটাকে আসার জন্য অনুরোধ করি?
পাগলা দাদু?
হ্যাঁ।
দারুণ হবে। রাতে আপনাকে থাকতে হবে।
থাকব।