Warning: Constant DISALLOW_FILE_MODS already defined in /home/draminb1/public_html/wp-config.php on line 102

Warning: Constant DISALLOW_FILE_EDIT already defined in /home/draminb1/public_html/wp-config.php on line 103
সন্মিত্রা : এক মলাটে সন্মিত্রা: সন্মিত্রা সম্পূর্ণ উপন্যাস : প্রথম থেকে শেষ পর্ব – Page 60 – Dr. Mohammed Amin

সন্মিত্রা : এক মলাটে সন্মিত্রা: সন্মিত্রা সম্পূর্ণ উপন্যাস : প্রথম থেকে শেষ পর্ব

সন্মিত্রা: ষষ্টিমত (৬০) পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন

আমি রাতে থাকছি।
কল্পনা খুশি হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ভাব্বা, জীবন একটা শিল্প, জীবন একটা কবিতা, জীবন একটি গোছানো সাহিত্যকর্ম।তাই এখানে আনন্দ, দুঃখ-বেদনা সব একটার সঙ্গে একটা জড়াজড়ি করে থাকে। যেমন আপনি জড়িয়ে থাকেন আমাদের। আকাশ জড়িয়ে রাখে পৃথিবীকে।
“ঠিক বলেছ”, আমি বললাম, “জীবন আসলেই অনেক সুন্দর। তাই তার প্রতি মৃত্যুর এত লোভ। জীবনের সঙ্গে কেবল মৃত্যু আর সুন্দরের তুলনা চলে, অন্য কারও নয়। এই যে, খোকা তার দিকে তাকালে কী মনে হয়?”
উত্তর দেওয়ার আগে কাশি দিয়ে পাগলা দাদু রুমে ঢুকলেন। তার সঙ্গে রাজ-রোজি আর নিনি। তারা আসার পর রুম আরও সরব হয়ে উঠল । টুটুলও তার ভক্ত। তাকে খবর দিলাম। চলে এসো, পাগলা দাদুকে নিয়ে এসেছি। সেও চলে এল। ততক্ষণে সন্ধ্যা রাতের দিকে হেলে পড়েছে। আগামীকাল কল্পনাকে ছেড়ে দেবে হাসপাতাল।
পাগলা দাদু টুটুলকে বললেন, একটা বাংলা কবিতা পড়। অনেক দিন শুনিনি।
টুটুল পড়তে শুরু করে—
“হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়
এবার কঠিন, কঠোর গদ্যে আনো,
পদ-লালিত্য ঝঙ্কার মুছে যাক
গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো!
প্রয়োজন নেই কবিতার স্নিগ্ধতা—
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়:
পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি॥
এটা তো কবিতা নয়, উদ্ভট আর এলোমেলো কটি পঙ্‌ক্তি। যাই হোক, এই বোধহীন কথাগুলোর অর্থ কী?
অর্থ বুঝিয়ে দিল টুটুল—
The life great, no more of this poetry.
Bring on the stubborn, harsher prose instead.
Let the chime of verse disappear
And the firm hammer of prose strike.
No need for the tranquility of poem;
Poetry, I give you a break, go away as holiday
In the rule of hunger, the world occupy by prose instead
The full moon burns like a loaf of bread.
পাগলা দাদু বললেন, কবি ঠিক বলেননি। অপরিপক্ব চিন্তার খুব সাধারণ ভাবনা। লেবুর মতো টক, কিন্তু বিন্দুমাত্র ভিটামিন সি নেই। গভীরতার চিহ্নমাত্র নেই। কবির জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার গভীরতা নিশ্চয় কম ছিল।
টুটুল বলল, বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে পঙ্‌ক্তি গুলো খুব জনপ্রিয়।
অপরিপক্ব পাঠকের কাছে তেমনই মনে হতে পারে। যেমন লেখক তেমন পাঠক। যেমন নাগরিক তেমন নেতা।
আমি বললাম, কী ভুল করেছেন কবি?
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় হয় না, পদ্যময় হয়। জগতের সব ভিক্ষুক, সব প্রার্থী কবিতায় কবিতায়, গানে গানে কিংবা সুরে সুরে ছন্দ দিয়ে পরম অনুনয়ের সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায়, বাড়িতে বাড়িতে ভিক্ষা করে প্রার্থনা করে। যারা গাইতে পারেন না, তারা যন্ত্রসংগীতে সুর তোলে। লন্ডনের রাস্তায় এবং আন্ডার গ্রাউন্ডে দেখনি? নির্বাচনে ভোটপ্রার্থীরা কবিতায় কবিতায় ছন্দে ছন্দে ভোট ভিক্ষা করে। কবিতা হচ্ছে ক্ষুধার সঙ্গী।
টুটুল বলল, কিন্তু!
পাগলা দাদু বললেন, গদ্য বর্ণাঢ্য বর্ণনার হিল্লোল। সমৃদ্ধ জীবনের শৃঙ্খলহীন ভাবনার নাদুস যথেচ্ছাচার। সারিতে সারিতে প্রতিশ্রুতি। গদ্যরা বাক্যের পর বাক্য এবং অগণিত শব্দ নিয়ে ইচ্ছেমতো খেলে বেড়ায় বিরামহীন, নধর বালকের কদর অধরের মতো প্রসর মমতায়। যাদের পেটে ভাত আছে তারাই গদ্য করে। ভরা পেট বলে কথা থামতেই চায় না। কথায় কথায় আবিষ্ট করে রাখে ক্ষুধার্তদের।
কবিতা কি তাহলে গরিবদের জন্য?
“হ্যা”, পাগলা দাদু বললেন, ক্ষুধার্তরাই কবিতা পড়ে এবং কবিতা করে। কবিতা পড়ে গদ্যকের মনোরঞ্জন করে। এটাই তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়। কবিতা পড়ে গাদ্যিকদের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত থাকাই ক্ষুধার্তদের কাজ। তাই ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী পদ্যময়।
আর পূর্ণিমার চাঁদ? আমি প্রশ্ন করলাম।
এটি গাদ্যিকদের জোছনার উৎস। ক্ষুধার্তদের নিদ্রা। কোনো ক্ষুধার্ত যদি পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটি ভাবে তাহলে ঝলসানো রুটিকে কী ভাববে?
কল্পনা বলল, পূর্ণিমার চাঁদ।
তাঁর মানে দুক্ষেত্রে তাদের বঞ্চিত থাকতে হবে। কেউ যখন খাদ্যের জন্য পীড়িত হয়ে ওঠে তখন সে খাদ্য নিয়ে এত ভুল করতে পারে না। তখন কবিতা ছাড়া অন্যকে সন্তুষ্ট করে অন্ন জোগাড় ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। এজন্যই দরিদ্ররাই কবি হয়। কবিতা দরিদ্রদের বেঁচে থাকার রসদ।
টুটুল বলল, এভাবে কখনো চিন্তা করিনি।
পাগলা দাদু বললেন, এভাবে সবাই সাধারণ মানুষকে ফাঁকি দেয়।
কল্পনা বলল, ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে। এক মুঠো ভাতের জন্য কী করুণ স্বরে আবেদন জানাতাম ভাতওয়ালাদের। প্রতিটা শব্দ কবিতার ছন্দ দিয়ে প্রকাশ করতাম, যাতে অন্নদাতার মনে সহানুভূতির সঞ্চার হয়।
পাগলা দাদু বললেন, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী পদ্যময়, এটি প্রার্থনা গৃহে বন্দকদের কাব্যাকুতি এবং ধর্মগ্রন্থের পঙ্‌ক্তি-সুর শুনলে বোঝা যায়। ঈশ্বর দাতা, আর বন্দকরা ক্ষুধার্ত। ঈশ্বর গদ্যের, আরা বন্দকরা পদ্যের। যারা ধনী তারা গদ্য, তাদের জন্যই গদ্য। যারা ক্ষুধার্ত তারা পদ্য, তাদের সবকিছু পদ্য করে তুলতে হয়। তারা পূর্ণিমার চাঁদে নয়, জোছনাতেও পদ্য দেখে। আর ধনীরা সবকিছুতে দেখে গদ্য।
কল্পনা বলল, পদ্যে পদ্যে ধনীদের স্তুতি করাই কবিদের কাজ। কোনো ধনী কি কবি হতে পারে? গরিবেরা পদ্যের সুরে ধনীদের বিগলিত করে তাদের মনের ক্ষুধা মেটানোর জন্য কবিতা বানায়। বিনিময়ে কবিরা অন্ন পায় পেটের ক্ষুধা মেটানোর জন্য।
কথায় কথায় রাত চলে গেল।
সূর্যের আলো ঘাসের শিশিরে আপতিত হওয়ার আগে পাগলা দাদু চলে গেলেন। এমন শিশিরে খালি পায়ে ছোটা তার ভোরের প্রথম কাজ। তিনি সব ছাড়তে পারেন, কিন্তু ভোরের ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটা কখনো ছাড়তে পারেন না।
দুপুরের দিকে কল্পনাকে হাসপাতাল থেকে মুক্তি দেওয়া হলো। গাড়িতে উঠার আগে ফোন এল ঋধিতার, তুমি কেমন আছ জানার জন্য রিং করিনি।
তা হলে?
তুমি যেন বাসায় আর না ফিরো—এটা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য রিং করলাম।
কল্পনার আরোগ্য-আনন্দ নিমিষে ধুলো হয়ে গেল।