সন্মিত্রা: একষষ্টিমত (৬১) পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
আমার কোলে কল্পনার সন্তান। রাখতে কষ্ট হচ্ছে। বেশ ভারী। বাংলাদেশি ছেলে হলে ভারী লাগত না। আমার মনে হয়, এজন্য প্রকৃতি বাংলাদেশের সদ্যপ্রসূত শিশু সন্তানের ওজন একটা বড়ো সাইজের দেশি মুরগির বেশি দেয় না, যাতে কোলে নিতে আধমরা বাঙালি স্বজনদের সুবিধা হয়।
কল্পনার কোলে পান্ডা। মানে কাপড়ের তুলতুলে পুতুল। তাহসিন বাসায়। তার নামই শুনতে পারছিল না কল্পনা। এখনও তাহসিন নবজাতককে দেখেনি। বাসায় গেলে কল্পনার অজান্তে গোপনে এসে দেখে যাবে। রচনা এমন ব্যবস্থা করেছে।
গাড়ির ড্রাইভিং সিটে রচনা। তার পাশে টুটুল। মাঝের সিটে আল্পনা, কল্পনা এবং আমি। পিছনে নিনি এবং রাজ-রোজি।
গাড়ি ছেড়ে দিল হামিদ।
গাড়ি নড়ে উঠতেই আল্পনা বলল, আপু, গাড়ি কোথায় যাচ্ছে?
গাড়ি যাচ্ছে না, নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, আমি মজা করে বললাম।
কল্পনা আমার মজায় মজা ঢুকিয়ে বলল, আপু, ভাব্বার গাড়ি সাহেবকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?
তোমার বাসায়।
আমার বাসায় কেন তোমার গাড়ি যাবে। আমার কী গাড়ি নেই।
তাহলে কোথায় যাবে?
ভাব্বা কোথায় থাকবেন?
প্রতিবার এলে যেখানে থাকেন।
তাহলে আমাকেও ওখানে নিয়ে যাও। আমি ভাব্বা ছাড়া থাকব না। তাহসিনের বাসায় যাব না। যদি বাধ্য করো, তাহলে…
তাহলে কী? আল্পনা জানতে চাইল।
টুটুল বলল, মেজাপু, তুমি আর খোকাকে নিয়ে হুমকি দিতে পারছ না।
কেন?
কারণ তুমিই তার নাম রেখেছ ভাব্বার নামে।
আল্পনা বলল, এখন ভাব্বাকে হুমকি দাও, দাও না; দেখি কেমন সাহস!
টুটুল বলল, আপু, বাবুকে নিয়ে আর কিছু করতে পারছ না। ও তোমার শরীর আর মন দুটোরই অংশ হয়ে গেছে। জটিল নাম রেখেছ। আসলে, এতদিন পর বুঝলাম, নাম কত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। এজন্য দেশে দেশে নামের জন্য মানুষ উন্মাদ হয়ে যায়।
আল্পনা বলল, পাগল আর উন্মাদের মধ্যে তফাত কী?
রচনা বলল, সব মানুষই পাগল কিন্তু সব পাগল উন্মাদ নয়।
আমি বললাম, কী বুঝলে?
আল্পনা বলল, পৃথিবীর সব মানুষ পাগল, কিন্তু সব মানুষ উন্মাদ নয়।
আমাকে খাবলা দিল বাবু।
কল্পনা চড় দিতে যাবে। এসময় টুটুল বলল, ভাব্বাকে চড় দিতে যাচ্ছ? থেমে গেল কল্পনা। আকস্মিক হাতটা গুটিয়ে নিয়ে বলল, “অসুবিধা নেই, একে তো কিছু করা যাবে না, তাহসিন বাঁদরটাকে শেষ করে দেব।”
কথাটি শেষ করে কল্পনা আমার দিকে তাকাল। চোখাচোখি হলো। আমি প্রতিক্রিয়াহীন অবয়বে চোখ নামিয়ে বাবুর চোখে চোখ দিলাম। অবাক কাণ্ড, আমার অস্ফুট কণ্ঠে রচনা সচকিত হলো।
কী হয়েছে স্যার? গাড়ি ততক্ষণে অর্ধেক পথ চলে এসেছে।
দেখ, বাবুর চোখে ভাসছে।
কী ভাসছে?
ভবিষ্যৎ, অন্তরেও ভবিষ্যৎ।
আল্পনা বলল, শিশুদের অন্তরে অনেকে শিশুর পিতা দেখে।
আমি তন্নতন্ন করে খুঁজেও তার চিহ্নমাত্র পেলাম না। আমি দেখলাম বাবুর চোখে আর এক শিশু, মানে অনাগত ভবিষ্যৎ।
কল্পনা বলল, তাহলে কী “ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে” কথাটি ঠিক নয়?
আল্পনা বলল, ঠিক হবে কীভাবে, শিশুর অন্তরে পিতা নয়, সন্তানই ঘুমিয়ে থাকে। শিশুর অন্তরে যদি শিশুর পিতা ঘুমিয়ে থাকে, তা পশ্চাৎপদতা। সন্তানই অনাগত ভবিষ্যৎ, শিশুর অন্তরে ঘুমিয়ে থাকবে আগামীকালের শিশু। ভাব্বা কবি ভুল করলেন কেন?
আমি বললাম, কবি পিতা বলতে ওই শিশুর বাবাকে নয়, শিশুর বাবা হওয়ার ইচ্ছাকে বুঝিয়েছেন। এবার বুঝলে? এই যেমন আমাদের বাবুর মনে পিতা হওয়ার স্বপ্ন লুকিয়ে আছে। যেমন, লুকিয়ে আছে আমাদের টুটুলের একজন শিশুর বাবা হওয়ার সাধ।
টুটুল কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলল, ভাব্বা, আপনি কিন্তু…
টুটুলের কথা শেষ হওয়ার আগে গাড়ি থেমে গেল।
গাড়ি রচনার বাসার সামনে।
সবার আগে নামল টুটুল। তারপর কল্পনা। এরপর আমার নামার পালা। শিশুকে নিয়ে নামতে কষ্ট হচ্ছিল।
শিশুটা নাও, কল্পনাকে বললাম।
আপনাকে আমি কোলে নিতে পারব না।
কিন্তু তুমি তো আমার কোলে চড়ে বড়ো হয়েছ। কাঁধে বসিয়ে ছাদে নিয়েছি, হাঁফিয়ে গেলে বলতে, বুড়ো হয়ে গেছি। এখন আমাকে কোলে নেবে না কেন?
ভাব্বা, এই শিশু আমার আর আপনার মাঝে দেওয়াল তুলে দেবে মনে হয়।
রচনা বলল, দেওয়ালই তো সভ্যতার বিশাল অংশ দখল করে আছে। দেখো, চারদিকে দেওয়াল আর দেওয়াল। সীমান্ত আর সীমান্ত। একটা বাসার ভেতর কতটি রুম, কতটি দেওয়াল। সবাই আড়াল হওয়ার জন্য পাগল।
আমি বললাম, কল্পু, তুমি যে বাবুকে দেওয়াল বললে, সেটি আসলে দেওয়াল নয়, সেতু। এই সেতু দিয়ে আমাদের দূরত্ব আরও কমে গেল, আরও নিবিড় হওয়ার সুযোগ অবারিত হলো।
শিশুরা যিশু, শিশুরা সৃষ্টি;
তারা সেতু নয়,
মমতায় মমতায় ঝরে পড়া অনুপম বৃষ্টি।