Warning: Constant DISALLOW_FILE_MODS already defined in /home/draminb1/public_html/wp-config.php on line 102

Warning: Constant DISALLOW_FILE_EDIT already defined in /home/draminb1/public_html/wp-config.php on line 103
সন্মিত্রা : এক মলাটে সন্মিত্রা: সন্মিত্রা সম্পূর্ণ উপন্যাস : প্রথম থেকে শেষ পর্ব – Page 62 – Dr. Mohammed Amin

সন্মিত্রা : এক মলাটে সন্মিত্রা: সন্মিত্রা সম্পূর্ণ উপন্যাস : প্রথম থেকে শেষ পর্ব

সন্মিত্রা: দ্বাষষ্টিমত (৬২) পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন

আকাশে কালো মেঘ। নিচে বিজলি বাতির নিবিড় ঘন আলো। নীরবতার মাঝেও অন্ধকারের সরবতা রোমাঞ্চকর অনুভূতি নিয়ে ঘিরে রেখেছে চারদিক। জানালার বন্ধ কাচ দিয়ে পাতার ফড়িং নৃত্যে বোঝা যাচ্ছে বাইরে হালকা বাতাস চলছে। এমন আবহাওয়া বৃষ্টির লক্ষণ।
আমরা বিছানায় শুয়ে গল্পে মগ্ন। এমন ঘুমোট ভাব বাংলার আষাঢ়ের মতো। অক্সফোর্ডের পরিবেশ আষাঢ়ে গল্পের অনুকূল নয়। তবু বাঙালি যেখানে যায় সেখানে আষাঢ় নিয়ে যায়। নিয়ে যায় আষাঢ়ে গল্পের সমূহ উপকরণ।
টুটুল চলে গেছে ক্যামব্রিজ। আল্পনা আরও কয়েকদিন থাকবে। কল্পনা তো যাবেই না আমি না-যাওয়া অবধি। তাহসিনকে কল্পনার অজান্তে সন্তানের মুখ দেখানো হয়েছে। প্রতিদিন এসে লুকিয়ে ছেলেকে আদর করে যায়। সহায়তা করছে প্রমিতা। মেয়েটি খুব পরোপকারী। শিশু আসার পর থেকে কল্পনার অনুরোধে প্রমিতা রচনার বাসায় থাকছে। জানি না কল্পনা তার শিশুকে নিয়ে আমাদের লুকোচুরি বুঝতে পেরেছে কি না। কিংবা বুঝতে পেরেও না-পারার ভানে চুপ করে থাকে কি না। যদিও কল্পনার স্বভাবে কোনো লুকোচুরি নেই। তবু এটি ভালোবাসার বিষয়। ভালোবাসায় অসম্ভব বলে কিছু নেই।
সারাদিনের ক্লান্ত কল্পনা ঘুমিয়ে পড়েছে।
শিশুটি তার বুকে।
শিশুকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে আসার পর রচনা, আল্পনা, কল্পনা, টুটুল এবং আমি— এ কদিন একই রুমে ছিলাম। যদিও বাসায় আরও তিনটা শয়নকক্ষ আছে। ছোটোবেলায় এদের নিয়ে এভাবে থাকতাম। বড়ো বেলাতেও এভাবে থাকার শখ তাদের কমেনি। আমি বেড়াতে এলে এবং সবাই একত্র হলে তা আরো প্রবল আবেগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। রাজ-রোজি তাদের রুমে প্রমিতার সঙ্গে পড়ছে কিংবা বাংলা শিখছে। রাজ-রোজির রুমের পাশে অতিথিকক্ষ। সেখানে ঘুমোয় প্রমিতা।
কল্পনার শিশুটা নিয়ে ভয় হতো। শরীরের চাপে ঘুমের ঘোরে যদি আঘাত পেয়ে যায়! কিন্তু না, অভ্যস্ত মন ঘুমেও অনভ্যস্ত হয় না। বরং আরো বেশি সজাগ থাকে। শিশুটাও হয়েছে এমন— শরীরে কারও স্পর্শ না পেলে কেঁদে ওঠে। বিশেষ করে আমার শরীর। যেন আমার গায়ে লেগে থাকার জন্য জন্ম নিয়েছে। সৃষ্টির তাল লয় আর যোগসূত্র প্রকৃতির মতোই অবিরল।
কল্পনা-আল্পনা এবং টুটুল না এলে রচনার বাসা ফাঁকাই থাকে সারা বছর। টুটুল থাকে ক্যামব্রিজ, আল্পনা স্কটল্যান্ড, কল্পনার বাসাও আলাদা। তবে সে আসে, কিন্তু কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ায় ক্রমশ আসা-যাওয়ার হারটা কমে যাচ্ছে। মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্কের দূরত্বও বেড়ে যায়। ভাই হয়ে যায় ভাইভাই।
রচনার বাসায় বলতে গেলে, রাজ আর রোজি ছাড়া কেউ নেই। কিছুদিন পর তারা আরও বড়ো হবে। হয়তো পড়ার জন্য অন্য কোথাও চলে যাবে, রচনা তখন আরো একা হয়ে যাবে। নিনি এখন রাতে হামিদের সঙ্গে মূল বাসা লাগোয়া ড্রাইভার কোয়ার্টারসে থাকে। ড্রাইভারের কোয়ার্টারস বলা হলেও বেশ বড়ো। রচনা তাকে জমকালোভাবে সাজিয়ে দিয়েছে।
বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। গভীর রাতের বৃষ্টি জেগে জেগে উপভোগ করার তৃপ্তিতে নিশিবিলাসের দুর্দান্ত আবেগ বৃষ্টির চেয়েও আর্দ্র থাকে। শরীরটা মনের ভেতর পুরো ঢুকে বায়বীয় যায়। তারপর হারিয়ে যায় অচেনা কোথাও।
স্যার, এটি বাসা নয়, রচনা উদাস গলায় বলল।
কী?
কৃষ্ণবিবর। আপনি এলে আমার কৃষ্ণবিবর আলোয় আলোয় ভরে যায়। রসস্নিগ্ধ রম্যতায় বৃষ্টি হয়ে যায় আমার অনুভূতি। আপনি ছাড়া এত বড়ো বাসা এত বড়ো পৃথিবী কোথাও আমার আমাকে জানার এবং জানানোর কেউ নেই।
বৃষ্টিটা আর একটু জোর নিল। মনে হলো রচনার আর্দ্র ভাবনাকে জলমগ্ন করে দেওয়ার প্রয়াস। যুক্তরাজ্যের বৃষ্টি বাংলাদেশি আমার জন্য বিরক্তিকর। রচনা উঠে বৈদ্যুতিক আলো নিভিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিল। মনে মনে আমি এটাই চাইছিলাম। সে আমার মনের কথা বুঝতে পারে অবিকল।
জানালাটা খুলি?
কেন?
বৃষ্টির জলে হাতটা ভিজিয়ে নেব। ফোঁটা ফোঁটা জলে ঢলে পড়া অনুভূতির শীতল উষ্ণতা নিয়ে মেখে দেব আপনার গালে আর কপোলে।
রচনা বৃষ্টিতে হাত ভেজানোর জন্য উঠে গেল। আমি যদি বৃষ্টি হতাম সে আমাতে হাত ভেজাত। তারপর আমাতে মেখে দিত মমতার জলস্পর্শিত শীতলতা। আমি শিহরিত চঞ্চলতায় কেঁপে উঠতাম আনমনে।
“ভাব্বা, দেখুন” বলে চিৎকার দিয়ে উঠল রচনা।
কী?
বাইরের আকাশে বৃষ্টির ছটা, তাতে কী মোহনীয় দৃশ্য। দেখুন-না।
কী দেখব?
আপনাকে। আপনি আমার আকাশ, যে আকাশ বিশাল হলেও আমি ছাড়া কেউ উড়তে পারে না। আপনি আমার বৃষ্টি। যার ফোঁটা অগণিত হলেও আমি ছাড়া আর কারও গায়ে পড়ে না, শিহরন দিতে পারে না। কিন্তু ভাব্বা, আপনার আর আমার দূরত্ব এক তারা থেকে অপর তারার দূরত্বের চেয়ে বেশি।
কিন্তু তোমার আমার নিভৃত অনুভব ব্যক্তির মন আর হৃদয়ের মতো নিবিড়। হৃদয়ের গতিবেগ আলোর চেয়ে বেশি। সুতরাং, ভালোবাসা জীবন্ত থাকলে শারীরিক দূরত্ব নৈকট্য লাভের কোনো প্রতিকূল ফ্যাক্টর নয়।
আসুন স্যার, বাইরের বৃষ্টিতে গিয়ে ভিজি। ভাব্বা, আসুন-না।
আমি বললাম,
“এ বৃষ্টি বৃষ্টি নয়, হাফিজের মদমত্ত ঝরনা।
সবকটি ফোঁটা আপনের আপন একটিও পর-না।
সোনা আমার, তুমি কি জান না তা!”
তাহলে বৃষ্টি হাতে জড়িয়ে ধরে একটা চুমো দিই? রচনা বলল।
এই কাজটা কী তুমি কখনো অনুমতি নিয়ে করেছ?
অনুমতি নিতে হবে কেন? আসুন-না, বারান্দায় গিয়ে বৃষ্টির ফোঁটা গুনি।
চলো এবং গোনো।
“গুনতে গেলে শুধু আপনাকে গুনি”, বিষণ্ন রচনা বলল, “ভাব্বা আমার-না মাঝে মাঝে নিজেকে খুব একা মনে হয়।”
তুমি একটা বিয়ে করে ফেল? বারান্দায় রাখা বিশাল সোফায় রচনার পাশে বসে বিদ্যুতের আলো ছুুঁয়ে গলে পড়া বৃষ্টির ফোঁটার দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে দিলাম আকস্মিক। বলার পরই বুঝলাম, একদম কূপমণ্ডূকের মতো কাজ করেছি। বোঝামাত্র লজ্জায় ঘেমে উঠতে থাকে বুক-মুখ এবং মাথা-সহ সারা শরীর।
“সরি” বলতে যাওয়ার আগে রচনা বলে উঠল, ছি!
এই প্রথম রচনা আমাকে স্পষ্ট ভাষায় ধিক্কার দিল। আমি বুঝতে পারলাম, তার সঙ্গে আমি এই প্রথম ধিক্কারজনক কাজ করেছি। ‘সরি’ বলে আর কোনো লাভ হবে না। ঘেমে গিয়ে অসহায় চোখে তার দিকে তাকালাম। তার চোখ বেদনায় টলমল। বাইরের সব বৃষ্টি বুঝি জড়ো হয়ে গেল তার চোখে। আমি লজ্জায় হীন, বিবেচনায় দীন হয়ে গেলাম।
চোখমুখ বুজে বললাম, সরি।
ভাব্বা, যে পথ নিয়ে আমি কোনোদিন ভাবিনি, যে পথের অস্তিত্বই আমার জানা ছিল না, সেই পথটাই আমি আপনার মাঝে দেখলাম। আমার বসন্ত আপনাকে ঘিরে নাচে। আর আমার বর্ষা আপনার চোখে বৃষ্টি হয়ে ঝরে। আমার আলো আপনার দৃষ্টি হতে বাহিত। আমার সুঘ্রাণ আপনার ঘামের নির্যাস। আপনার মলে আমি কোনো দুর্গন্ধ পাই না। মনে হয় নিজের মল। আপনি বলছেন আমি অন্যের হয়ে যেতে! ছি!
“সোনা”, আমি ডাকলাম, “ ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা করে দিও।”
রচনা ক্ষমার কথা কিছু বলল না। চোখে বাইরের চেয়েও প্রবল বৃষ্টির ঝাপটা এঁকে অবোধ শিশুর মতো আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল, ভাব্বা, আই লাভ ইউ।