শেষ পর্ব
আমি বারান্দার সোফায় খাড়া ডান-হাতের মেলে ধরা পাতায় মাথা রেখে গৌতম বুদ্ধ ভঙ্গিতে শুয়ে। বৃষ্টি এখনো থামেনি। রচনা উদাস। সে আমার গা ঘেষে বসে। তার অবসন্ন চোখের আলো আমার ওপর প্রতিফলিত হয়ে জানালা ছিঁড়ে আকাশের এধার-ওধার আলোকিত করার প্রত্যয়ে লড়ছে। এভাবে একটা খুদে আলোর বিন্দু ধীরে ধীরে ধরিত্রী হয়ে যায়।
আমি তার চোখ-মুখ আর কপাল-কপোলে হাত বোলাতে বোলাতে বললাম, সরি। তোমার কষ্ট দেখে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।
বাবারা এমনই হয়।
আমার কথায় তুমি কষ্ট পেয়েছ?
উত্তর দেওয়ার আগে কল্পনার গলা ভেসে এল, ভাব্বা, আমাকে একা রেখে এখানে চলে এসেছেন? বুঝেছি, শিশুটি আমাদের মাঝে দেওয়াল তুলে দিয়েছে। আপু আমাকে বসতে দাও।
বোসো।
কল্পনা বসতে বসতে বলল, ভাব্বা, আপনি কী কষ্টের কথা বলেছেন?
কিছু একটা তো বলেছি।
“ভাব্বা”, কল্পনা বলল, “আপনি আমাদের ঈশ্বর। আপুর কাছে তার চেয়ে বড়ো। আপু কোনোদিন বুঝতে দেইনি, আমরা তার সৎবোন, আপনি কোনোদিন বুঝতে দেননি, আপনি আমাদের বাবা নন। সবচেয়ে বড়ো কথাÑ আপু আপনাকে কোনোদিন বুঝতেই দেয়নি যে, আপনি তার জীবনে কত বেশি প্রয়োজন। কত বেশি অনিবার্য। আপু খুব একা। ”
“যার জীবনে একাকিত্ব নেই সেটি জীবন নয়,” রচনা বলল, “এই জীবন ঈশ্বরের দান। তাই একাকিত্বের দায় ঈশ্বরের।”
কল্পনা বলল, ভাব্বাই আমাদের ঈশ্বর।
“তাহলে”, রচনা বলল, “আমার একাকিত্বের জন্য আমি আমার ঈশ্বর ছাড়া আর কাউকে দায়ী করতে পারি না। কিন্তু ঈশ্বরকে দায়ী করা কি উচিত হবে?”
“আমি জানি না, জানি না”, বলে তার চুলে বিলি কাটতে শুরু করি।
কথার মাঝে কেঁদে উঠল কল্পনার শিশু, খিদে পেয়েছে, খাওয়াতে হবে।
যাও।
কল্পনা ভেতরে চলে গেল।
“কারও প্রতি ভালোবাসা যদি আপনার সর্বজনীন ভালোবাসাকে আহত করে তাহলে ওই ভালোবাসা ভালোবাসা নয়।”, রচনা বলল, “স্যার, এটি ভালোবাসার চেয়ে অধিক কিছু। আমি তার পুজোয় আনত। তাকেই আমার সর্বাঙ্গীন কল্যাণের প্রতিভূ মনে হয়। তাই সে ছাড়া আমার অঙ্গে অঙ্গীভূত হওয়ার অধিকার আমি আর কাউকে দিতে পারি না।”
সে কে?
আপনি। আপনি সব করেছেন।
আমি কী করলাম?
কিছুই করেননি, শুধু আমাদের ভালোবেসে এমন একটি অনড় বিশ্বাস দিয়েছেন, যাতে আমি আপনি ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো কিছু দেখার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছি। ভাব্বা, আমাকে একটা চোখ দিন, যাতে আপনি ছাড়াও আমি আর কাউকে দেখতে পাই। আপন করে নিতে পারি আমার গভীর মনে।
রচনার গলায় ভাব্বা ডাকটা আমার অসাধারণ মমতামাখা মনে হয়। তার কথায় আমার লজ্জায় যোগ হলো কষ্ট। আমার চোখের ভেতর বান ডেকেছে জলের, কিন্তু ওপরে তার আভাস মাত্র নেই। নিজেকে এভাবে আমি লুকিয়ে রাখি, রাখতে পারি কষ্ট হলেও।
আমি যা করেছি তা তোমাদের আলোকিত করার জন্য।
আপনি আমাদের চাঁদ বানিয়ে আকাশে তুলে দিয়েছেন। এতদিন ভেবেছিলাম কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। এখন বুঝতে পারছি, আপনার উদ্দেশ্য ছিল।
কী উদ্দেশ্য? চমকে উঠে প্রশ্ন করলাম।
নিচে বসে জোছনা উপভোগ করা। সারাদিন পরিশ্রম করে রাতে যখন ঘরে আসি তখন দেখি কেউ নেই। শুধু আপনার কথাই মনে পড়ে। আপনাকে পাশে পাওয়ার ইচ্ছা প্রবল হয়ে ওঠে। আমার স্মৃতিতে বস্তি আর আপনি মাঝখানে কিছু নেই। ভাব্বা, জোছনা তো ছোঁয়া যায় না। ফুল কি তার সৌন্দর্য দেখে?
আমি কী তাহলে কোনো ভুল করেছি?
আপনি না এলে আমাদের জীবন সেই বস্তিতেই পড়ে থাকত।
আমি তা মনে করি না। যোগ্যতাই তোমাকে এখানে এনেছে।
এটি আপনার উদারতামাখা অভিমানের কথা। আমি আপনাকে অনেক আঘাত দিয়ে ফেলেছি। কিন্তু, আপনি যখন আমাকে বিয়ে করতে বলেন, তখন আমি খুশিতে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
তাহলে?
যখন দেখি, সে আমার প্রত্যাশিত জন নয়, তখন ভীষণ হিংস্র হয়ে উঠি। এজন্য ম্যামকে আমার পছন্দের একজন।
আমি?
আপনি আমাদের ঈশ্বর।
আমি ঈশ্বর হতে চাই না। আমি মানুষ হয়ে থাকতে চাই। রক্তমাংসের মানুষ। কোনো অবতার নয়, এমন একজন সাধারণ মানুষ যার পাপ করার ইচ্ছা পুণ্যের চেয়ে প্রবল থাকে।
“কিন্তু ঈশ্বরকে কীভাবে মানুষ করব?” রচনা বলল, “আপনি কি সে সুযোগ অক্ষত রেখেছেন? আপনি আপনার বিবেচনায় সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা হারকিউলিসের মতো আমাদের কল্যাণের জন্য সবকিছু বিসর্জন দিয়ে আমাদের এত লোভী করে দিয়েছেন যে, আপনাকেও পাওয়ার ইচ্ছা অনড় হয়ে গেছে। কিন্তু আমি আপনার কে? আমার আর ম্যামে তফাত কী?”
তুমি আমার আকাশের তারা। ঋধিতা আমার ঘরের প্রদীপ। তুমি স্নিগ্ধ, তাই অশেষ। ঋধিতা তপ্ত তাই খুব সাবধানে নড়াচড়া করতে হয়। তুমি অসীম, তোমার শক্তি-চেতনার উৎস সূর্য। সে সসীম তার শক্তি-চেতনার উৎস সলতে, সামাজিক রীতিই যার তৈল। তোমার জ্বালানি প্রকৃতি।
আপনি যেমন ঈশ্বর হতে চান না, আমি তেমন চাই না তারা হতে। আমি মাটির প্রদীপ হতে চাই। সূর্য নয়, সলতেই হোক আমার আলোর উৎস। যা কেবল আপনার আশপাশ আলোকিত করার ক্ষমতা রাখে। প্রতিমুহূর্তে নিভে যাবার শঙ্কায় শঙ্কিত থাকে। ভাব্বা, জীবের প্রতি প্রকৃতির সবচেযে বড়ো উপহার কী জানেন? মৃত্যু।
তুমি যেমন আলোকোজ্জ্বল তাতে কোনো সলতের সাধ্য নেই তোমাকে উজ্জ্বল রাখার। তাই খুব ভেবেচিন্তে তোমাকে আমার তারা করেছি। যাতে কেউ তোমাকে ঢেকে রাখতে না-পারে। যখন আমার প্রয়োজন হবে তখনই ক্ষুদ্র বাঁধন ছেড়ে তোমার স্নিগ্ধ জোছনায় অবগাহনের জন্য চলে আসি এবং আসব বারবার বাধাহীন উচ্ছ্বাসে সুনামির মতো। তুমি আমার প্রকৃতি। যখন ইচ্ছে চলে আসব যেমন আকাশে মেঘ আসে, সূর্য আসে দিন হয়ে, বসন্ত এবং বৃষ্টি আসে জীবনের ঝংকারে; ঋতুর দ্যোতনায় আসে নতুন দিনের নতুন স্বপ্ন।
ম্যাম?
তার স্মৃতিতে এখন আমি ঝাপসা চোখের অকেজো পটল।
আপনার সন্তান?
তাদের কাছে আমি ফলহীন বৃক্ষ। কেটে জ্বালানি কাঠে পরিণত করার অপেক্ষায়।
আপনার দেশ?
মৃত হস্তী। এখন বাকি থাকে কেবল তুমি। তুমিই কেবল আমার মাঝে সম্পূর্ণ সমর্পিত এই পৃথিবীর একমাত্র বিষয়। আমি আর কোথাও যাব না । তোমার সঙ্গেই থাকব। যাওয়ার জায়গাই বা কোথায়? আমি তো তোমাদের ছাড়া আর কিছু করতে পারিনি।
আমি যদি তাড়িয়ে দিই?
সোনা, ঈশ্বরকে কেউ তাড়িয়ে দিতে পারে না। ঈশ্বরই কেবল এ ক্ষমতা রাখে।
ভাব্বা, ঈশ্বরও পারে না তার সৃষ্টি থেকে দূরে থাকতে।
সমাপ্ত
— — — — — — — — — — — — — — — — —√— — — — — — — — — — — — — — — — —√
অভিধান ও বাংলা বানানবিধি লিংক
বাংলা অভিধান ও বাংলা বানানবিধির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ লিংক এখানে দেওয়া হলো। নিচের লিংকসমূহে ক্লিক করলে বাংলা একাডেমির সর্বশেষ সংশোধন করা বাংলা বানানসমূহ পাওয়া যাবে। জানা যাবে বাংলা একাডেমি কেন এবং কোন বিধানের বলে কীভাবে বানানগুলো সংশোধন করেছে।