সন্মিত্রা: সপ্তম পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
বস্তির অনতিদূরে সুন্দর একটা জায়গায় ড্রয়িং ও ডাইনিং বাদে তিন বেডরুমের বিশাল একটি বাসা ভাড়া করেছে অমল। বাসা না বলে প্রাসাদ বলাই যুক্তিযুক্ত। চারদিক উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। সদর দরজায় দারোয়ান। যথেষ্ট নিরাপদ। সামনে ফুলের বাগান, পেছনে ফলের। যারপরনাই সুন্দর। সদর গেট থেকে কয়েকশ গজ আসার পর রিসেপশন রুম। তার সামনে বিশ্বখ্যাত কয়েকজন মৃত মনীষীর ভাস্কর্য। বেশ অভিজাত।
কেয়ারটেকার জানালেন ব্রিটিশ কাউন্সিল এবং লন্ডন হাইকমিশনার অফিস থেকে কয়েকজন লোক রিশেপসন রুমে অপেক্ষা করছেন।“ স্যার, আপনারা এগিয়ে যান”, বলে রচনা তাদের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য রিশেপসন রুমে ঢুকে গেল।
আমরা কেয়ারটেকারের সহায়তায় হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ি বাসায়। রচনার অনুপস্থিতির ফাঁকে হাতমুখ ধুয়ে প্রতিটা রুম একনজর দেখে নিলাম। তারপর রচনার অপেক্ষায় ড্রয়িংরুমে গল্পে মেতে উঠি। চা-নাস্তা এল। কয়েক মিনিটের মধ্যে পঞ্চকন্যা সত্যি সত্যি কন্যার মতো অকপট হয়ে গেল। বয়স, দেশ, ধর্ম আর পরিচিতি-অপরিচিতির ব্যবধান একাকার হয়ে গেল আড্ডায়। আড্ডা ছাড়া এমন শক্তি আর কার আছে!
সবগুলো রুম বেশ বড়োসড়ো— দামি আর অভিজাত আসবাবপত্রে সাজানো। একই সঙ্গে গোছানো। দেখলে বোঝা যায় মালিক অভিজাত, বিত্তবান এবং বনেদি। ভদ্রলোক সপরিবারে সুইডেন থাকেন। দেশে এলে এ বাসায় উঠেন। ভাড়া দেন না, খালি পড়ে থাকে। অমলের অনুরোধে ভাড়া দিতে রাজি হয়েছেন— অক্সফোর্ডের অধ্যাপক শুনে। পাঁচ দিন থাকলেও ভাড়া দিতে হবে এক মাসের।
তিন বেডরুমের একটায় রচনা আর আমি এবং বাকি দুটোয় মেয়েরা থাকবে। কেয়ারটেকার দেখিয়ে দিয়েছেন আমাদের রুম। অমলের প্রশংসা করতেই হয়। যদিও বাড়িটার জন্য হাতির পায়ের মতো মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করতে হয়েছে। তবে ওই টাকা রচনার পাউন্ডে গেলে বকের পায়ের মতো চিকন হয়ে যায়। থাক এসব। বড়োদের খরচে ছোটোদের নাক গলিয়ে কাজ নেই। মেয়েরা তাদের আবাস দেখে বেশ খুশি— এটাই আমার জন্য যথেষ্ট।
এক ঘণ্টা পর রচনা ফিরে এল। মেয়েরা তাকে ঘিরে রীতিমতো নৃত্য দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল। রচনা যেন পুরো অক্সফোর্ড। মানবীর ছদ্মবেশে কলকাতায় এসেছেন। এত খ্যাত প্রতিষ্ঠানের কোনো প্রফেসর তাদের এত কাছে, তাও আবার মেয়ে এবং বাঙালি— মুগ্ধতার শেষ নেই। এমন ঘটনা জীবনে এই প্রথম, হয়তো বা এই শেষ।
“বেশ বড়ো রুম”, মিশু বলল, “আমাদের পাঁচ জনের জন্য একটা হলেও চলত।”
“বেশ বড়ো রুম”, মিশু বলল, “আমাদের পাঁচ জনের জন্য একটা হলেও চলত।”
“দুটো আছে যখন দুটোই ব্যবহার করো”, রচনা বলল, “যদি মনে করো একসঙ্গে থাকবে, সেটি তোমাদের ইচ্ছা, যদি হয় সুজন বরই পাতায় ন-জন। বাসা কিন্তু শুধু শরীর রাখার জন্য নয়, মনের প্রশান্তি অনেক বড়ো বিষয়।”
সবাই গোল হয়ে বৃত্ত। আমি আর রচনা বৃত্তের কেন্দ্র। এমন গোল-কায়দার বসার বুদ্ধিটা প্রমিতার। মেয়েগুলো আসলেই চমৎকার। চোখ-মুখ, চুল-গাল, নাক-কান, গলা-থুতনি এমনকি কানের লতি পর্যন্ত সুন্দরে সুন্দরে মার্জিত অবকাশ। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পাঁচ জনকে ঝাঁকিদর্শনে কেবল দেখছি আর দেখছি।
“শোনো মেয়েরা”, রচনা বলল, “আমি একসময় বস্তিতে থাকতাম। আমাদের রুমটা এত ছোটো ছিল যে, ছয় জন সদস্য একসঙ্গে ঘুমাতে গেলে কোনো রকমে পিঠটা কেবল রাখতে পরাতম। ওপরে ছিল মশা; নিচে তেলাপোকা আর পিঁপড়ে। কেঁচোও ছিল সুড়সুড়ি দিত বগলে। চুলকানোর জন্য হাতটা পর্যন্ত বের করতে কষ্ট হতো। তবু জীবন থেমে থাকেনি।”
পঞ্চকন্যার একজন রেবেকা। বাড়ি কাশ্মীর, বাংলা বলতে পারে না। তবে ইংরেজিতে সাবলীল। গড়নে অন্যদের চেয়ে সামান্য চিকন হলেও শক্তিতে যে কম নয়, তা একবার তাকালে বোঝা যায়। চোখের নিচে চঞ্চলতার মাঝে প্রচণ্ড সতর্কতা। দেখলে ভয় হয়— বুঝি ইসরাইলি সেনাবাহিনীর নারী-সদস্য আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অক্সফোর্ড নিয়ে তার আগ্রহই সবচেয়ে বেশি, কিন্তু যেমন আগ্রহী তেমন আন্তরিক মনে হলো না।
“আমাকে কী করতে হবে ম্যাম”, রেবেকা বলল, “যদি অক্সফোর্ডে পড়তে চাই?
মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করতে হবে। স্টার কিংবা এ-প্লাস অত্যাবশ্যক নয়। এগুলো অতিরিক্ত সুবিধার বিষয়ও নয়। গতকাল তোমার কটি হাত ছিল, কেমন ছিল চোখের শক্তি তা দেখা হয় না, দেখা হয় এ মুহূর্তে তোমার কয়টি হাত আছে, চোখে কেমন দেখতে পাও। তারপর তুমি কোন বিষয় নিয়ে পড়তে চাও এবং কী পড়তে চাও তা বিস্তারিত জানিয়ে আবেদন করবে। তোমার ইংলিশ দক্ষতা যাচাই করা হবে। এটাই ভর্তির অন্যতম শর্ত। ব্রিটিশ কাউন্সিলের নেওয়া ইংরেজি ভাষা জ্ঞান পরীক্ষায় ভালো করতে পারলে ভর্তি হতে পারবে। একটা বিষয় মনে রাখবে, অক্সফোর্ডের টিউশন ফি অনেক বেশি।
কত হতে পারে ম্যাম? প্রমিতা বলল।
ত্রিশ লাখ টাকার বেশি। ফুল স্কলারশিপ পেলে টিউশন ফি দিতে হবে না। তবে অক্সফোর্ডে এমন স্কলারশিপ পাওয়া সহজ বিষয় নয়।
প্রমিতা বলল, কমনওয়েলথভুক্ত দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো সুবিধা নেই?
“না”, রচনা বলল, “অথচ তারা আমাদের টাকা দিয়ে তাদের দেশকে সমৃদ্ধ করেছে। অক্সব্রিজকে সাজিয়েছে। ব্রিটেনের প্রতিটি ইঞ্চি ভারতবর্ষের সম্পদে পুষ্ট। ইংল্যান্ডের প্রতিটি কণা উপমহাদেশ এবং প্রাক্তন কলোনিসমূহের অর্থে লালিত। তবু আমরা তাদের প্রভু মানি। অথচ তারা আমাদের খেয়েপড়ে নাদুস-নুদুস। আমাদের দেশে এলে মনে করি, প্রভু এসেছে।”
আমি বললাম, এই যেমন তুমি।
রচনা বলল, “আমরা জীবিত যোগ্যকে মূল্যায়ন করি না। মরার পর লাশ নিয়ে টানাটানি করি। তাই প্রতিভাবানরা দেশে থাকতে চায় না। বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম বাংলাদেশকে বিজ্ঞানী উপহার দেওয়ার ব্রত নিয়ে ক্যামব্রিজ ছেড়ে বাংলাদেশ চলে এসেছিলেন। কী পেয়েছেন? জাস্ট কিছু অপমান।”
ঠিক বলেছ মেয়ে। বাঙালিদের চিত্তবৈকল্য মারাত্মক। তাদের দেশপ্রেম খুব কম। কিন্তু ষড়যন্ত্রে ওস্তাদ, পরশ্রীকাতরতায় অন্ধ। আপন ভাই মহাশয়, এ জ্বালা কী প্রাণে সয়!
প্রমিতা বলল, ভারতীয় হিসেবে আমার ঘৃণার নব্বই ভাগ ইংরেজ শাসনের প্রতি এবং দশ ভাগ মুসলিম শাসনের প্রতি।
রেবেকা বলল, মুসলিমদের প্রতি কেন?
মুসলিমদের প্রতি নয়, তাদের শাসনব্যবস্থার প্রতি। তাদের শাসনব্যবস্থা ছিল অদূরদর্শিতায় ভরা। নইলে প্রায় হাজার বছর শাসন করার পরও অল্প সময়ের মধ্যে ভারতবর্ষে মুসলিমরা এত প্রভাবহীন হয়ে যাবে কেন? বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও তাদের কোনো কার্যকর প্রভাব নেই। আছে?
প্রমিতাকে বললাম, যদি তুমি বাংলাদেশি হতে?
তা হলে আমার ঘৃণার আশি ভাগ ইংরেজদের প্রতি, দশ ভাগ মুসলিম শাসনের প্রতি এবং দশ ভাগ পাকিস্তানিদের প্রতি নিক্ষিপ্ত হতো।
পাকিস্তানিদের প্রতি এত কম ঘৃণার কারণ? মিশু জানতে চাইল।
রচনা বলল, ইংরেজরাই আমাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। পাকিস্তানিদের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি। তবু আমরা অনেকে এখনও ইংরেজদের প্রতি যত ঘৃণা নিক্ষিপ্ত করা প্রয়োজন তত ঘৃণা নিক্ষেপ করি না। পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেনি। বাঙালিরাই তাঁকে হত্যা করেছে। পাকিস্তান কয় বছর বাংলাদেশ শাসন করেছে? আমি মনে করি, এত কিছুর পরও আমাদের লন্ডনপ্রেম ভারতীয়দের চৈত্তিক দুর্বলতার একটি লজ্জাকর ও অবিবেচক দিক।
রেবেকা বলল, ম্যাম, একটা কথা বলি— কিছু মনে করবেন না তো?
বলো।
আমার অক্সফোর্ডে পড়ার খুব ইচ্ছা।
ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। তবে ইচ্ছাটা হতে হবে অধ্যবসায়প্রসূত চেষ্টায় গড়া পরিষ্কার পাথরস্থির প্রত্যয়।
হয়তো দরখাস্ত দিলে ভর্তি হতে পারব, কিন্তু বাবার অত টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই। আপনি কি ম্যাম আমার জন্য একটা স্কলারশিপের ব্যবস্থা করতে পারবেন?
তুমি অ্যাপ্লাই করে আমাকে জানাবে। আমি চেষ্টা করব।
“মিশু?” প্রমিতা বলল, “তোমার অক্সফোর্ডে পড়ার ইচ্ছা নেই?”
না, দিদি।
কেন?
নামটা কেমন যাঁড়-ষাঁড়। আমার জন্য আমার জয়দেবপুরই সেরা, মেরা ভারত মহান। ভারতবর্ষ কখনো কাউকে লুণ্ঠন করার জন্য সমুদ্র পাড়ি দেয়নি। যদি করত তাহলে পুরো ইউরোপ ভারতবর্ষের অধীনে থাকত। করবে কেন? আমরা ভারতবাসী কখনো ইংরেজদের মতো হাভাতে ছিলাম না।
খুব মজা নিয়ে গল্প এগিয়ে যাচ্ছিল। আসলে, মানব মনে গল্প ছাড়া অন্য কোনো কিছু এত দিশেহারা শান্তি দিতে পারে না। সবকিছু ভুলিয়ে দেয় অতলে। আর গাল্পিকদের মধ্যে যদি এমন পঞ্চকন্যা থাকে তাহলে তো কথাই নেই। আমি যেন মুগ্ধতায় ভাসছিলাম কলম্বাসের জাহাজ— নিনা, সান্তা মারিয়া আর পিন্টার মতো উদ্বেগহীন নিরুদ্দেশে।
গল্পের মাঝে দাঁড়ি টানল অমল— ম্যাম, ডিনার নিয়ে এসেছি। ডাইনিং রেডি।
মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। প্রমিতা তার বিশালাকার লাগেজ থেকে চকচকে কাগজে মোড়া একটি উপহার মোড়ক বের করে রচনার সামনে এগিয়ে দিলেন।
সবাই গোল হয়ে বৃত্ত। আমি আর রচনা বৃত্তের কেন্দ্র। এমন গোল-কায়দার বসার বুদ্ধিটা প্রমিতার। মেয়েগুলো আসলেই চমৎকার। চোখ-মুখ, চুল-গাল, নাক-কান, গলা-থুতনি এমনকি কানের লতি পর্যন্ত সুন্দরে সুন্দরে মার্জিত অবকাশ। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পাঁচ জনকে ঝাঁকিদর্শনে কেবল দেখছি আর দেখছি।
“শোনো মেয়েরা”, রচনা বলল, “আমি একসময় বস্তিতে থাকতাম। আমাদের রুমটা এত ছোটো ছিল যে, ছয় জন সদস্য একসঙ্গে ঘুমাতে গেলে কোনো রকমে পিঠটা কেবল রাখতে পরাতম। ওপরে ছিল মশা; নিচে তেলাপোকা আর পিঁপড়ে। কেঁচোও ছিল সুড়সুড়ি দিত বগলে। চুলকানোর জন্য হাতটা পর্যন্ত বের করতে কষ্ট হতো। তবু জীবন থেমে থাকেনি।”
পঞ্চকন্যার একজন রেবেকা। বাড়ি কাশ্মীর, বাংলা বলতে পারে না। তবে ইংরেজিতে সাবলীল। গড়নে অন্যদের চেয়ে সামান্য চিকন হলেও শক্তিতে যে কম নয়, তা একবার তাকালে বোঝা যায়। চোখের নিচে চঞ্চলতার মাঝে প্রচণ্ড সতর্কতা। দেখলে ভয় হয়— বুঝি ইসরাইলি সেনাবাহিনীর নারী-সদস্য আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অক্সফোর্ড নিয়ে তার আগ্রহই সবচেয়ে বেশি, কিন্তু যেমন আগ্রহী তেমন আন্তরিক মনে হলো না।
“আমাকে কী করতে হবে ম্যাম”, রেবেকা বলল, “যদি অক্সফোর্ডে পড়তে চাই?
মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করতে হবে। স্টার কিংবা এ-প্লাস অত্যাবশ্যক নয়। এগুলো অতিরিক্ত সুবিধার বিষয়ও নয়। গতকাল তোমার কটি হাত ছিল, কেমন ছিল চোখের শক্তি তা দেখা হয় না, দেখা হয় এ মুহূর্তে তোমার কয়টি হাত আছে, চোখে কেমন দেখতে পাও। তারপর তুমি কোন বিষয় নিয়ে পড়তে চাও এবং কী পড়তে চাও তা বিস্তারিত জানিয়ে আবেদন করবে। তোমার ইংলিশ দক্ষতা যাচাই করা হবে। এটাই ভর্তির অন্যতম শর্ত। ব্রিটিশ কাউন্সিলের নেওয়া ইংরেজি ভাষা জ্ঞান পরীক্ষায় ভালো করতে পারলে ভর্তি হতে পারবে। একটা বিষয় মনে রাখবে, অক্সফোর্ডের টিউশন ফি অনেক বেশি।
কত হতে পারে ম্যাম? প্রমিতা বলল।
ত্রিশ লাখ টাকার বেশি। ফুল স্কলারশিপ পেলে টিউশন ফি দিতে হবে না। তবে অক্সফোর্ডে এমন স্কলারশিপ পাওয়া সহজ বিষয় নয়।
প্রমিতা বলল, কমনওয়েলথভুক্ত দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো সুবিধা নেই?
“না”, রচনা বলল, “অথচ তারা আমাদের টাকা দিয়ে তাদের দেশকে সমৃদ্ধ করেছে। অক্সব্রিজকে সাজিয়েছে। ব্রিটেনের প্রতিটি ইঞ্চি ভারতবর্ষের সম্পদে পুষ্ট। ইংল্যান্ডের প্রতিটি কণা উপমহাদেশ এবং প্রাক্তন কলোনিসমূহের অর্থে লালিত। তবু আমরা তাদের প্রভু মানি। অথচ তারা আমাদের খেয়েপড়ে নাদুস-নুদুস। আমাদের দেশে এলে মনে করি, প্রভু এসেছে।”
আমি বললাম, এই যেমন তুমি।
রচনা বলল, “আমরা জীবিত যোগ্যকে মূল্যায়ন করি না। মরার পর লাশ নিয়ে টানাটানি করি। তাই প্রতিভাবানরা দেশে থাকতে চায় না। বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম বাংলাদেশকে বিজ্ঞানী উপহার দেওয়ার ব্রত নিয়ে ক্যামব্রিজ ছেড়ে বাংলাদেশ চলে এসেছিলেন। কী পেয়েছেন? জাস্ট কিছু অপমান।”
ঠিক বলেছ মেয়ে। বাঙালিদের চিত্তবৈকল্য মারাত্মক। তাদের দেশপ্রেম খুব কম। কিন্তু ষড়যন্ত্রে ওস্তাদ, পরশ্রীকাতরতায় অন্ধ। আপন ভাই মহাশয়, এ জ্বালা কী প্রাণে সয়!
প্রমিতা বলল, ভারতীয় হিসেবে আমার ঘৃণার নব্বই ভাগ ইংরেজ শাসনের প্রতি এবং দশ ভাগ মুসলিম শাসনের প্রতি।
রেবেকা বলল, মুসলিমদের প্রতি কেন?
মুসলিমদের প্রতি নয়, তাদের শাসনব্যবস্থার প্রতি। তাদের শাসনব্যবস্থা ছিল অদূরদর্শিতায় ভরা। নইলে প্রায় হাজার বছর শাসন করার পরও অল্প সময়ের মধ্যে ভারতবর্ষে মুসলিমরা এত প্রভাবহীন হয়ে যাবে কেন? বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও তাদের কোনো কার্যকর প্রভাব নেই। আছে?
প্রমিতাকে বললাম, যদি তুমি বাংলাদেশি হতে?
তা হলে আমার ঘৃণার আশি ভাগ ইংরেজদের প্রতি, দশ ভাগ মুসলিম শাসনের প্রতি এবং দশ ভাগ পাকিস্তানিদের প্রতি নিক্ষিপ্ত হতো।
পাকিস্তানিদের প্রতি এত কম ঘৃণার কারণ? মিশু জানতে চাইল।
রচনা বলল, ইংরেজরাই আমাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। পাকিস্তানিদের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি। তবু আমরা অনেকে এখনও ইংরেজদের প্রতি যত ঘৃণা নিক্ষিপ্ত করা প্রয়োজন তত ঘৃণা নিক্ষেপ করি না। পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেনি। বাঙালিরাই তাঁকে হত্যা করেছে। পাকিস্তান কয় বছর বাংলাদেশ শাসন করেছে? আমি মনে করি, এত কিছুর পরও আমাদের লন্ডনপ্রেম ভারতীয়দের চৈত্তিক দুর্বলতার একটি লজ্জাকর ও অবিবেচক দিক।
রেবেকা বলল, ম্যাম, একটা কথা বলি— কিছু মনে করবেন না তো?
বলো।
আমার অক্সফোর্ডে পড়ার খুব ইচ্ছা।
ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। তবে ইচ্ছাটা হতে হবে অধ্যবসায়প্রসূত চেষ্টায় গড়া পরিষ্কার পাথরস্থির প্রত্যয়।
হয়তো দরখাস্ত দিলে ভর্তি হতে পারব, কিন্তু বাবার অত টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই। আপনি কি ম্যাম আমার জন্য একটা স্কলারশিপের ব্যবস্থা করতে পারবেন?
তুমি অ্যাপ্লাই করে আমাকে জানাবে। আমি চেষ্টা করব।
“মিশু?” প্রমিতা বলল, “তোমার অক্সফোর্ডে পড়ার ইচ্ছা নেই?”
না, দিদি।
কেন?
নামটা কেমন যাঁড়-ষাঁড়। আমার জন্য আমার জয়দেবপুরই সেরা, মেরা ভারত মহান। ভারতবর্ষ কখনো কাউকে লুণ্ঠন করার জন্য সমুদ্র পাড়ি দেয়নি। যদি করত তাহলে পুরো ইউরোপ ভারতবর্ষের অধীনে থাকত। করবে কেন? আমরা ভারতবাসী কখনো ইংরেজদের মতো হাভাতে ছিলাম না।
খুব মজা নিয়ে গল্প এগিয়ে যাচ্ছিল। আসলে, মানব মনে গল্প ছাড়া অন্য কোনো কিছু এত দিশেহারা শান্তি দিতে পারে না। সবকিছু ভুলিয়ে দেয় অতলে। আর গাল্পিকদের মধ্যে যদি এমন পঞ্চকন্যা থাকে তাহলে তো কথাই নেই। আমি যেন মুগ্ধতায় ভাসছিলাম কলম্বাসের জাহাজ— নিনা, সান্তা মারিয়া আর পিন্টার মতো উদ্বেগহীন নিরুদ্দেশে।
গল্পের মাঝে দাঁড়ি টানল অমল— ম্যাম, ডিনার নিয়ে এসেছি। ডাইনিং রেডি।
মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। প্রমিতা তার বিশালাকার লাগেজ থেকে চকচকে কাগজে মোড়া একটি উপহার মোড়ক বের করে রচনার সামনে এগিয়ে দিলেন।
কী?
ম্যাম, আমাদের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি শ্রদ্ধা।
খোলো।
রচনার নির্দেশ পেয়ে প্রমিতা নিপুণ হাতে মোড়কটি খুলে ফেলল। সাবান-সহ নানা রকম প্রসাধনী ও পারফিউম। প্রায় সবগুলো রচনার প্রিয়। যথেষ্ট দামি।
এগুলো কোত্থেকে? রচনা জানতে চাইল।
দাদাভাইকে দিয়ে ফ্রান্স থেকে আনিয়েছি।
এই ব্র্যান্ডগুলো পছন্দ করার কারণ?
আপনার প্রিয়, তাই।
কে বলেছে?
আপনার সতীর্থ, আমাদের উপাচার্য স্যার।
খোলো।
রচনার নির্দেশ পেয়ে প্রমিতা নিপুণ হাতে মোড়কটি খুলে ফেলল। সাবান-সহ নানা রকম প্রসাধনী ও পারফিউম। প্রায় সবগুলো রচনার প্রিয়। যথেষ্ট দামি।
এগুলো কোত্থেকে? রচনা জানতে চাইল।
দাদাভাইকে দিয়ে ফ্রান্স থেকে আনিয়েছি।
এই ব্র্যান্ডগুলো পছন্দ করার কারণ?
আপনার প্রিয়, তাই।
কে বলেছে?
আপনার সতীর্থ, আমাদের উপাচার্য স্যার।
আর কী বলেছেন তিনি?
“এখন থাক,” আমি বললাম, “চলো, আগে খেয়ে নিই। তারপর গল্প হবে।”
“চলুন, স্যার”, রচনা আমাকে বাসার মতো আদুরে-মমতায় গভীর নিষ্ঠায় জড়িয়ে ধরে ডাইনিংরুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলল, “গার্লস ফলো মি।”
“চলুন, স্যার”, রচনা আমাকে বাসার মতো আদুরে-মমতায় গভীর নিষ্ঠায় জড়িয়ে ধরে ডাইনিংরুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলল, “গার্লস ফলো মি।”