সন্মিত্রা: অষ্টম পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
খাওয়া শেষ। অমল তার দলবল নিয়ে চলে গেছেন । আগামীকালের প্রাতঃরাশ মেয়েরাই তৈরি করবে। বড়ো শখ তাদের— রচনাকে নিজেদের হাতে রান্না করে খাওয়াবে। সবাই পোশাক পরিবর্তন করতে চলে গেল তাদের রুমে। আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরে এল এক নম্বর কক্ষে— ঘরোয়া পোশাকে। এই রুমটাই রচনা আর আমার জন্য নির্ধারিত।
পঞ্চকন্যা আগমনী পোশাক ছেড়ে নতুন সাজে আবির্ভূত। একদম বৃষ্টি ঝরঝর রুপোলি দুপুরের পাঁচ রোমান দেবী যেন। সাধারণ সাজ-পোশাকে তারা এখন অভিভূত প্রকৃতি। আমার মুগ্ধতা বিমুগ্ধতায় মিশে গেল আনমনে। এতক্ষণ তাদের আসল সৌন্দর্য রাসায়নিক প্রসাধনের আবরণে ঢাকা ছিল বলে দেখতে পারিনি। কম সাজলে মেয়েদের কত অনিন্দ্য লাগে তা যারা বুঝে তারা কখনো বেশি সাজুগুজু করে না।
ঋধিতায় সজ্জাবিতৃষ্ণা প্রবল। আমাদের বাসায় প্রসাধন সামগ্রী নেই বললেই চলে। রচনাও এমন। ঋধিতার ভাষায়, “প্রসাধন চামড়াকে কাঁটাখসখস মান্দার গাছ বানিয়ে দেয়। এ যেন চারাগাছের সবুজ পাতায় অ্যাসিড মেখে তেলতেলে করা।”
শীতাতপ চালু করে দিলেন পরিচারিকা মৌলী। বিশাল রুমে বিশাল একটা ফ্রিজ। তার পাশে কফি-মেকার। ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁই ছুঁই করছে। বাজার সরকার বাজারের ফর্দ আর টাকা নিয়ে রাতের মতো বিদায় নিলেন। কেয়ারটেকার বাসায় থাকেন। তিনি ছাড়া আরও তিন জন পুরুষ এবং দুজন মহিলা আছেন। এরা বাসার স্থায়ী কর্মচারী। মালী দারোয়ান তো আছেনই। বড়ো লোকের বড়ো কাজ।
“হাইকমিশনার অফিস থেকে পাঠানো শ্যাম্পেনের বোতলগুলো ফ্রিজে রেখেছি।” কেয়ারটেকার বললেন, “আমি কি ম্যাম একটা বোতল বের করে টেবিলে রাখব?”
“না”, রচনা বলল, “যার প্রয়োজন সে নিয়ে নেবে। মেয়েরা, তোমাদের কারও ইচ্ছা হলে নিতে পার। ভাব্বার কখন প্রয়োজন হবে তা আমি দেখব। কেয়ারটেকার সাহেব— আপনি বিশ্রামে যেতে পারেন।”
“থ্যাংক ইউ ম্যাম”, কেয়ারটেকার বললেন, “যদি প্রয়োজন হয় কলিংবেল দেবেন। মেশিনে চা-কফি দুটোই আছে।”
ধন্যবাদ। মৌলীকে বলুন—চা দিতে।
এবার গোল হয়ে নয়, ইচ্ছেমতো ঢঙে ইচ্ছেমতো জায়গায় বসা। আমার ডান পাশে রচনা। বামপাশে প্রমিতা, প্রমিতার পাশে মিশু। রচনার বাম পাশে রেবেকা, জগদ্গৌরী এবং দীপালী। এ আমাদের পঞ্চকন্যা।
গল্পে গল্পে সবার কথা শোনা হলো। মিশু বাংলার এবং প্রমিতা সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্রী। রেবেকা ইংরেজি ভাষার এবং দীপালী ও জগদ্গৌরী অর্থনীতির ছাত্রী। সবাই বৃত্তিধারী। জগদ্গৌরী রাতে কেবল সবজি খেয়েছে। সে জৈন, আমার প্রিয় ধর্ম।
“ম্যাম”, প্রমিতা বলল, “আমার অক্সফোর্ডে পড়ার ইচ্ছা ছিল।”
এখন নেই?
না। আপনার সান্নিধ্য এই মাত্র আমার ইচ্ছাকে প্রতিজ্ঞায় পরিণত করে দিয়েছে।
টোফেলে খুব ভালো স্কোর তার। বিলিওনিয়ার শিল্পপতির একমাত্র কন্যা। টিউশন ফি কোনো বিষয় না। সুতরাং, প্রতিজ্ঞা যে তার প্রতিষ্ঠা পাবে সহজে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। রচনা সহযোগিতা করলে বৃত্তিও পেয়ে যেতে পারে।
রেবেকার মতো মহারাষ্ট্রের জগদ্গৌরীও বাংলা কম বুঝে। বাংলা বলতেই মন খারাপ করে ফেলছিল। আবার ইংরেজিতে আড্ডা দিয়ে বাংলার মজাও পাওয়া যাচ্ছিল না। তবু তাদের জন্য মাঝে মাঝে ইংরেজি বলতে হচ্ছিল। আমি ইংরেজি কথোপকথনে খুবই দুর্বল। সারাবছর মফস্সলে চাকরি করেছি। ইংরেজি বলার সুযোগ ছিল না। এ নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই। বরং গর্ব হয়। আমি মাতৃভাষায় কথোপকথন করতে পারি। নিজের মাকে জানি, পরের মাকে কম জানলেও কেউ আমাকে কুলাঙ্গার বলতে পারবে না।
আড্ডার কোন ফাঁকে আমি রচনার কোলে মাথা দিয়ে হেলে পড়েছি জানি না। হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম, “এই মেয়ের দল, তোমাদের সময় বোধ আছে? রাত যে শেষ। সকাল সকাল উঠতে হবে না?” কথাগুলো বলার জন্য বলা। মন থেকে মোটেও নয়। আমারও গল্প করতে ভীষণ লাগছে। রাতটা যদি শেষ না হতো!
আর একটু থাকি-না, স্যার? প্রমিতা বলল, আমাদের রাতে না ঘুমোলেও চলে।
“থাকো”, খুশি হয়ে বললাম, “ এমন নক্ষত্ররাজির নাক্ষত্রিক আড্ডায় হাজার বছর নির্ঘুম কাটিয়ে দিতে পারি অবলীলায়।”
আবার শুরু হলো গল্প। এর মধ্যে কয়েক বার চা-কপি, নাস্তা আর শ্যাম্পেন হয়ে গেল। কিন্তু কিছুতেই রাতের প্রস্থানকে থামানো গেল না। একসময় রাতটা শেষ হয়ে গেল। আর ঘুমানো যাবে না। গোসল-স্নান করে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে।
রেবেকা বলল, ম্যাম, অক্সফোর্ডে পড়তে হলে আর কী লাগবে?
আগ্রহে প্রবল আন্তরিকতা।
মেয়েরা বের হয়ে যাওয়ার পর রচনা প্রমিতাকে ডেকে বলল, তোমার দেওয়া উপহারগুলো সমান সাত ভাগে ভাগ করে সাতজনকে দিয়ে দাও। আমার ভাগে একটা সাবান পড়ে যেন।
তবে আমার ভাগটা স্যারকে দিয়ে দেব।
রচনা ওয়াশরুমে ঢুকল। আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম— শোয়ার জন্য নয়, এমনি। বাসায় থাকলে বেশিক্ষণ বিছানায় গা না-এলিয়ে থাকতে পারি না। অন্তর্মুখী মানুষের এ একটা বড়ো বদভ্যাস।
রচনা বাথরুম থেকে বের হয়ে এসে বলল, স্যার, গোসল করবেন না?
করতে হবে? আমার প্রশ্নে না-এর আনাগোনা।
ম্যাম জানি, আপনাকে কী ডাকেন?
গন্ধরাজ। গোসল কম করি তো, তাই। সোনা মেয়ে বলো তো— গোসল কম করলে কী হয়?
পরিষ্কার থাকা ভালো—এ আর কী!
আচ্ছা, তুমি কি আমার শরীর থেকে গন্ধ পাও।
গন্ধ নয়, সুগন্ধ পাই।
সত্যি?
আপনার শরীরের গন্ধ আমার খুব প্রিয়— একদম প্রথম থেকে।
ধ্যাৎ!
“সত্যি বলছি, স্যার”, রচনা আমার পাশে বসতে বসতে বলল, “সারাক্ষণ শুধু শুঁকতে ইচ্ছে করে। এজন্য বারবার কাছে ঘেষি, জড়িয়ে ধরি।” রচনা আমাকে জড়িয়ে ধরল।
কিন্তু তোমার ম্যাম যে বলে – – –
আপনার শরীরের গন্ধটা না ভাব্বা, আমার কাছে মৌন সুগন্ধে উন্মাদ করা শিহরন। বুকের ঘামে পৃথিবীর পৃষ্ঠা, মুখের ঘামে নিষ্ঠার বরাভয়। এই ঘামের সমুদ্রে জাহাজ ভাসিয়ে বস্তি থেকে অক্সফোর্ড। ভাব্বা, মনে করে দেখুন; কত বড়ো অঘটন।
তোমার ম্যাম বলে—
কী বলেন?
আমি নাকি খাটাশ। সে সর্বদা আমার শরীরে খাটাশের গন্ধ পায়। তোমার সঙ্গে তো দু-যুগের অধিক হয়ে গেল, এমন কখনো পেয়েছ?
ম্যাম, মজা করেন। কী সু্ন্দর চুলের গন্ধ।
রচনার খোলা চুলে ফরাসি সাবানের গন্ধ। বয়স বাড়ার সঙ্গে মেয়েটার চুলগুলোও বাড়ছে। এলোচুল কালো মমতায় ঢেকে দিয়েছে তার পুরো পিঠ।
মেয়ে, গন্ধটা আসলেই দারুণ। একদম মনমাতানো।
কীসের গন্ধ?
তোমার চুলের।
রচনার মন্তব্য পাওয়ার আগে ফোন এল ঋধিতার। বুকটা কেঁপে উঠল। কারো কারো ফোন ঝঞ্ঝার মতো কাঁপুনে শঙ্কা হয়ে জীবনকে কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য আসে। স্ত্রীর ফোন এমন একটি। বিশেষ করে যখন অন্য কোথাও মগ্ন থাকে মন।
কী করছ? ঋধিতা প্রশ্ন করল।
বিছানা ছাড়তে যাচ্ছি।
বিছানা ছাড়তে যাচ্ছ না কি বেশ্যাখানায় যাচ্ছ?
কী বলো এসব?
যা ঠিক তাই বলছি। আমি পুরুষদের বিশ্বাস করি না।
আমিও পুরুষদের বিশ্বাস করি না।
তুমি একটা অসভ্য।
ঠিক বলেছ, আমি একটা অসভ্য।
ইদানীং তার সব মন্তব্যে সমর্থন ছাড়া অন্য কিছু করি না। তাকে থামানোর জন্য এর চেয়ে উৎকৃষ্ট কোনো পন্থা আমার জানা নেই। ছেলেমেয়ে বড়ো হচ্ছে। তর্ক করে তাদের কাছে ছোটো হতে ভীষণ কষ্ট হয়।
তুমি একটা গর্দভ।
যথার্থ।
তুমি আসলে এখন কোথায়?
কলকাতায়।
কখন আসবে?
পাঁচ দিন পর।
ঋধিতার সঙ্গে কথা শেষ করে রচনাকে বললাম, তোমার ম্যাম কী বলেছে জানো?
ঠিক বলতে পারব না। তবে কেন বলেছেন তা ঠিক ঠিক বলতে পারব।
কেন বলেছে?
“কাছে থাকলে বিরক্তি,
দূরে গেলে আসক্তি—
এ হচ্ছে সম্পর্ক— স্বামী আর স্ত্রী।।
ভাব্বা, ম্যামের আসক্তি ভালোবাসার জোয়ার। এমন জোয়ার সর্বদা হারানোর ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকে। তাই বুকে কষ্ট আসে। কষ্ট মানুষকে অস্থির করে দেয়। বিষয়টা স্যার আপনাকে বুঝতে হবে।
এটা কী ঘৃণা নয়?
না।
কী?
শঙ্কিত সতর্কতার জন্য সৃষ্ট অস্থিরতা। এমন অস্থিরতা মানুষের বিবেচনাকে কিছুটা বেসামাল করে দেয়। তাই মনে হয় অবিশ্বাস বা ঘৃণাপ্রসূত। আসলে তা ঠিক নয়।
সোনা মেয়ে, তুমি সবকিছু ইতিবাচক চশমায় দেখো।
আপনি শিখিয়েছেন।
বাইরে চাঁপা ফুলের গাছ। জানালা দিয়ে হুহু করে ঢুকছে গন্ধমাখা বাতাস। রচনা আমার মাথার খুশকি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তার চুল ঢেকে দিয়েছে আমার মাথা থেকে বুক-মুখ। আমি গুনগুন শুরু করি—
মোর প্রিয়া হবে এসো রানি,
দেব খোঁপায় তারার ফুল।
রচনা সুর দিল আমার সঙ্গে—
কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির চৈতি চাঁদের দুল- – -।
স্যার, মাথায় খুশকি এল কীভাবে?
খুশকি নয়।
তো কী?
ধুলো।
রচনা খুশকি বাছাই করতে করতে বলল, বাদ দেন, গোসল করতে হবে না। গোসল করলে এমন সুন্দর গন্ধ জলে ভেসে যাবে। সন্ধ্যায় এসে করলে হবে।
তাহলে করব না।
রচনা একটা বই হাতে নিয়ে আমাকে বালিশ বানিয়ে পেটের ওপর মাথটা এলিয়ে দিয়ে আবৃত্তি করতে থাকে—
My love for you is like the raging sea,
So powerful and deep it will forever be.
Through storm, wind, and heavy rain,
It will withstand every pain.
ম্যাম? দরজার গোড়া থেকে প্রমিতার গলা, আসব?
এসো, রচনা আবৃত্তি থামিয়ে বলল।
রুমে ঢুকল প্রমিতা। তার পেছনে মিশু। দুজনের গায়ে রাঁধুনি ড্রেস। রান্না করছিল। রান্নাঘর থেকে এসেছে। নিশ্চয় জরুরি কিছু।
রান্না কি তোমরাই করছ?
হ্যাঁ, ম্যাম।
কিছু বলবে?
বলব।
কী?
আমরা-না, স্যার মানে আপনার ভাব্বাকে – – -।
বলো।
লজ্জা করছে।
কীসের লজ্জা? বলে ফেলো।
আমরা-না, স্যার মানে আপনার ভাব্বাকে ভালোবাসি।
রচনা অট্টহাসি হেসে বলল, আমাকে ভালোবাস না?
“ম্যাম”, প্রমিতা বলল, “আপনাকে ভালোবাসতে গিয়েই স্যারকে ভালোবেসে ফেলতে হলো।”
“ম্যাম, একদম তাই”, মিশু বলল।
রচনা বলল, তোমাদের মনে এখনো শিশুর খেলা। এমন মন সত্যিকার অর্থে নিরঞ্জন। আমিও তোমাদের ভালোবেসে ফেলেছি। ভাব্বা, আপনি?
আমি কেবল তাদের ভালোবাসা নেব আর নেব। উপচে যেসব পড়ে সেসবই তাদের। খুব কি স্বার্থপরতা হয়ে গেল?
তাই হোক, স্যার; প্রমিতা বলল।
তাদের কথায় আমার খুশি হওয়ার কথা। সুতরাং, খুশি হলাম। খুশি হওয়ার পর মনে হলো— একটু পূর্বেও পঞ্চকন্যার প্রতি আমার যে উল্লাস বিগলিত উচ্ছ্বাস ছিল তা মুহূর্তের মাঝে স্নেহমদির শিহরনে পরিণত হয়েছে। সবাই রচনার সারিতে দাঁড়িয়ে গেল।