সন্মিত্রা: নবম পর্ব / ড. মোহাম্মদ আমীন
সকাল এগারোটায় অনুষ্ঠান শুরু হবে। মেয়েরা বেরিয়ে গেছে আটটায়। সব ঠিকঠাক হলে খবর দেবে যাওয়ার। তখন রচনা আর আমি রওয়ানা দেব। অনুষ্ঠানস্থল বাসা থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের হাঁটা-পথ। মেয়েরা হেঁটেই গেছে। আমরা যাব গাড়িতে। প্রথম দিন শিশুদিবস; মানে সব প্রতিযোগিতা শিশুদের নিয়ে শিশুদের জন্য শিশুদের ঘিরে অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠানসজ্জার সার্বিক দায়িত্বে আছেন অমল এবং তাঁর দলবল। সহায়তা করছেন স্থানীয় কাউন্সিলর বিকাশ রায়। পঞ্চকন্যা তো আছেই।
শিশুদিবসের প্রধান অতিথি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। রচনা আর আমি দুজনই তাঁকে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিলাম। তিনি খুব অসুস্থ। তবু রচনার সম্মানে সম্মতি দিয়েছেন। রচনার অনুরোধ তাঁর পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। তবে কথা দিতে হয়েছে— বেশিক্ষণ আটকে রাখা যাবে না। অল্প কিছুক্ষণ থেকে চলে আসবেন। কবিসাহিত্যিকদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো অসাধারণ মানুষ আমি দেখিনি। কথায় আর চলনে; আচরণ এবং বলনে একটি নিষ্পাপ শিশু। ব্যবহারে আপাদমস্তক অমায়িক। মাটির মতো তাঁর ধৈর্য। তাঁর জন্মস্থান মাদারীপুরের কালকিনি। সৈয়দ আবুল হোসেন ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পরস্পর বন্ধু। সৈয়দ আবুল হোসেনের একটি কলেজ-হোস্টেল উদ্বোধন করার জন্য তিনি কালকিনি গিয়েছিলেন। সে সুবাদে অনেক আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হওয়ার সুযোগ ঘটে।
দশটার পর খবর দিল প্রমিতা— সব প্রস্তুত। গিয়ে দেখি চারদিক শিশুতে শিশুতে শিশুময়— পুরো বস্তি পরিপাটি ছিমছাম। নির্ধারিত এলাকা চমৎকারভাবে সাজানো। শিশুদের সঙ্গে বস্তির অনেক নারীপুরুষও দেখা গেল। শুধু তাই নয়, বস্তির বাইরের লোকজনও এসেছেন। আসন-সজ্জাতেও পেশাদারিত্বের ছাপ। এমন ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান উপভোগের জন্য সবাই হাজির থাকবে— এতে আর সন্দেহ কী। দারুণ কাজ করছে অমল আর মেয়েরা।
আমাদের দেখে দৌড়ে এল প্রমিতা, মিশু আর অমল। জগদ্গৌরী ও দীপালী আবৃত্তি, লিখন-পঠন, সাধারণ জ্ঞান এবং আইকিউ টেস্ট-সহ বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিযোগিতার দায়িত্বে। রেবেকা ফলাফল ও পুরস্কার ব্যবস্থাপনা শাখার প্রধান। প্রমিতা আর মিশুর প্রধান দায়িত্ব রচনার নিরাপত্তা। যদিও অন্যান্য বিষয়ও তারা দেখছে।
“ম্যাম”, অমল বলল, “আজ বস্তির অধিকাংশ নারী-পুরুষ কাজে যায়নি।”
কেন?
অনুষ্ঠান দেখার জন্য। অনেকে অফিস থেকে তিন দিনের ছুটি নিয়েছে। এমন ঘটনা তাদের জীবনে আর ঘটেনি।
প্রমি, কেমন লাগছে তোমার? আমি প্রমিতাকে বললাম।
আমার ‘প্রমি’ সম্বোধনে খুশি হলো সে। তার অধর-ওষ্ঠের আচরণ তা জানিয়ে দিল। এমন সুন্দরকে পুরো নামে ডাকলে রোমাঞ্চটাই কমে যায়। নাম বলতে যদি জিহ্বাকে এত সময় ব্যয় করতে হয়, তো সে কথা বলবে কখন? জিহ্বার কি স্বাদ-আহ্লাদ বলতে কিছু নেই?
হাসিতে হাসি দিয়ে প্রমিতা বলল, “সব কৃতিত্ব অমল-দার। অন্য কাউকে দায়িত্ব দিলে এই অল্প সময়ে এত জটিল কাজ এমন সুচারুভাবে হয়তো করতে পারত না। অমল-দার নেতৃত্বগুণ অসাধারণ। ব্যবস্থাপনায় একদম সুপার কম্পিউটার।
“না, না”, সলাজ হেসে অমল বলল, প্রমিদি একটু বাড়িয়ে বলছেন। তারা করছেন সব। আমি কেবল হুকুমের চাকর।
আমাদের চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে অমল চলে গেলেন। নেতৃত্বের শক্তি অপরিসীম— মনে মনে বললাম। চৌকশ আর আন্তরিক হলে তো কথাই নেই। অমল চৌকশ এবং আন্তরিক। শৃঙ্খলার বিষয়টাও মুগ্ধকর। মনে হলো— যেন কোনো বিধিবদ্ধ বাহিনীর নিয়মিত অনুষ্ঠান। শিশুরা অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব নিয়ে নিচ্ছে অমলের নেতৃত্বে কর্মরত একদল স্বেচ্ছাসেবী। সার্বিক তত্ত্বাবধানে পঞ্চকন্যা। প্রমিতা দলনেত্রী।
প্রমি, মিশু কোথায়?
“এই তো স্যার, আমি এখানে। কিন্তু আপনার ওপর রাগ করেছি।” মিশু পেছন থেকে বলল।
কেন?
প্রমিতা দিদিকে নতুন নাম দিয়েছেন। আমাকে দেননি।
রচনা বলল, তুমি আমার মতো কালো তো, তাই। কালোকে কেউ ভালোবাসে না।
“তুমি এক্সসেপশনাল।”, আমি মিশুকে বললাম, “অতএব, নামটাও তেমন হওয়া চাই। মিশির মতো কালো, মিশকালো। না, সুবিধার মনে হচ্ছে না— আজ থেকে তুমি আমার মাকালী। পছন্দ হয়েছে?”
উত্তর দিতে পারল না মিশু। তার আগে অমল দৌড়ে এসে জানালেন প্রধান অতিথি এসে গেছেন। প্রধান অতিথি মানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ঘড়ি দেখলাম— দশটা পঞ্চাশ। অসুস্থ, ব্যস্ত। তবু কী সময় জ্ঞান! রচনা, প্রবোধ, বিকাশ রায়, অমল এবং আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে স্বাগত জানিয়ে মঞ্চে নিয়ে এলাম।
মঞ্চে গিয়ে বললেন, আমার শরীর ভালো না। বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। কিছুক্ষণ থেকে চলে যাব।বারবার নানা ওষুধ খেতে হয়।
রচনা বলল, আপনি এসেছেন, এটিই আমাদের পরম সৌভাগ্য। এখানে কোনো বক্তৃতা-বিবৃতি হবে না। শিশুরা খেলবে আমরা দেখব। আপনি শিশুদের হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন। তারা গর্বিত হবে বর্তমান সুনীলে— আগামীর সুনীল হওয়ার প্রতিজ্ঞায়। যতক্ষণ পারেন আমাদের সঙ্গ দিয়ে গর্বিত রাখুন।
এগারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। বস্তির শিশুরা খেলছে, জয়ী হওয়ার জন্য লড়ছে। প্রতিটি প্রতিযোগিতা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজয়ী এবং অংশগ্রহণকারীদের হাতে পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন— সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। প্রতিবন্ধীদের জন্যও নানা খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে। সব বয়সের শিশুরা যাতে অংশ নিতে পারে তেমন কৌশলে অনুষ্ঠানটি সাজানো হয়েছে। শিশুদের উচ্ছ্বাসে পড়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজের দেওয়া ‘কিছুক্ষণ’-এর কথা নিজেই বেমালুম ভুলে গেলেন।
কেমন লাগছে? আমি জানতে চাইলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে।
অসুস্থ শরীর। ভেবেছিলাম, কয়েক মিনিট থেকে চলে যাব। আপনাদের অনুষ্ঠান দেখে সুস্থ হয়ে গেছি। শেষ না-হওয়া অবধি থাকব।
অনুষ্ঠানের শেষদিকে জগদ্গৌরী ও দীপালী মুনির নামের এক শিশুকে নিয়ে এল । সাধারণ জ্ঞান, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব এবং আইকিউ টেস্টে শিশুটি অসম্ভব ভালো করেছে।
“ম্যাম”, দীপালী বলল, “ছেলেটি অবিশ্বাস্য মেধার অধিকারী, দেখুন-না তার খাতা, কী বুদ্ধদীপ্ত উত্তর দিয়েছে।”
রচনা খাতাটি নিয়ে আমাকে দিলেন। আমি তা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়ে বললাম, প্লিজ, দেখুন।
তিনি খাতাটি নিয়ে দেখলেন। কিছুক্ষণ পর আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, অবিশ্বাস্য! বস্তিতেও এমন প্রতিভা তাহলে আছে!
খাতা দেখে আমি বিমূঢ়। মুনির আসলেই মেধাবী। প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব প্রতিযোগিতায় নব্বই পেয়েছে। এটি সহজ কথা নয়। যে প্রশ্নে সে নব্বই পেয়েছে ওই প্রশ্নে আমি পঞ্চাশ পেতাম কি না সন্দেহ। রচনাকে কানে কানে বললাম— আর এক রচনা।
বড়ো হয়ে তুমি কী হবে? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মুনীরের কাছে জানতে চাইলেন।
বস্তির সর্দার হব।
তারপর কী হবে?
কাউন্সিলর হব।
তারপর?
মেয়র হব।
তারপর?
ততদিনে আমার অনেক বয়স হয়ে যাবে। এর বেশি যেতে পারব না। ছেলেমেয়েদের আমি মেয়র পর্যন্ত পৌঁছে দেব। তারপর তাদের বিষয়।
প্রধানমন্ত্রী হবে না? প্রবোধ প্রশ্ন করল।
না। ভারতে মুসলিমদের প্রধানমন্ত্রী হওয়া কঠিন। আমরা তো সংখ্যালঘু। সবাই আমাদের ঠোকরায় আর ঠোকরায়।
লেখাপড়া না করলে কীভাবে মেয়র হবে? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বললেন।
“মেয়র হতে ভোট লাগে” মুনির বলল, “লেখাপড়া লাগে না।”
তুমি কী লেখাপড়া করবে না?
লেখাপড়া করতে টাকা লাগে। আমার টাকা নেই। বস্তির সর্দার হতে টাকা লাগে না। বস্তির সর্দার হলে টাকা আসে। টাকা দিয়ে কাউন্সিলর হব। আরও টাকা আয় করব। তারপর মেয়র হব।
লেখাপড়ার জন্য যদি তুমি টাকা পাও? রচনা বলল।
তখন বস্তির সর্দার হব না।
কী হবে?
এপিজে আবদুল কালাম।
মুনির বস্তির সর্দার হতে চায়, কী অবাক তাই না? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বললেন।
“দৃষ্টিভঙ্গিই জীবনভঙ্গির পরিচালক”, রচনা বলল, “এবং পরিবেশই দৃষ্টিভঙ্গির স্রষ্টা। মুনির তার পরিবেশে বস্তির সর্দারের চেয়ে ক্ষমতাবান কাউকে দেখেনি। কিন্তু টাকা পেলে সে বস্তির সর্দার হবে না, এপিজে আবদুল কালাম হবে।”
“দারুণ অভিজ্ঞতা, কার্যকর দর্শন “, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলল।
রচনা বলল, এভাবে মানুষ সম্পদে পরিণত হয়। এটাকেই বলে মানিসকতার ইতিবাচক রূপান্তর —যা দিতে পারে কেবল শিক্ষা।
“আপনার এমন উদ্যোগ তুলনাহীন”, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, “আমাদের উচিত এদিকেও নজর দেওয়া, কিন্তু সবাই নিজেদের নিয়ে এত ব্যস্ত যে, কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে পারছি না।”
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা চেক দিয়ে রচনা বলল, আপনি এই চেকটা মুনীরের হাতে তুলে দিন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মুনীরের হাতে চেকটি তুলে দিলেন। এর কিছুক্ষণ পর অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হলো।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, “আমার এখন খারাপ লাগা শুরু করেছে। এতক্ষণ মনেই ছিল না যে, আমি অসুস্থ। আমার ওষুধ নিতে হবে । এত ভালো অনুষ্ঠানটা এত তাড়াতাড়ি শেষ করে দিলেন! আবার শুরু করা যায় না? যায় না। যা, যায় তা চিরতরে যায়।”
“ঠিক বলেছেন”, রচনা বলল, “সব চলে যায় বর্তমানকে অতীতের গহ্বরে ঢেলে দিয়ে নিঃস্ব করে। চিরদিনের জন্য যায়, আর আসে না। তাই আগত বর্তমানকে আবার নতুন করে গড়ে তুলে নিতে হয়। এই আগত বর্তমানই হলো আমাদের শিশু।”
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বিদায় করে আমরা বাসার দিকে রওয়না দিলাম। গাড়িতে নয়, পঞ্চকন্যার সঙ্গে হেঁটে। সে ছিল এক স্বপ্নবিকেল।
বাসার গেটে গিয়ে ঘড়ি দেখলাম, পাঁচটা বত্রিশ।
দু মিনিট দেরি হয়ে গেল।