ড. মোহাম্মদ আমীন

এই পোস্টের সংযোগ: https://draminbd.com/সমাস-বাংলা-ব্যাকরণের-পিঁ/
সমাস : বাংলা ব্যাকরণের পিঁয়াজ: বাংলা ভাষার সালাদ
‘খালিঘর’ না কি ‘খালি ঘর’? কোনটি শুদ্ধ এবং কেন? দেখা যাক, কোনটি শুদ্ধ।
সমাসবদ্ধ পদ একসঙ্গে লিখতে হয়— তবে সবসময় নয়? কখন? “ প্রচলন, উচ্চারণ, অর্থদ্যোতকতা ও শ্রুতিমাধুর্য বিবেচনায় যখন সুবিধা মনে হয়, তখন। নতুবা, ফাঁক রেখে লেখাই বিধেয়, এটিই বাংলার বৈশিষ্ট্য। মনে রাখতে হবে, বাংলা সংস্কৃত ভাষা নয়। ” অতএব, বাংলা ভাষায় সমাস সালাদের মতো। এটি হলে ভালো, না হলেও চলে এবং অভ্যাস হয়ে গেলে সালাদ অপ্রয়োজনীয়।
পিঁয়াজের সঙ্গে বাংলা ব্যাকরণের ‘সমাস’ বিষয়টির একটা পিঁয়াজি মিল রয়েছে। পিঁয়াজ কত কম-প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বহীন ও অনাবশ্যক তা বাঙালির চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। পেলে ভালো, কম

পেলে আরও ভালো এবং না-হলেও চলে—এ হচ্ছে পিঁয়াজ। বাংলা ব্যাকরণে সমাসের ভূমিকাও পিঁয়াজের মতো— মানলেও চলে, না মানলেও। আসলে, বাংলায় সমাসের প্রয়োজনীয়তা বহুলাংশে ইচ্ছা-নির্ভর বিষয়। গুরুত্ব দিলে ‘সমাস’ গুরুত্বপূর্ণ আর গুরুত্ব না-দিলে অপ্রয়োজনীয়। ‘জয় বাংলা’ কথাটিকে অভিধান যতই সমাসবদ্ধ পদ হিসেবে ‘জয়বাংলা’ বলুক—, ‘জয় বাংলা’ লিখলে ব্যাকরণগতভাবে কিংবা অর্থ ও শ্রুতিমাধুর্য প্রকাশে কোনো বিঘ্ন হয় না, বরং শ্রতিমাধুর্য বৃদ্ধি পায়। ‘বিজয়দিবস’ আর ‘বিজয় দিবস’, উভয় ধারাই শুদ্ধ ও ব্যাকরণসম্মত। প্রথমটি— ‘সংলগ্ন সমাস’ এবং দ্বিতীয়টি ‘অসংলগ্ন সমাস’। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ ও ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়’ যথাক্রমে ‘ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়’ ও ‘চট্টগ্রামবিশ্ববিদ্যালয়’ লিখব কেন? অথচ, সমাসবিধি অনুযায়ী তা হওয়া উচিত।
সংস্কৃত ব্যাকরণ হতে আগত বাংলা ব্যাকরণের যেসব বিষয় বাংলায় তেমন সুবিধা করতে পারেনি সেগুলোর মধ্যে ‘সমাস’ অন্যতম। বাংলায় ব্যক্তিবিশেষের বাগ্রীতি, প্রকাশভঙ্গি, শ্রুতিমাধুর্য বিবেচনা এবং নান্দনিকতা রক্ষায় লেখকের ইচ্ছার ওপরই সমাসবদ্ধ পদের অবয়ব বহুলাংশে নির্ভরশীল। পদের অবয়ব নয়, উচ্চারিত ধ্বনি শ্রুতিমধুর এবং অর্থদ্যোতনায় সহজবোধ্য হয়ে উঠে কি না সেটিই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সংলগ্ন সমাসবদ্ধ পদ অনেক সময় উচ্চারণকে সংশয়পূর্ণ করে তোলে। তাই এমন কোনো সমাসবদ্ধ পদ সৃষ্টি করা সমীচীন নয়, যা দৃষ্টিকটু ও দুরুচ্চার্য হয়।
সমাসের কাজ শ্রুতিমাধুর্য রক্ষা করা। বাংলায় এর একটি নির্দিষ্ট সীমা আছে। বাংলাভাষীর কাছে সাধারণত ছোটো ছোটো সহজ-উচ্চার্য শব্দই শ্রুতিমধুর হিসেবে প্রতিভাত।‘ নিখিল বাংলা চিরন্তন আকালি যুব সংহতি সমিতি’ কথাটিকে সেঁটে লিখলে হয়— “নিখিলবাংলাচিরন্তনআকালিযুবসংহতিসমিতি’— কেমন মনে হয়? অযথা বড়ো শব্দ কিংবা সমাসবদ্ধ পদ স্বভাবতই দৃষ্টিনন্দন, সহজোচ্চারণ ও শ্রুতিমাধুর্যের পক্ষে হানিকর। সহজ-প্রকাশ ও শ্রুতিমাধুর্য এবং অর্থদ্যোতনায় কোনো বিঘ্ন না-ঘটলে সমাসবদ্ধ পদ ফাঁক রেখে লেখাই ভালো। এসব শব্দরাশি সংলগ্ন করে বড়ো পদে পরিণত করা সমীচীন নয়। এজন্য আমরা বলি— ‘জয় বাংলা’।
বাংলায় সমাসের ফাঁকফোকড় বৈশিষ্ট্যকে সিদ্ধ করার জন্য অসংলগ্ন সমাসের সৃষ্টি। যার কল্যাণে ফাঁক রেখে সমাসবদ্ধ পদ লিখলেও অশুদ্ধ বা অসিদ্ধ মনে করার কোনো সুযোগ নেই। যেমন : বিজয় উদ্যাপনের নিমিত্ত যে দিবস= বিজয় দিবস। তেমনি, শহিদ দিবস, পরিকল্পনা কমিশন, সোনার বাংলা,

গোরুর গাড়ি, কলুর বলদ, চন্দনাইশ যুব সমাজ, বাড্ডা বস্তি উন্নয়ন জনবন্ধু সমিতি, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, হাতে তৈরি, গাছে পাকা, বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সেতু, স্বাধীনতা দিবস, বাংলা বানান সংস্কার কমিটি, বিশ্ব কবি সম্মেলন, জেলা প্রশাসক, ঘোড়ার ডিম, যোগাযোগ মন্ত্রী, নিখিল ভারত যুব সংঘ, শুদ্ধ বানান চর্চা— সমাসবদ্ধ পদ হলেও ফাঁক রেখে লেখা হয়। উপর্যুক্ত শব্দরাশিগুলো বিচ্ছিন্নভাবে লেখা হলেও প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেকটি সমাসবদ্ধ পদ এবং সংলগ্ন নয় বলে এদের অসংলগ্ন সমাস বলা হয়।
বাংলায় সংস্কৃতের সমাসবিধির প্রভাব নগণ্য এবং শব্দচয়নে তা উপেক্ষা করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলা শব্দের মর্যাদা বা প্রমিতরূপের কেনো বিঘ্ন ঘটে না, ব্যাকরণগতভাবেও এটি স্বীকার্য। বাংলায় সমাসবদ্ধ পদ ইচ্ছানুযায়ী সংলগ্ন বা অসংলগ্ন রাখার যাবতীয় অধিকার ব্যাকরণই দিয়ে রেখেছে। অতএব, বাংলা ব্যাকরণে প্রবহমান সংস্কৃত সমাসকে অত গুরুত্ব দেওয়া অনাবশ্যক। যেখানে অনিবার্য নয় এবং সমাসবদ্ধ করা না-হলে শোভন দেখায় না; দৃষ্টিকটু মনে হয়— কেবল সেসব ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোথাও সমাসবদ্ধ পদকে একসঙ্গে লেখা বাধ্যতামূলক করার কোনো হেতু নেই। এটি লেখকের ইচ্ছানির্ভর হওয়া সমীচীন। তবে, একই লেখায় যেন ভিন্নতা না-হয়, সেটি লক্ষ রাখা সমীচীন।
——————————————————————————-