সমাস : বাংলা ব্যাকরণের পিঁয়াজ

ড. মোহাম্মদ আমীন

ড. মোহাম্মদ আমীন

এই পোস্টের সংযোগ: https://draminbd.com/সমাস-বাংলা-ব্যাকরণের-পিঁ/

সমাস : বাংলা ব্যাকরণের পিঁয়াজ: বাংলা ভাষার সালাদ

‘খালিঘর’ না কি ‘খালি ঘর’? কোনটি শুদ্ধ এবং কেন? দেখা যাক, কোনটি শুদ্ধ।

খালি যে ঘর= খালিঘর ( সমাসবদ্ধ সংলগ্ন সমস্তপদ)।
খালি যে ঘর= খালি ঘর ( সমাসবদ্ধ অসংলগ্ন সমাস/ পদরাশি)।
বহুল প্রচলিত অসংলগ্ন সমাসের কিছু উদাহরণ:
১. শহিদ দিবস।
২. স্বাধীনতা দিবস।
৩. সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী।
৪. জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
৫. জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়।
৬. দক্ষিণ পাঞ্জাব নিখিল শিখ ছাত্র সঙ্ঘ।
৭. নিখিল ভারত যুব মুসলিম সাহিত্য সংসদ।
৯. নিখিল বাংলা চিরন্তন আকালি যুব সংহতি সমিতি।
অতএব, খালিঘর এবং খালি ঘর দুটোই শুদ্ধ। প্রথমটি সংলগ্ন এবং দ্বিতীয়টি অসংলগ্ন সমাস। সমাসের ক্ষেত্রে ফাঁক-অফাঁক যদি অর্থ অনুধাবন কিংবা শ্রুতি বা দৃষ্টি পাতনে সংশয়ের কারণ না ঘটায় তাহলে ফাঁক রাখা কিংবা না-রাখা দুটোই সমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যদি লেখা হয় ‘ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়’, ভালো লাগবে না।জাতীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’ এখানেও ফাঁক আছে। অথচ, এরা সমাসবদ্ধ পদ।

সমাসবদ্ধ পদ একসঙ্গে লিখতে হয়— তবে সবসময় নয়? কখন? “ প্রচলন, উচ্চারণ, অর্থদ্যোতকতা ও শ্রুতিমাধুর্য বিবেচনায় যখন সুবিধা মনে হয়, তখন। নতুবা, ফাঁক রেখে লেখাই বিধেয়, এটিই বাংলার বৈশিষ্ট্য। মনে রাখতে হবে, বাংলা সংস্কৃত ভাষা নয়। ” অতএব, বাংলা ভাষায় সমাস সালাদের মতো। এটি হলে ভালো, না হলেও চলে এবং অভ্যাস হয়ে গেলে সালাদ অপ্রয়োজনীয়।

পিঁয়াজের সঙ্গে বাংলা ব্যাকরণের ‘সমাস’ বিষয়টির একটা পিঁয়াজি মিল রয়েছে। পিঁয়াজ কত কম-প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বহীন ও অনাবশ্যক  তা বাঙালির চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। পেলে ভালো, কম

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

পেলে আরও ভালো এবং না-হলেও চলে—এ হচ্ছে পিঁয়াজ। বাংলা ব্যাকরণে সমাসের ভূমিকাও  পিঁয়াজের মতো— মানলেও চলে, না মানলেও।  আসলে, বাংলায় সমাসের প্রয়োজনীয়তা বহুলাংশে ইচ্ছা-নির্ভর বিষয়। গুরুত্ব দিলে ‘সমাস’ গুরুত্বপূর্ণ আর গুরুত্ব না-দিলে অপ্রয়োজনীয়। ‘জয় বাংলা’ কথাটিকে অভিধান যতই সমাসবদ্ধ পদ হিসেবে জয়বাংলা বলুক—, ‘জয় বাংলা’ লিখলে ব্যাকরণগতভাবে কিংবা অর্থ ও শ্রুতিমাধুর্য প্রকাশে কোনো বিঘ্ন হয় না, বরং শ্রতিমাধুর্য বৃদ্ধি পায়। ‘বিজয়দিবস’ আর ‘বিজয় দিবস’, উভয় ধারাই শুদ্ধ ও ব্যাকরণসম্মত। প্রথমটি— ‘সংলগ্ন সমাস’ এবং দ্বিতীয়টি ‘অসংলগ্ন সমাস’। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ ও ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়’ যথাক্রমে ‘ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়’ ও ‘চট্টগ্রামবিশ্ববিদ্যালয়’ লিখব কেন? অথচ, সমাসবিধি অনুযায়ী তা হওয়া উচিত।

সংস্কৃত ব্যাকরণ হতে আগত বাংলা ব্যাকরণের যেসব বিষয় বাংলায় তেমন সুবিধা করতে পারেনি সেগুলোর মধ্যে ‘সমাস’ অন্যতম। বাংলায় ব্যক্তিবিশেষের বাগ্‌রীতি, প্রকাশভঙ্গি, শ্রুতিমাধুর্য বিবেচনা এবং নান্দনিকতা রক্ষায় লেখকের ইচ্ছার ওপরই সমাসবদ্ধ পদের অবয়ব বহুলাংশে নির্ভরশীল।  পদের অবয়ব নয়, উচ্চারিত ধ্বনি শ্রুতিমধুর এবং অর্থদ্যোতনায় সহজবোধ্য হয়ে উঠে কি না সেটিই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সংলগ্ন সমাসবদ্ধ পদ অনেক সময় উচ্চারণকে সংশয়পূর্ণ করে তোলে।  তাই এমন কোনো সমাসবদ্ধ পদ সৃষ্টি করা সমীচীন নয়, যা দৃষ্টিকটু ও দুরুচ্চার্য হয়। 

সমাসের কাজ শ্রুতিমাধুর্য রক্ষা করা। বাংলায় এর একটি নির্দিষ্ট সীমা আছে। বাংলাভাষীর কাছে সাধারণত ছোটো ছোটো সহজ-উচ্চার্য শব্দই শ্রুতিমধুর   হিসেবে প্রতিভাত।‘ নিখিল বাংলা চিরন্তন আকালি যুব সংহতি সমিতি’ কথাটিকে  সেঁটে লিখলে হয়“নিখিলবাংলাচিরন্তনআকালিযুবসংহতিসমিতি’— কেমন মনে হয়? অযথা বড়ো শব্দ কিংবা সমাসবদ্ধ পদ স্বভাবতই দৃষ্টিনন্দন, সহজোচ্চারণ ও শ্রুতিমাধুর্যের পক্ষে হানিকর। সহজ-প্রকাশ ও শ্রুতিমাধুর্য  এবং অর্থদ্যোতনায় কোনো বিঘ্ন না-ঘটলে সমাসবদ্ধ পদ ফাঁক রেখে লেখাই ভালো। এসব শব্দরাশি সংলগ্ন করে বড়ো পদে পরিণত করা সমীচীন নয়। এজন্য আমরা বলি— ‘জয় বাংলা’।

 বাংলায় সমাসের ফাঁকফোকড় বৈশিষ্ট্যকে সিদ্ধ করার জন্য অসংলগ্ন সমাসের সৃষ্টি। যার কল্যাণে ফাঁক রেখে সমাসবদ্ধ পদ লিখলেও অশুদ্ধ বা অসিদ্ধ মনে করার কোনো সুযোগ নেই। যেমন : বিজয় উদ্‌যাপনের নিমিত্ত যে দিবস= বিজয় দিবস। তেমনি, শহিদ দিবস, পরিকল্পনা কমিশন, সোনার বাংলা,

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

গোরুর গাড়ি, কলুর বলদ, চন্দনাইশ যুব সমাজ, বাড্ডা বস্তি উন্নয়ন জনবন্ধু সমিতি,  শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, হাতে তৈরি, গাছে পাকা, বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সেতু, স্বাধীনতা দিবস, বাংলা বানান সংস্কার কমিটি, বিশ্ব কবি সম্মেলন, জেলা প্রশাসক, ঘোড়ার ডিম, যোগাযোগ মন্ত্রী, নিখিল ভারত যুব সংঘ, শুদ্ধ বানান চর্চা  সমাসবদ্ধ পদ হলেও ফাঁক রেখে লেখা হয়। উপর্যুক্ত শব্দরাশিগুলো বিচ্ছিন্নভাবে লেখা হলেও প্রকৃতপক্ষে  প্রত্যেকটি সমাসবদ্ধ পদ এবং সংলগ্ন নয় বলে এদের অসংলগ্ন সমাস বলা হয়।

বাংলায় সংস্কৃতের সমাসবিধির প্রভাব নগণ্য এবং শব্দচয়নে তা উপেক্ষা করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলা শব্দের মর্যাদা বা প্রমিতরূপের কেনো বিঘ্ন ঘটে না, ব্যাকরণগতভাবেও এটি স্বীকার্য। বাংলায় সমাসবদ্ধ পদ ইচ্ছানুযায়ী সংলগ্ন বা অসংলগ্ন রাখার যাবতীয় অধিকার ব্যাকরণই দিয়ে রেখেছে। অতএব, বাংলা ব্যাকরণে প্রবহমান সংস্কৃত সমাসকে অত গুরুত্ব দেওয়া অনাবশ্যক। যেখানে অনিবার্য নয় এবং সমাসবদ্ধ করা না-হলে শোভন দেখায় না; দৃষ্টিকটু মনে হয়— কেবল সেসব ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোথাও সমাসবদ্ধ পদকে একসঙ্গে লেখা বাধ্যতামূলক করার কোনো হেতু নেই। এটি লেখকের ইচ্ছানির্ভর হওয়া সমীচীন। তবে, একই লেখায় যেন ভিন্নতা না-হয়, সেটি লক্ষ রাখা সমীচীন।

সমাসের মূল লক্ষ্যই হলো একাধিক পদকে একসাথ করে শ্রুতিমধুর নতুন নতুন শব্দ তৈরি করে বাংলা ভাষার শব্দভান্ডার সম্প্রসারণ করা। অন্যভাবে সমাস বলতে বোঝায়— একপদীকরণ; সংক্ষেপণ; মিলন। আবার সংলগ্ন ও অসংলগ্ন সমাস নামে সমাসের দুইটি ভাগ রয়েছে। আমরা সাধারণত সমাস বলতে সংলগ্ন সমাসকেই বুঝে থাকি। আবার অসংলগ্ন সমাসও দেখা যায়।
যেমন— শহিদ মিনার, বিজয় দিবস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা কার্যক্রম, গড্ডলিকা প্রবাহ, উচ্চারণ বিভ্রাট ইত্যাদি হালের অসংলগ্ন সমাসনিষ্পন্ন পদের কিছু উদাহরণ। দেখলে মনে হয় জনমনে সমাস নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির মূল হোতা যেন এই অসংলগ্ন সমাস। সমাসবদ্ধ পদ ‘‘ফাঁক রাখব’’ না কি ‘‘সেঁটে লিখব’’ এই প্রশ্নের উত্তরে সাধারণত আমরা “সেঁটে লিখুন” বলি। কিন্তু এমন অনেক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় যখন দেখি কোনোটিকেই ভুল বলা সম্ভব হচ্ছে না। সাঁটা-সহ কখনো কখনো ফাঁক রেখেও লেখা হয় এমন অনেক সমাসনিষ্পন্ন পদ এখনও দেখা যায়।
সমাস নিয়ে আমার ব্যক্তিগত বোঝাপড়া হলো— কোনো পদ যদি সমাসনিষ্পন্ন হয়ে থাকে তবে সর্বদা চেষ্টা করি তা সেঁটে লিখার। আর সংলগ্ন ও অসংলগ্ন সমাস পৃথক করার জন্য বিশেষ্য-বিশেষণ সম্বন্ধ প্রয়োগ করি। যেমন— ‘ভরা যৌবন’ আর ‘উচ্চবিদ্যালয়’ উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যায়।
• ভরা যৌবন: বিশেষণ+বিশেষ্য।
• উচ্চবিদ্যালয়: বিশেষ্য+বিশেষ্য।
মূলত ‘পূর্বপদে’ বিশেষণ থাকলেই সেখানে ফাঁক রাখা সমর্থন করি। আর প্রথমে দেখানো উদাহরণগুলোর একটাও সমর্থন করি না। আমি ওই বিশেষ্য-বিশেষণ সম্বন্ধ প্রয়োগ করেই লিখি— শহিদমিনার, বিজয়দিবস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাকার্যক্রম, গড্ডলিকাপ্রবাহ, উচ্চারণবিভ্রাট। আমি দেখেছি, এই সম্বন্ধটি প্রয়োগ করলে প্রায় সকল বানানই নিয়মসিদ্ধ বানানের সাথে মিলে যায়। আর ‘প্রায়’ যেহেতু বলেছি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন শতভাগ সঠিক হবে না। ওই হাতেগোনা যেগুলো মিলে না সেগুলোকেই চূড়ান্ত বিভ্রান্তিকর বানান হিসেবে ধরে নিতে পারেন। (সমাস নিয়ে বোঝাপড়া, শুবাচ, ওয়াসিমুল ইসলাম রাব্বি)
শুবাচ গ্রুপের সংযোগ: www.draminbd.com
শুবাচ যযাতি/পোস্ট সংযোগ: http://subachbd.com/

——————————————————————————-

বাংলাদেশ ও বাংলাদেশবিষয় সকল গুরুত্বপূর্ণ সাধারণজ্ঞান লিংক

সাধারণ জ্ঞান সমগ্র

শুদ্ধ বানান চর্চা/১

শুদ্ধ বানান চর্চা/২

শুদ্ধ বানান চর্চা /৩

শুদ্ধ বানান চর্চা /৪

Language
error: Content is protected !!