ড. মোহাম্মদ আমীন
মগধের হর্য্যঙ্ক রাজবংশ (রাজত্ব৫৬৮-৫১৩ খ্রিষ্টপূর্ব)-এর শেষ শাসক ছিলেন নাগাদাসক (৪৩৭-৪১৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। শিশুনাগ(রাজত্ব ৪১৩ -৩৪৫ খ্রি.পূ.) বংশের সর্বশেষ রাজা ছিলেন মহানান্দিন ( রাজত্ব ৩৬৭-৩৪৫ খ্রি.পূ)। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৬৭ অব্দে মহাপদ্মনন্দ নামের এক বাঙালি, মগধের রাজা মহানান্দিনকে হত্যা করে মগধের সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং মগধে নন্দ রাজবংশ ( রাজত্ব ৩৪১-৩২০ খ্রি.পূ)প্রতিষ্ঠা করেন। এই বংশের রাজারা মগধ অর্থাৎ বিহার দখল করে উভয় রাজ্যকে একিভূত করে বঙ্গ-মগধ নামের একটি নতুন সাম্রাজ্যের পত্তন করে।
পুরাণমতে, মহাপদ্মনন্দ ছিলেন বাঙালি এবং নন্দীবর্ধণ ও শুদ্র বংশীয় স্ত্রীর সন্তান। অন্য এক বর্ণনামতে, মহাপদ্ম, শিশুনাগ বংশের রাজা মহানান্দিনের এক অতি সুদর্শন বাঙালি নাপিতের সন্তান। রানি নাপিতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। একদিন নাপিত, রাজা ও তার সন্তানদের হত্যা করেন। মহাপদ্মনন্দ ওই নাপিতের সন্তান। প্রথম শতকের গ্রিক ইতিহাসবেত্তা দিউদোরাসের মতে, রাজা মহানন্দ ছিলেন একজন নাপিতের সন্তান। প্রথম শতকের রোমান ইতিহাসবেত্তা কার্টিয়াসের ( Curtius ) মতে, মহাপদ্মই ছিলেন রাজা মহানান্দিরে সেই নাপিত। যিনি প্রথমে রাজাকে এবং পরে রাজপুত্রদের হত্যা করে নিজেই রাজা হয়ে যান। অল্প সময়ে তিনি ভারতবর্ষের বিশাল এলাকা জয় করে একরাট উপাধি গ্রহণ করেন।
মহাপদ্মনন্দ ৩২৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৩২০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত মগধ শাসন করেন। তঁর সাম্রাজ্য পূর্বে বাংলা, পশ্চিমে পাঞ্জাব এবং দক্ষিণে বিন্ধ্যা পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পরবর্তীকালে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য এই সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে মৌর্য্য সাম্রাজ্য স্থাপন করে। গ্রিক তথ্যমতে, ধননন্দ প্রকাশ্যে ৯৯০ মিলিয়ন ও গোপনীয়ভাবে ৯০০ মিলিয়ন মোট ১৮৯০ মিলিয়ন বা ১৮৯ কোটি স্বর্ণখণ্ডের অধিকারী ছিলেন। প্রতিটি স্বর্ণখণ্ডের ওজন ছিল ২৫০ গ্রাম। সে হিসেবে ধনন্দ মোট ৪৭ কোটি ২৫ লক্ষ কোজি স্বর্ণের মালিক ছিলেন। তিনি তাঁর রাজ্যের রাজধানী রাজগৃহ, পাটনা, গয়া, বাংলা ও পাটলিপুত্রের বিভিন্ন স্থানে খুব গোপনে সংরক্ষণ করেছিলেন। এ ছাড়া তিনি অন্যান্য যে সম্পদের মালিক ছিলেন, তার মূল্যমান ছিল কমপক্ষে ২০০০ মিলিয়ন স্বর্ণখণ্ডের তুল্য। প্রতিটি স্বর্ণ খণ্ডের ওজন ছিল ২৫০ গ্রাম। সে হিসেবে ধননন্দের সম্পদের পরিমাণ ছিল, ৩৮৯০ মিলিয়ন স্বর্ণখণ্ড বা ৯৭ কোটি ২৫ লক্ষ কেজি স্বর্ণের দামের সমান। দেখুন, কত টাকা হয়, ধরে কি না আপনার মোবাইলের সাংখ্যিক পঙ্ক্তিতে।
গ্রিক বীর আলেকজান্ডার ধননন্দের এই বিশাল সম্পদের লোভে ভারত আক্রমণে প্রলুব্ধ হয়েছিলেন। নৌকাসেতুর সাহায্যে সিন্ধু নদ পার হয়ে খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে ভারত ভূখণ্ডে পদার্পণ করেন। তিনি পূর্বতন আকামেনিদীয় সাম্রাজ্যের গান্ধার সত্রপির (প্রদেশ) অধীন ও সংলগ্ন সমন্ত রাজা ও গোষ্ঠীপ্রধানদের বশ্যতা স্বীকারের আহ্বান জানালে তক্ষশীলার রাজা অম্ভি (গ্রিক উচ্চারণে অমফিস) আত্মসমর্পণ করেন। যারা তাঁর আহ্বান মেনে নেননি তিনি তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। আলেকজান্ডার, পুষ্কলাবতীর রাজা অষ্টককে পরাভূত করেন, অশ্মক জাতিও তার নিকট পরাভূত হয়। ঝিলাম-রাজ পুরু হিদাসপিসের যুদ্ধে (বর্তমান ঝিলাম ও পাকিস্তান) পরাজিত হন। আলেকজান্ডার পাঞ্জাবের অধিকাংশ অঞ্চল এবং রাভি নদীর উপকূলবর্তী রাজ্যসমূহ দখল করে বিপাশা নদী পর্যন্ত অগ্রসর হন। কিন্তু নন্দের সম্পদের কানাকড়িও হস্তগত হয়নি।
আলেকজান্ডার নন্দ সাম্রাজ্যের গঙ্গারিডাই (অধুনা বাংলাদেশের উত্তর বঙ্গ) ও প্রসিঅ (পাটলিপুত্র) আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। গঙ্গারিডাই ও প্রসিঅ রাজ্যের রাজা ধন-নন্দ বিশাল একটি বাহিনী নিয়ে আলেকজান্ডারের মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হন। প্লুটার্ক লিখেছেন, পোরাসের সঙ্গে যুদ্ধের পর মেসিডোনিয়ার সৈন্যরা হতাশাগ্রস্ত হড়ে পড়ে এবং ভারতবর্ষের আরও অভ্যন্তরে প্রবেশে অনিচ্ছুক হয়ে পড়ে। তারা জানতে পারে, ২৩০ স্টেডিয়া বিস্তৃত ও ১০০০ ফুট গভীর গঙ্গা নদীর পাশের সমস্ত তীর সশস্ত্র যোদ্ধা, ঘোড়া এবং হাতি দ্বারা সম্পূর্ণভাবে আবৃত। গঙ্গারিডাই ও প্রাসিঅ-এর রাজা ২,০০,০০০ পদাতিক, ৮০,০০০ অশ্বারোহী বাহিনী, ৮,০০০ যুদ্ধরথ ও ৬,০০০ হস্তিবাহিনী নিয়ে অপেক্ষা করছেন। এ অবস্থায়, বৃহত্তর ভারতীয় সেনাবাহিনীর সম্মুখীন হওয়ার ভয়ে ভীত ক্লান্ত আলেকজান্ডা-বাহিনী হাইফেসিস অর্থাৎ বর্তমান বিপাশা নদীর তীরে বিদ্রোহ করে পূর্বদিকে অগ্রসর হতে অস্বীকার করে। আলেকজান্ডার সেনা আধিকারিক কোনাসের সঙ্গে আলোচনা করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। প্রতিরোধের কথা জানতে পেরে আলেকজান্ডার, সৈন্যদের রণক্লান্তির দোহাই দিয়ে ভারত অভিযান বন্ধ করে গ্রিসে ফিরে যান। প্রত্যাবর্তনের পথে তিনি বেলুচিস্তান ও পাঞ্জাব অধিকার করেন; ঝিলাম নদী ও সিন্ধু নদের অন্তবর্তী সকল রাজ্য তার অধিগত হয়।
শূদ্র ও বাঙালি ছিলেন বলে উচ্চবংশীয় হিন্দুরা নন্দদের বিরুদ্ধাচরণ শুরু হরে। এ অবস্থায়, খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০ অব্দে গুপ্ত বংশের প্রতিষ্ঠাতা মৌর্য্যগুপ্ত, চাণক্যের সহায়তায় ধননন্দকে পরাজিত করে মৌর্য্য বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। ধনন্দকে এক কাপড়ে রাজ্যছাড়া করা হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২৩ অব্দে তিনি মারা যান। তাঁর এত সম্পদ কোথায়? আর একদিন লেখা হবে- এ নিয়ে।