ড. মোহাম্মদ আমীন
‘সর্বজনীন’ ও ‘সার্বজনীন’ উভয় শব্দ শুদ্ধ কিন্তু অর্থ ভিন্ন তাই। একটি বিশেষ্য এবং অন্যটি বিশেষণ। তাই দুটো শব্দকে অভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা আদৌ সমীচীন নয়। অনেকে ‘সর্বজনীন’ অর্থে ‘সার্বজনীন’ লিখে থাকেন। শব্দ দুটোর আভিধানিক অর্থ না-জানার জন্য এমন ভুল হয়। ‘সর্বজনীন’ শব্দের অর্থ ‘সকলের মঙ্গল বা সবার হিত বা কল্যাণ বা সকলের মঙ্গলের জন্য কৃত বা সকলের জন্য উদ্দিষ্ট’।
লেখার সময় কোনটি লিখবেন, এ নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হলে ‘সর্বজনীন’ লিখুন।তা হলে অন্তত ভুল হওয়ার আশঙ্কা বহুলাংশে কমে যাবে। কারণ, সাধারণত যে অর্থে ‘সার্বজনীন’ লেখা হয় নব্বই ভাগ ক্ষেত্রে সেটি ওই অর্থ-প্রকাশে যথোচিত নয়, বরং ‘সর্বজনীন’ শব্দই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উপযুক্ত।
বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান মতে, বাক্যে বিশেষ্য হিসেব ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘সর্বজনীন’ শব্দের আভিধানিক অর্থ, সর্বসাধারণের জন্য অনুষ্ঠিত, বারোয়ারি, সর্বসাধারণের সহায়তায় কৃত, সকলের জন্য মঙ্গলকর বা কল্যাণকর, সবার জন্য হিতকর, সবার মঙ্গলের জন্য কৃত, সকলের জন্য উদ্দিষ্ট। যেমন : ভালোবাসা সর্বজনীন বিষয়। ফল সর্বজনীন খাদ্য। মানবাধিকার সর্বজনীন অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। কোনো ধর্মের অবতারই সর্বজনীন নয়।
বাক্যে বিশেষণ হিসেব ব্যবহৃত ‘সার্বজনীন’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘সবার মধ্যে প্রবীণ, জ্যেষ্ঠ’। যেমন: ‘জিম্বাবুয়ের বর্তমান রাষ্ট্রপতি রবার্ট মুগাবে (জন্ম ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি ) সার্বজনীন নেতা।’ [ কারণ ৯৪ বছর বয়সি এ রাষ্ট্রনায়কের চেয়ে অধিক বয়স্ক নেতা বিশ্বে আর কেউ নেই।]
অবশ্য প্রবীণ শব্দটি ‘শ্রেষ্ঠ’ অর্থ প্রকাশে ব্যবহার করা হলে সেক্ষেত্রে ‘সার্বজনীন’ শব্দের অর্থ সম্প্রসারিত হয়। যেমন: ‘নেলসন মেন্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার সার্বজনীন নেতা। কিন্তু ‘শ্রেষ্ঠ’ অর্থে ‘সার্বজনীন লেখা সমীচীন নয়। কারণ ‘শ্রেষ্ঠ’ প্রকাশের জন্য বাংলায় অনেক যুতসই ও বিকল্প শব্দ রয়েছে। ফলে, ‘নেলসন মেন্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বজনীন নেতা ‘ লেখাই বিধেয়। সবার জন্য প্রযোজ্য, সবার জন্য হিতকর প্রভৃতি অর্থে ‘সার্বজনীন’ লেখা ঠিক নয়।
‘সার্বজনীন দুর্গাপূজায় আপনাকে স্বাগত’। এর অর্থ সবার মধ্যে প্রবীণ বা সবার মধ্যে জ্যেষ্ঠ দুর্গাপূজায় আপনাকে স্বাগত। কথাটির যৌক্তিকতা কতটুকু তা পরের বিষয়। তবে এখানে ‘সার্বজনীন’ বলার চেয়ে, ‘সর্বজনীন’ বলাটাই যে উত্তম হতো – এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
সূত্র: বাংলা ভাষার মজা, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.।
ব্যাকরণের আলোচনায় বাংলা ধাতুগণের নির্দিষ্ট শ্রেণিভাগ রয়েছে। কর্, মার, মিটা, উঠ্, লিখ্, মুচড়া, চাহ্, খা, শু, হ প্রভৃতি সেসব ধাতুগণের কয়েকটি। এসব ধাতুর সঙ্গে কাল ও পুরুষ অনুসারে বিভক্তি (প্রত্যয়) যুক্ত করে বাক্যে ক্রিয়াপদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বাংলা ভাষায় এই নির্দিষ্ট ধাতুশ্রেণির বাইরে আরও একপ্রকার ধাতু রয়েছে, যা ‘মাইকেলি ধাতু’ নামে পরিচিত। মাইকেল মধুসূদন দত্ত এধরনের ধাতুর ব্যবহার প্রচলন করেন বলে তাঁর নামানুসারে এরূপ নামকরণ করা হয়েছে। মাইকেলি ধাতু প্রকৃতপক্ষে কোনো ধাতু নয়, মূলত এগুলো কতিপয় বিশেষ্য ও বিশেষণ। মাইকেল মধুসূদন দত্ত সেসব বিশেষ্য-বিশেষণের সঙ্গে ধাতুর অনুকরণে কাল ও পুরুষ অনুসারে বিভক্তি যুক্ত করে ক্রিয়াপদ হিসেবে ব্যবহার করেছেন বলে এধরনের শব্দ ‘মাইকেলি ধাতু’ তকমা পেয়ে গিয়েছে। পবিত্র থেকে পবিত্রি (পবিত্র করি), লক্ষ থেকে লক্ষি (লক্ষ করি/করে), উত্তর থেকে উত্তরিলা (উত্তর দিল/দিলো), ইচ্ছা থেকে ইচ্ছি (ইচ্ছে /করি/করে/হচ্ছে) প্রভৃতি এই শ্রেণিভাগের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নিম্নে মাইকেল মধুসূদন দত্তের “বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ” থেকে দুইটি পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করা হলো, যেখানে শব্দের এরূপ প্রয়োগ ঘটানো হয়েছে—
১. ‘… উত্তরিলা কাতরে রাবণি;—
“হে পিতৃব্য, তব বাক্যে ইচ্ছি মরিবারে! …” ‘
২. ‘… উত্তরিলা রথী
রাবণ-অনুজ, লক্ষি রাবণ-আত্মজে; …’
All Link : শুবাচে প্রকাশিতগুরুত্বপূর্ণ লেখা
শুদ্ধ বানান চর্চা এবং বিসিএস বাংলা