এবি ছিদ্দিক
‘আমাদেরকে’, ‘তোমাদেরকে’, ‘তাদেরকে’, ‘আপনাদেরকে’ প্রভৃতি রূপ আমাদের কাছে একেবারেই পরিচিত। অনেকে বহুবচন নির্দেশক সর্বনামের শেষে এরূপ ‘-কে’ বিভক্তি যুক্ত করাকে অশুদ্ধ বলে উল্লেখ করে থাকেন, যা মোটেও সমীচীন নয়। অর্থাৎ, প্রমিত বাংলায় বহুবচন নির্দেশক সর্বনামের শেষে ‘-

কে’ বিভক্তি যুক্ত করতে কোনো বাধা নেই। তবে হ্যাঁ, তা অবশ্যই প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে যুক্ত করতে হবে। তা না-হলে বাক্যের অর্থ বদলে যেতে পারে। আর তাই, প্রায়োগিক ক্ষেত্রভেদে বাক্যের মধ্যে বহুবচন নির্দেশক সর্বনামের শেষে ‘-কে’ বিভক্ত যুক্ত করার নিয়মের আলোচনা খুব বেশি জরুরি না-হলেও একেবারে এড়িয়ে যাওয়ার মতোও নয় এবং আমিও এড়িয়ে যাচ্ছি না।
প্রথমে একটি ছোট্ট ঘটনা দিয়ে আমার মূল লেখা শুরু করছি—
শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করেই খোকন স্যার বললেন, “তাড়াতাড়ি কর, আমাদের শহিদ মিনারে গিয়ে ফুল দিতে হবে।” স্যারের কথা শোনার পর ছাফিয়া, সায়িমাকে ফিসফিস করে বলল, “আপু, আমাদের স্কুলে শহিদ মিনার আছে, অথচ আমি তা তিন বছরেও জানতে পারিনি!” “আমাদের স্কুলে শহিদ মিনার আসবে কোত্থেকে?” ছাফিয়াকে এভাবে বিস্ময়ের সঙ্গে বলতে দেখে সায়িমা জিজ্ঞেস করল। “ওই যে, খোকন স্যার ‘আমাদের শহিদ মিনারে ফুল দিতে যেতে হবে’ বলেছেন,” ছাফিয়া জবাব দিল। ছাফিয়ার জবাব শুনে তার (ছাফিয়ার) মাথায় আদরের সঙ্গে থাপ্পড় মেরে সায়িমা বলল, “আরে পাগলি, ‘আমাদের শহিদ মিনারে যেতে হবে’ মানে ‘এখানে আমরা যারা আছি, তাদের প্রত্যেককে শহিদ মিনারে যেতে হবে’, স্যার এমনটি বুঝিয়েছেন। ওই যে, আমরা প্রতিবছর খালি পায়ে স্যারদের পেছনে পেছনে হেঁটে প্রভাতফেরির গান গাইতে গাইতে কলেজের শহিদ মিনারে যাই, সেটি আরকি! বুঝেছিস?” “অ্যাঁ!” ছাফিয়া নিজের বড়ো বড়ো চোখ দুটো আরও ভড্ডা করে বিস্ময়ের সঙ্গে বলল। সে নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করল, ” ‘আমাদেরকে শহিদ মিনারে যেতে হবে’ বললে স্যারে কী এমন অসুবিধা হতো?”
খোকন স্যার বাক্যটিতে ‘আমাদের’-এর সঙ্গে ‘-কে’ বিভক্তি যুক্ত করে দিয়ে ‘আমাদেরকে’ বললে কোনো সমস্যা হতো না, অধিকন্তু ‘আমাদেরকে’ বললে বাক্যটিতে আর কোনো দ্ব্যর্থতা থাকত না; ছাফিয়ার মতো সাধারণ বাংলাভাষীও বিভ্রান্তিতে পড়ত না।
এবার মূল আলোচনায় আসা যাক। বাক্যের মধ্যে ‘আমাদের’, ‘তাদের’, ‘আপনাদের’, ‘তোমাদের’ প্রভৃতি শব্দ দুইভাবে ব্যবহৃত হতে পারে। প্রথম ক্ষেত্রে এধরনের শব্দগুলো সম্বন্ধ পদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তখন বাক্যের ক্রিয়াপদের সঙ্গে এরূপ শব্দগুলোর কোনো সম্পর্ক থাকে না। ক্রিয়াপদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে না বলে এগুলোর কারকও নির্ণয় করা যায় না। যেমন: তোমাদের পরীক্ষা দরজায় কড়া নাড়ছে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বাক্যের মধ্যে এরূপ শব্দগুলো ‘কর্ম’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তখন এরূপ শব্দগুলো কর্মকারক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। যেমন: তোমাদের যেতে হবে।
কিন্তু এমন কিছু বাক্য আছে, যেগুলোতে আলোচ্য রূপগুলোর প্রয়োগের ধরন বা পার্থক্য উল্লেখ করে না-দিলে পাঠক ওই বাক্যগুলোর যথাযথ ভাব অনুধাবনে ব্যর্থ হতে পারেন কিংবা একটির স্থলে অন্যটি বুঝে নিতে পারেন। সেরূপ বাক্যগুলোর ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ভাগে উল্লেখ-করা অর্থ বোঝাতে আলোচ্য

সর্বনামগুলোর শেষে ‘-কে’ বিভক্তি যুক্ত করা তো বাহুল্য নয়ই, বরং জরুরিও। আমার ধারণা, নিচে উল্লেখ-করা উদাহরণগুলো ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারলে এবিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে:
১. সারা দিন ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত টম, ছোটো আর ছাফিয়া মিলে পাহাড়ের পাশের তাবুটি ভাড়া করল। সন্ধ্যায় তাবু দেখভালের কর্মী এসে বললেন, “রাতে আপনাদের তৈরি করা খাবারই দেওয়া হবে।” এখন, বাক্যটিতে ‘আপনাদের’ সম্বন্ধ পদ বিবেচনা করলে অর্থ দাঁড়াবে— ‘রাতে টমদের সেই খাবারগুলো দেওয়া হবে, যেগুলো তারা তৈরি করে রাখবে।’ যদি টমরাও এমনটি অনুধাবন করে, তাহলে বিশ্রাম বাদ দিয়ে রাতের খাবার প্রস্তুত করাই হবে তাদের মূল কাজ।
আবার, বাক্যটিতে ‘আমাদের’ কর্ম (কর্মকারক) বিবেচনা করলে অর্থ দাঁড়াবে— ‘রাতের খাবার নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা করতে হবে না। কারণ, তাবু কর্তৃপক্ষ টমদের জন্যে রাতের খাবার তৈরি করে রাখবে।’ টমরাও এরূপ উপলব্ধি করে থাকলে নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিতে পারবে।
মোদ্দা কথা, এরূপ ক্ষেত্রে পাঠক বা শ্রোতাকে বিভ্রান্তিতে না-ফেলতে দ্বিতীয় ভাগে উল্লেখ-করা অর্থ নির্দেশ করতে ‘আপনাদের’-এর শেষে ‘-কে’ বিভক্তি যুক্ত করে ‘আপনাদেরকে’ লেখা বা বলাটা লেখক কিংবা কাথিকের দায়িত্ব।
২. সানজু, বৃষ্টি আর সুমাইয়া মিলে বাড়ির উঠোনে খেলছিল। হঠাৎ সাফা এসে বলল, “তোদের আব্বু ডাকছেন।” এখন, সাফার বাক্যটিতে ‘তোদের’ সম্বন্ধ পদ বিবেচনা করলে অর্থ দাঁড়াবে— ‘সানজু, বৃষ্টি আর সুমাইয়াকে তাদের নিজ নিজ আব্বু ডাকছেন।’ তারাও এমনটি অনুধাবন করলে প্রত্যেকে নিজ নিজ আব্বুর কাছে চলে যাবে।
আবার, সাফার বাক্যটিতে ‘তোদের’ কর্ম (কর্মকারক) বিবেচনা করলে অর্থ দাঁড়াবে— ‘সানজু, বৃষ্টি আর সুমাইয়াকে সাফার আব্বু ডাকছেন।’ সানজুরাও এমনটি বুঝে থাকলে সকলে একযোগে সাফার আব্বুর সামনে গিয়ে হাজির হবে।
অতএব, সানজুরা যাতে এরূপ বিভ্রান্তিতে না-পড়ে, সে লক্ষ্যে দ্বিতীয় ভাগে উল্লেখ-করা অর্থ নির্দেশ করতে ‘তোদের’-এর শেষে ‘-কে’ বিভক্তি যুক্ত করে ‘তোমাদেরকে’ বলাটা সাফার দায়িত্ব।
৩. প্রতিদিন আপিসের কাজে নিজেদের ব্যাগ আনতে হয় বলে শুভ্ররা বেশ বিরক্ত। এবিষয়ে সুরাহা চাইলে আপিসের বড়োবাবু বলেন, “আগামীকাল থেকে তাঁদের ব্যাগ আর আনতে হবে না।” বড়োবাবুর বাক্যটিতে ‘তাঁদের’ সম্বন্ধ পদ বিবেচনা করা হলে বাক্যটির প্রাসঙ্গিক অর্থ দাঁড়াবে— আগামীকাল থেকে শুভ্রদের নিজেদের ব্যাগ আর আনতে হবে না। হয়তো আপিস থেকে ব্যাগ দেওয়া হবে, নয়তো অন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
আবার, একই বাক্যে ‘তাঁদের’ কর্ম (কর্মকারক) বিবেচনা করলে অর্থ দাঁড়াবে— ‘ব্যাগের প্রয়োজন শেষ হয়েছে। তাই, আগামীকাল থেকে শুভ্রদের আর ব্যাগ নিয়ে আপিসে আসতে হবে না।’
এরূপ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ভাগে উল্লেখ-করা অর্থ নির্দেশ করতে ‘তাঁদের’-এর সঙ্গে ‘-কে’ বিভক্তি যুক্ত করে ‘তাঁদেরকে’ বলাটা বড়োবাবুর দায়িত্ব।
অতএব, বাক্যকে সম্পূর্ণভাবে দ্ব্যর্থহীন রাখতে বহুবচন নির্দেশক সর্বনামের শেষে ‘-কে’ বিভক্তি যুক্ত করা মোটেও অসংগত নয়।
[ জ্ঞাতব্য: বাংলা একাডেমির ‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ অনুসারে সর্বনামের বহুবচনের ক্ষেত্রে ‘-কে’ বিভক্তি যুক্ত করতে কোনো বাধা নেই। ]
সূত্র: সর্বনামের বহুবচনে কে-বিভক্তির প্রয়োগ, এবি ছিদ্দিক, শুদ্ধ বানান চর্চা(শুবাচ)।
অনুসজ্জা: মিনহা সিদ্দিকা
বিসিএস প্রিলি থেকে ভাইভা কৃতকার্য কৌশল
ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা বইয়ের তালিকা
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশবিষয়ক সকল গুরুত্বপূর্ণ সাধারণজ্ঞান লিংক
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন/১
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন/২
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন /৩
ইউরোপ মহাদেশ : ইতিহাস ও নামকরণ লিংক
কি না বনাম কিনা এবং না কি বনাম নাকি
মত বনাম মতো : কোথায় কোনটি এবং কেন লিখবেন
ভূ ভূমি ভূগোল ভূতল ভূলোক কিন্তু ত্রিভুবন : ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ