সহজসূত্রে সমাস
প্রাণী + সম্পদ = ‘প্রাণীসম্পদ’ নাকি ‘প্রাণিসম্পদ’ ?
☆ মুসলিম + সভ্যতা = ‘মুসলিম সভ্যতা’ নাকি ‘মুসলিমসভ্যতা’ ?
☆ মহা + রাজা = ‘মহারাজা’ নাকি ‘মহারাজ’ ?
এই বিভ্রান্তিগুলো দূর করতে খুব সহজ কিছু সমাসঘটিত বানানের নিয়ম মনে রাখুন। ঘাবড়ে যাওয়ার কোনও কারণ নেই।
《》সমাসবদ্ধ শব্দের মাঝে স্পেস বসবে না। প্রয়োজনে হাইফেন বসতে পারে। যেমন-
ভুল : ‘ইট নির্মিত’, ‘মা বাবা’, ‘মুসলিম সভ্যতা’, ‘ফেসবুক বন্ধু’।
শুদ্ধ : ‘ইটনির্মিত’, ‘মা-বাবা’, ‘মুসলিমসভ্যতা’, ‘ফেসবুকবন্ধু / ফেসবুক-বন্ধু’।
তবে অসংলগ্ন সমাসের ক্ষেত্রে ফাঁক রাখা যায়। যেমন: বিজয় দিবস, শহিদ মিনার, বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন।
《》দুটি অর্থপূর্ণ শব্দ প্রথমটি ‘ইন’-ভাগান্ত (ঈ-কার) হলে তা বদলে ই-কার হবে। যেমন-
[প্রাণী= প্রাণ+ ইন (ঈ)।
এবার ইন-ভাগান্ত শব্দ ‘প্রাণী’র সাথে আরেকটি অর্থপূর্ণ শব্দ ‘সম্পদ’ যোগ করে সমাস করুন।]
সুতরাং প্রাণী + সম্পদ = প্রাণিসম্পদ।
তদ্রূপ
পরীক্ষার্থী + গণ =পরীক্ষার্থিগণ।
মন্ত্রী + সভা = মন্ত্রিসভা।
《》মূল শব্দ ‘রাজা’। কিন্তু সমাস হলে পরিণত হবে ‘রাজ’।
উদাহরণ : ‘নায়করাজ’, ‘মহারাজ’, ‘রাজমিস্ত্রি’ ‘রাজগণ’ শুদ্ধ।
(‘মহারাজা’, ‘রাজাগণ’ ইত্যাদি ভুল।)
《》 মূল শব্দ ‘নিশি’, ‘রাত্রি’। কিন্তু সমাস হলে পরিণত হবে ‘নিশ’ বা ‘রাত্র’।
উদাহরণ : ‘অহর্নিশ’, ‘দিবারাত্র’ শুদ্ধ
(‘অহর্নিশি’/’দিবারাত্রি’ ভুল)।
《》ডিম পাড়ে হংসী। কিন্তু তা বলে ‘হংসীডিম্ব’ লেখা চলবে না। লিখতে হবে ‘হংসডিম্ব’।
তদ্রুপ ‘ছাগীদুগ্ধ’, ‘ছাগীশিশু’, ‘কুকুরীছানা’ এইসব লেখা চলবে না। সেক্ষেত্রে ‘ছাগদুগ্ধ’, ‘ছাগশিশু’, ‘কুকুরছানা’ বসবে।
《》ষষ্ঠী তত্পুরুষ সমাসে ‘পিতা’, ‘মাতা’, ‘ভ্রাতা’ সরাসরি বলা যাবে না। সেক্ষেত্রে ‘পিতৃ’, ‘মাতৃ’, ‘ভ্রাতৃ’ বসবে। যেমন-
ভুল : ‘পিতাভূমি’, ‘মাতাভাষা’, ‘ভ্রাতাহত্যা’।
শুদ্ধ : ‘পিতৃভূমি’, ‘মাতৃভাষা’, ‘ভ্রাতৃহত্যা’।
《》বহুব্রীহি সমাসে ‘অক্ষি’, ‘নাভি’, ‘চূড়া’, ‘কর্ম’ ‘জায়া’ (বউ) শব্দগুলো বদলে হবে ‘অক্ষ’, ‘নাভ’, ‘চূড়’, ‘জানি’, ‘কর্মা’। যেমন-
ভুল : ‘কমলাক্ষি’, ‘পদ্মনাভি’, ‘চন্দ্রচূড়া’, ‘যুবজায়া’, ‘করিতকর্ম’।
শুদ্ধ : ‘কমলাক্ষ’, ‘পদ্মনাভ’, ‘চন্দ্রচূড়’, ‘যুবজানি’, ‘করিতকর্মা’।
_____________
ব্যতিক্রম :
《》বিশেষণকে সমাসের সাথে গুলিয়ে ফেলা যাবে না।
‘সুন্দর ফুলটা দাও’, এখানে বলা যাবে না ‘সুন্দরফুলটা’।
‘সুন্দর’ এখানে বিশেষণ হয়েছে বটে সমাসবদ্ধ হয়নি।
《》এটি ছাড়াও আরও কিছু ক্ষেত্রে সমাস করা যাবে না। নিচে খুব মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করুন এবং পক্ষে-বিপক্ষে শক্তিশালী মতামত দিন।-
♦“সে দায়িত্ব পালন করতে চায়” নাকি “সে দায়িত্বপালন করতে চায়”?
আমরা জানি, সমাসবদ্ধ শব্দে মাঝে স্পেস দেয়া যাবে না। তবে এটি বাংলা বানানের অন্যতম বিভ্রান্তিকর একটি নিয়ম। কয়েকটি ক্ষেত্রে এটি জটিলতার জন্ম দেয়। দেখানো হলো।
☆স্পেস নিয়ে একটি বিভ্রান্তি হল: আইন, নীতি, সংস্থা ইত্যাদি দীর্ঘ কলেবরের শিরোনামের ক্ষেত্রে অনেক সময় সমাসবদ্ধ পদকেও সমাস করা হয় না। যেমন: ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়’, ‘জাতীয় পরিবেশ নীতি’…. সমাসের নিয়মানুসারে এখানে হওয়ার কথা ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়’ ‘জাতীয় পরিবেশনীতি’।
কিন্তু এগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিবন্ধনের সাথে এবং আইনের সাথে ওতোপ্রোতভাবে এত আগে থেকেই এমনভাবে আছে, যখন বাংলা নতুন বানানরীতিই প্রণীত হয়নি। তাছাড়া এগুলো সাধারণত খুব দীর্ঘ শিরোনাম হয়ে থাকে বলে সমাস করলে অস্বাভাবিক ঠেকে। সবকিছু বিবেচনায় এসব ক্ষেত্রে সমাস বর্জন করা যেতে পারে।
☆আরও একটি বড় সমস্যা হল- কারকের শূন্য বিভক্তি এবং সমাস নিয়ে একটু দ্বিধা তৈরি হতে পারে। যেমন-
“তোমার কবি পরিচয়টি আমার ভাল লাগছে না।”- এই বাক্যে ‘কবি’ শব্দটি বিশেষ্য হলেও শূন্য বিভক্তি হিসেবে বসে বিশেষণের ভূমিকা পালন করছে। বিশেষণ পদকে সমাসবদ্ধ করা আবশ্যক নয় বলে এখানে স্পেসহীন ‘কবিপরিচয়টি’ লেখা ভাল দেখায় না।
‘কবিপরিচয়টি’ ভাল না শোনালেও কেউ যদি মনে করে ‘টি’ বাদ দিয়ে ‘কবিপরিচয়’ সমাসবদ্ধ হয়ে ভাল শোনাতে পারে, তবে সে স্বাধীনতা তার আছে। যেমন বলা যেতে পারে- “তোমার কবিপরিচয় আমার ভাল লাগছে না।”
এ ক্ষেত্রে ‘কারক’ নাকি ‘সমাস’ কোনটি ভাল দেখাচ্ছে তা বুঝতে ষষ্ঠেন্দ্রিয় বা কমন সেন্স খাটাতে হবে।
কমন সেন্সের অন্য উদাহরণ : “দায়িত্ব পালনের জন্য এসেছি”… এখানে ‘দায়িত্ব পালন’ স্পেস না দিলেও চলছে কেননা এটি কারকের শুন্য বিভক্তি হিসেবে বসতে পারে, একইভাবে বলা যায় “ভাত খাওয়ার জন্য এসেছি”… এখানে ‘ভাত’ শুন্য বিভক্তি হিসেবে ‘ভাত-খাওয়া’ লিখে সমাস করার দরকার নেই।
কিন্তু ‘দায়িত্বপালনসংক্রান্ত মিটিং’ এখানে সমাস করতে হবে বাধ্যতামূলকভাবে, স্পেস দেয়া চলবে না। ‘দায়িত্ব পালন সংক্রান্ত’ লিখলে ভুল হবে, কেননা পরবর্তীতে কোন যৌগিক ক্রিয়া বা phrase নেই।
ব্যাখ্যা : আরও সূক্ষ্মভাবে জানুন। সমাসবদ্ধ বা স্পেসহীন করতে গিয়ে যদি দেখা যায় যে দ্বিতীয় শব্দটি পরে কোনও যৌগিক ক্রিয়া বা phrase-এর দিকে বেশি টানছে তবে সেটি সমাসবদ্ধ না করে ছেড়ে দিতে হবে। যেমন-
ভুল : “সে গান-করা ভালবাসে।”
শুদ্ধ : “সে গান করা ভাসবাসে।”
‘করা ভালবাসে’ এখানে এমন একটি phrase যা ‘গান’-এর সাথে ‘করা’-কে জয়েন্ট অর্থাৎ সমাস হতে দিচ্ছে না। একইভাবে ‘পালন করার জন্য’ এই phraseটিও ‘দায়িত্ব পালন’ কে সমাসবদ্ধ হতে দেয়নি।
আসলেই এই নিয়মটি জটিল। সাহিত্যের পাঠাভ্যাসের মাধ্যমে নান্দনিকতার সেন্স তৈরি করা ছাড়া এটি আয়ত্ত নাও হতে পারে।
Crispy Arif, সহজসূত্রে সমাস, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)।
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশবিষয়ক সকল গুরুত্বপূর্ণ সাধারণজ্ঞান লিংক
শুদ্ধ বানান চর্চা প্রমিত বাংলা বানান বিধি : বানান শেখার বই
প্রায়শ ভুল হয় এমন কিছু শব্দের বানান/২