ইউসুফ খান
বর্ধমানের বাংলায় আমরা বলি – ‘তোকে আমি এঁচ্ড়ে দোবো’। হিন্দিতে বলে এন্চ্না। ভদ্দলোকের বাংলায় সেটাই – আঁচড়ানো। ‘মা, দ্যাখো না বুন্টি আমাকে নখ দিয়ে আঁচ্ড়ে দিয়েছে’। ‘মুরগিটা মাটি আঁচ্ড়াচ্ছে’। ‘আমার জীবন থাকতে কাউকে আমার বাচ্চার গায়ে একটা আঁচড় কাটতে দেবো না’।
ছুতোরের একটা হেতেরের নাম আঁচড়া, যেটা টান দিয়ে কাঠে গভীর দাগ দেয়া যায়, আঁচড় কাটা যায়। ধানের জমি নিড়োনোর

যন্ত্রর নামও আঁচড়া, এমনকি লাঙলকেও বলতো আঁচড়া।
আঁচড়ের মধ্যে একটা টান দেবার ব্যাপার আছে। খাব্লে দাগ দেয়াকে বলে খামচানো আর টেনে দাগ দেয়াকে বলে আঁচড়ানো। ‘তুলির এক আঁচড়ে শিল্পী একটা নারীর মুখ ফুটিয়ে তুললেন’। ‘বৌটা মাতাল বরটাকে চুল ধরে টেনে হিঁচড়ে বাড়ি নিয়ে গেলো’, ‘মাস গেলে ওই কটা টাকাতেই টেনে-হিঁচড়ে দিন চালাই’। জমিতে হালকা করে লাঙল টানাকেও বলে আঁচড়ানো। ‘একটু আঙুল দিয়েই না হয় চুলটা আঁচড়ে নে’।
আঁচড় কাটলে যে দাগটা পড়ে তাকে এখন বলে আঁচড়ের দাগ বা আঁচড়। এর জায়গায় পুরনো বাংলায় একটা সুন্দর কথা ছিলো – আঁচি বা আঁজি। এখনও ইটের গাঁথনির দুটো ইটের মাঝখানের দাগটাকে বলে আঁজি। আঁজিতে সিমেন্ট দিয়ে মসৃণ করাকে বলে আঁজি মারা। অমাবস্যার রাতে পাটকাঠিতে আগুন জ্বালিয়ে অন্ধকারের বুক চিরে লম্বা লম্বা দাগ টানাকেও বলে আঁজি টানা। আগেকার দিনে ব্যবসায়ীরা হিসেবের খাতায় দিনের প্রথমে যে আঁচড়টা দিতো সেটাও আঁজি। সেটা দেখতে এরকম ৺৭, লোকে বলে এটা সিদ্ধিদাতা গণেশের মাথা শুঁড় আর চোখ।
সাপ বুকে হেঁটে চলে গেলে ধুলোমাটিতে তার চলার যে দাগ পড়ে থাকে, তাকে বলে সাপের আঁজি বা সাপের আঁচি। যে বেদে হেলায় সাপেরে খেলায় সে সাপের আঁচি দেখে বলে দিতে পারে সেটা কোন সাপ, কতক্ষণ আগে, কোন দিক থেকে এসে, কার বাড়ির, কোন কোণের দিকে গেছে। কারণ –
সাপের আঁচি যে বেদে চেনে!
মানে অভিজ্ঞ চোখ সামান্য অভিজ্ঞান দেখেই অনেক কিছু বলে দিতে পারে।
বাংলায় সংস্কৃতর বেনো জল ঢুকিয়ে সাবেকী জল সব বের করে দেওয়া হয়েছে। নোনা জলে উর্বর পলিমাটি চাপা পড়ে গেছে।
তাই সাপের আঁচি-পড়া পথে পথে এখন সাপের হাঁচি পড়া শোনা যাচ্ছে। লোকে বলে সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে।
ইউসুফ খান, কলকাতা, ২০২০ জুন ০৭
সূত্র: সাপের হাঁচি, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
অসি ও মসি-র গল্প, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
না ঘরকা না ঘাটকা-র গল্প, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
ঢাকাই বুলি: কলকাতার চিঠি, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
পদ্মাপারের পদবি, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
ঈশ্বরচন্দ্র কেন শর্ম্মা, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
ঘেটো লেটো নজরুল, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
ঈশ্বরচন্দ্র কেন শর্ম্মা, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
বাঁকুড়া থেকে বগুড়া, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
বেশ্যারা প্রস্টিটিউট নয়, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
ইত্যাদি প্রভৃতি প্রমুখ. ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
শুবাচ গ্রুপ এর লিংক: www.draminbd.com
All Links/2 শুবাচির পশ্ন থেকে উত্তর
বাংলা শব্দের পৌরাণিক উৎস, ড. মোহাম্মদ আমীন
মৌলবাদ ও মৌলবাদী শব্দের অর্থ কী জানতে চাই
বাংলা ভাষার মজা, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পবিলেকশন্স লি.
বহুল ব্যবহৃত কিছু শব্দের শুদ্ধ বানান/১২ ড. মোহাম্মদ আমীন