ড. মোহাম্মদ আমীন
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: বাংলা সাহিত্যের নীললোহিত
একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলার ডাসার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর সাহিত্যিক ছদ্মনাম নীললোহিত। সৈয়দ আবুল হোসেন ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। জীবদ্দশায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কয়েক বার সৈয়দ আবুল হোসেনের আমন্ত্রণে ডাসার এসেছেন। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসাবে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে বহুল পরিচিত ছিলেন। পূর্ব-পশ্চিম, সেই সময়, প্রথম আলো ও একা এবং কয়েকজন তার কালজয়ী ঐতিহাসিক উপন্যাস।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আধুনিক বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ-পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে বিবেচিত। একই সঙ্গে তিনি আধুনিক ও রোমান্টিক কবিও হিসেবেও খ্যাত ছিলেন। তাঁর কবিতার অনেক পঙ্ক্তি সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ধ্বনিত হয়।তাঁর “কেউ কথা রাখেনি” কবিতাটি কে না শুনেছে? “নীললোহিত”, “সনাতন পাঠক”, “নীল উপাধ্যায়” ইত্যাদি তাঁর লেখক ছদ্মনাম । তবে নীললোহিত নামটি সমধিক পরিচিত। কাকা বাবু ও নীল মানুষ তাঁর সৃষ্ট দুটি বিখ্যাত চরিত্র।
চার বছর বয়সে তিনি পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশ ছেড়ে কলকাতা চলে যান। জন্ম বাংলাদেশে হলেও বড়ো হয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। তিনি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। পড়াশুনা শেষ করে তিনি একটি অফিসে চাকুরি করেছেন। অল্পদিন পর ওই চাকুরি ছেড়ে দিয়ে শুরু করেন সাংবাদিকতা। আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান মি. পলেন কলকাতায় এলে সুনীলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। সেই সূত্রে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে আমেরিকা যান। ডিগ্রি অর্জনের পর কিছুদিন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপগ্রন্থাগারিক হিসাবে কাজ করেন। তারপর চলে আসেন কলকাতা।
১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কৃত্তিবাস নামে একটি কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ একা এবং কয়েকজন এবং ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম উপন্যাস আত্মপ্রকাশ প্রকাশিত হয়। তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই হলো আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি, যুগলবন্দী (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), হঠাৎ নীরার জন্য, রাত্রির রঁদেভূ, শ্যামবাজারের মোড়ের আড্ডা, অর্ধেক জীবন, অরণ্যের দিনরাত্রি, অর্জুন,

প্রথম আলো, সেই সময়, পূর্ব পশ্চিম, ভানু ও রাণু, মনের মানুষ প্রভৃতি। শিশুসাহিত্যে তিনি “কাকাবাবু-সন্তু” নামে এক জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজের রচয়িতা। মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত তিনি ভারতের জাতীয় সাহিত্য প্রতিষ্ঠান সাহিত্য অকাদেমি ও পশ্চিমবঙ্গ শিশুকিশোর আকাদেমির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
নীললোহিত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছদ্মনাম। নীললোহিতের মাধ্যমে সুনীল নিজের একটি পৃথক সত্তা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। নীললোহিতের সব কাহিনিতেই নীললোহিতই কেন্দ্রীয় চরিত্র। সে নিজেই কাহিনিটি বলে চলে আত্মকথার ভঙ্গিতে। সব কাহিনিতেই নীললোহিতের বয়স সাতাশ। সাতাশের বেশি তার বয়স বাড়ে না। বিভিন্ন কাহিনিতে দেখা যায় নীললোহিত চির-বেকার। চাকরিতে ঢুকলেও সে বেশিদিন টেকে না। তার বাড়িতে মা, দাদা, বৌদি রয়েছেন। নীললোহিতের বহু কাহিনিতেই দিকশূন্যপুর বলে একটি জায়গার কথা শোনা যায়। যেখানে বহু শিক্ষিত, সফল কিন্তু জীবন সম্পর্কে নিস্পৃহ মানুষ একাকী জীবনযাপন করেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কয়েকটি গল্প-উপন্যাসের কাহিনি চলচ্চিত্রে রূপায়ণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত অরণ্যের দিনরাত্রি এবং প্রতিদ্বন্দ্বী উল্লেখযোগ্য। এছাড়া কাকাবাবু চরিত্রের চারটি কাহিনি সবুজ দ্বীপের রাজা, কাকাবাবু হেরে গেলেন?, মিশর রহস্য এবং ইয়েতি অভিযান চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। হঠাৎ নীরার জন্য তাঁর চিত্রনাট্যে নির্মিত আরেকটি ছবি।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে অক্টোবর তিনি মারা যান। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে ৪ঠা এপ্রিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতার ‘গণদর্পণ’কে সস্ত্রীক মরণোত্তর দেহ দান করে দিয়েছিলেন। কিন্তু একমাত্র পুত্র সৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ইচ্ছায় পিতার মরদেহ দাহ করা হয়।